রূপান্তরের গল্প ৩০৯ | Rupantorer Golpo 309

দস্যুমুক্ত সুন্দরবন কেউ চায় না! | রূপান্তরের গল্প ৩০৯

দস্যুমুক্ত সুন্দরবন কেউ চায় না! | রূপান্তরের গল্প ৩০৯ | Rupantorer Golpo 309 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৯ : এদিকে গোলাগুলি চলে সারা বছর। সুন্দরবনের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত তটস্থ করে রাখে বনদস্যুরা। জেলেরা যেমন বনদস্যুদের ভয়ে আড়ষ্ঠ থাকে। তেমনি বন বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরাও থাকে আতঙ্কে। এর কারণও আছে।

২০০০ সালের আগে পরে দস্যুতার প্রকোপ অনেক বেশি বেড়ে যায়। বনদস্যুদের হাতে আসে অস্ত্র আর গুলি। ফরেস্ট অফিসে এসে দস্যুদের আস্ফালন শুরু হয়। বন্দুক হাতে দলে দলে তারা উঠে পড়ে বন টহল ফাঁড়ীতে। একটু এদিক সেদিক হলে তারা চড়াও হয়। বনরক্ষীদের অপমান অপদস্ত করে।

পশ্চিম সুন্দরবনের হলদেবুনিয়া টহল ফাঁড়ীতে হামলা করেছিলো দস্যুরা। ফাঁড়ীর সবগুলো অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তারপর থেকে সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি টহল ফাঁড়ী বন্ধ করে দেওয়া হয়। মধ্য সুন্দরবনের ঝাপসি, মাইটে, পূর্ব দিকের মৃগামারীসহ কয়েকটি ফরেস্ট অফিস বন্ধ হয় তখন। কয়েকটি সুরক্ষিত ফরেস্ট অফিস ছাড়া অন্য সব অফিস থেকে প্রত্যাহার করা হয় অস্ত্রশস্ত্র।

একটি সংরক্ষিত বনে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। এটি প্রাণবৈচিত্রের জন্য কতোটা ঝুঁকির তা বুঝদাররা বুঝতে পারবেন। আমি প্রাণবৈচিত্র বুঝি কম। তবে এটুকু বুঝি যে চার শ’ পাঁচেক অবৈধ বন্দুক আর হাজার হাজার গুলি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে বনদস্যুরা।

এই বনের বাঘ থেকে শুরু করে হরিণ, বন্যশুকর, পাখিগুলো মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে সারা বছর। এছাড়া অবৈধ ভাবে মাছ শিকার, হরিণ শিকার চলে বনদস্যুদের ছত্রছায়ায়। বড় বড় ব্যবসায়ীদেরও পৃষ্ঠপোশক এই বনদস্যুরা। সুন্দরবনের সুরক্ষায় তাই বনরক্ষীদের ভূমিকা রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

আমি ভাবছি, সুন্দরবন থেকে বনদস্যুদের উঠিয়ে নিতে কাজ করছি। অথচ আমার সাথে এমন বৈরী আচরণ কেন করছেন বনরক্ষীদের কেউ কেউ? ধীরে ধীরে বুঝেছি যে পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে একটি সিন্ডিকেট। সবাই এই বনের সম্পদের অবৈধ ভাগীদার।

পুরো কারবারটি চলে ভয়ের ওপর। বন উপকূলে ভয় যতো বেশি তাদের ব্যবসাও ততো বেশি। তারা সবাই মিলে বন উপকূলের ভয় আর আতঙ্ককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। সেজন্যই একটি ভালো কাজে নেমেও আমাকে বার বার বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে।

আজ বনরক্ষীদের আচরণে অবাক হয়েছি। গেলো কয়েক মাসে সুন্দরবনের আটটি বনদস্যু দল আত্মসমর্পণ করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনটি দস্যুদলও ছিলো। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যস্ততা করেছি আমি। এটি প্রায় সবার জানা। এখনও বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি বাকী দস্যুদলগুলোকে আত্মসমর্পণের লক্ষ নিয়ে। এটিও অনেকের জানা। তারপরও আমাকে বন থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা কেন করছেন কেউ কেউ?

ভোর রাতে আমাদের ট্রলারের কাছে এসে গালিগালাজ করে গেছেন বন বিভাগের লোকজন। সকালে এসেও বেশ খারাপ ব্যবহার করলেন তাঁরা। অথচ এই পশ্চিম সুন্দরবনে অবৈধ ভাবে মাছ শিকার পুরোটাই চলছে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায়। আমাদের উপস্থিতির খবর তাঁদের দিয়েছেন বড় এক মাছ ব্যবসায়ী। সেই মহাজনের হয়েই যেন দৌড়াচ্ছেন বনরক্ষীরা।

নীল কমল ফরেস্ট অফিসের বনরক্ষীরা চলে গেছেন। উনাদের কারও সাথে আমার আগে থেকে পরিচয় ছিলো না। কারও বুকে নেমপ্লেট নাই বলে নামও জানতে পারিনি। নিজের পরিচয় দিয়েছি, কিন্তু উনারা তাঁদের নাম বললেন না।

বেশ অসহিষ্ণু আচরণ করে ফিরলেন তাঁরা। এসব দেখে ট্রলারের সহযাত্রীরা একটু মন খারাপ করেছেন। আসলে ভালো কাজ করতে এসে বনের অভিভাবকদের এমন অসম্মান কেউই নিতে পারছে না। বেলায়েত সরদার বললেন, এই তোমরা চিন্তা করো না। রান্নাবান্নার আয়োজন করো। আমাকে বললেন, আরও অনেক কিছু দেখবেন ভাই। কেবল তো শুরু!

আমরা কী চলে যাবো? শহীদুল কাকু জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, চলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু এখন আর যাওয়া যাবে না। কয়দিন থাকবো এদিকে। কাকু বললেন, কয়দিন থাকবো আমরা? জানতে চাইলাম, বাজর সদা আছে কয়দিনের? উনি বললেন, চলবে আরও সাতদিন। বললাম, একটু হিসাব করে খরচ করেন। আমরা অন্তত আরও তিন দিন থাকবো।

সরদারের কাছে জানতে চাইলাম, জ্বালানী তেলের খবর কী ভাই? সরদার বললেন, আরও একশ লিটার তেল আছে ভাই। তেল নিয়ে চিন্তা নাই। দরকার হলে দুবলা থেকে লোকজন এসে ডিজেল দিয়ে যাবে। জানতে চাইলাম, রান্নার গ্যাস আছে? মামুন বললো, এলপি গ্যাসের একটি শর্ট পড়তে পারে। তবে সাথে কেরোসিনের চুলা আছে। অসুবিধা হবে না।

এই সফরে হিসাবের চেয়ে বাড়তি সময় সুন্দরবনে থাকবো আমরা। কাল থেকে গোন শেষ। জেলেরা উঠে যাবে লোকালয়ে। তখন নিজেদের মাছ ধরে খেতে হবে। এনিয়ে অবশ্য চিন্তা করছি না। সুন্দরবনের এই অঞ্চলে এখনও মাছ আছে। বড়শি বা ঝাঁকি জাল দিয়ে খাওয়ার মাছ ধরতে পারবো।

বেলায়েত সরদারকে বললাম, আপনার বনে আসার অনুমতি নিয়ে ওরা ঝামেলা করতে পারে। আপনি বিচলিত হবেন না। সমস্যা হলে বিষয়টি নিয়ে আমি বনকর্তাদের সাথে কথা বলবো।

বালির গাঙ-এ আমরা এই বেলা থাকবো। শেষ ভাটায় বের হবো। পশ্চিমের বড় নদীটির নাম আড়পাঙ্গাসিয়া। এর দুই পাশের খালগুলো ধরে ঘুরবো। রাতে থাকবো পুতনীর দ্বীপে। কাল ভরা জোয়ারে পাড়ি দিয়ে যাবো মান্দারবাড়িয়া, উত্তর তালপট্টির ওইদিকে।

জলদস্যু নোয়া বাহিনী এখন সম্ভবত ওদিকেই আছে। পশ্চিম সুন্দরবনে আরেকটি বড় দস্যুদল আছে- আলিফ বাহিনী। ওদের সাথেও আত্মসমর্পণ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ওদিকের ছোট দস্যুদলগুলোর সাথেও আমার যোগাযোগ আছে। আমি না চিনলেও ওরা আমাকে চিনে। দেখা হলেও সমস্যা হবে না।

সূর্য মাথার ওপর। শুরু হয়েছে বেলায়েত সরদারের হাঁকডাক। রান্নাঘরের সামনে বসে চিৎকার করে মামুন আর শহীদুল কাকুকে তটস্থ করে রেখেছেন। জানতে চাইলাম, কী রান্না হবে আজ?

সরদার বললেন, ভাতের সাথে পাতলা ডাল থাকবে। আর চিংড়ির ঘটি গরম। বললাম, দাতিনা আর পায়রা মাছ আছে না ট্রলারে? বললেন, দুইটা ভেটকী মাছ আছে। একটা ইলশে তাইড়েলও আছে। রাতে বারবিকিউ করে দিবো। আপাতত দুপুর বেলা ডাল ভাত খান। বললাম, কোনো অসুবিধা নাই।

প্রথমে চুলায় উঠেছে ভাত। আরেকটি পাতিলে ডাল ধুয়ে রাখা। নোঙড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা। বাটা মসলার ঘ্রান ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ওদিকে বড়ফ থেকে এক গামলা চিংড়ি বের করে কাটা-বাছার কাজ করছে শহীদুল কাকু। সরদারের কাছে গিয়ে কানে কানে বললাম, এক কাপ চা হবে? মসলা বাটতে বাটতে উনি বললেন, ভাতটা তো নামাতে দিবেন। তারপর না হয় করে দিবো!

অপেক্ষা করতে হবে আধা ঘন্টা। কারণ একটু আগে ভাতের হাঁড়ি বসানো হয়েছে। আমার অবস্থা দেখে মনে হয় একটু মায়া হলো। ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে চা চড়ালেন সরদার। এরপর উঠে গলুই-এ গিয়ে ঝাঁপ দিলেন পানিতে। গোসল সেরে উঠে আসলেন। তারপর গা মুছতে মুছতে বললেন, আপনি ভাই বেশি ভদ্র। অন্য কেউ হলে এই অসম্মান সহ্য করতো না।

বললাম, আমি খুব সাধারণ একজন। একটা বড় কাজ নিয়ে নেমেছি। আর বছর খানেক কাজ করতে পারলে সুন্দরবনের সবগুলো দস্যুদল দেখবেন সারেন্ডার করে ফেলবে। সুন্দরবন হবে দস্যুমুক্ত। মাথা চুলকাতে চুলকাতে সরদার বললেন, এই বাদা বনের কেউ সেটা চায় না ভাই। বললাম, সেজন্যই তো মাথা ঠান্ডা করে কাজ করছি। এখন অনেক কিছুই হজম করতে হবে। বড় কিছু অর্জন করার পথ সহজ হয় না ভাই। মাথা গরম করলে ভুল হবে। ভুল করলে ভেস্তে যেতে পারে দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়ার চেষ্টা।

সরদার বলেন, মাথা এতো ঠান্ডা রাখা যায় ভাই? বললাম, উপায় নাই!

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top