টেমি জ্বললো বইশেলের নৌকায় | রূপান্তরের গল্প ২১৫ | Rupantorer Golpo 215 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২১৫ : টেমিগুলো এতো ভালো জ্বলে কী করে? এই বন উপকূলে কাজ করতে এসে অনেক কিছুই দেখছি, কতো কিছু শিখি! রাতের দিকে বাতাস বেড়েছে অনেক। আর আমরা আছি মৃগামারীর দোয়ায়। কেওড়া গাছের সাথে বাঁধা নৌকা বাতাসের ঝাপটায় দুলছে। নৌকার খোলে রাখা কেরোসিনের বাতিটি দপদপ করে জ্বলছে। এদিকে বাতিকে বলে টেমি। অদ্ভুদ ভাবে সেগুলো জ্বলে বাতাস আর বৃষ্টির মধ্যেও।
রহিম চাচার সাথে পরিচয় হওয়ার সাথে সাথেই পরিবেশ পাল্টে গেলো। এতোক্ষণ যেই মানুষটি ফিসফিস করছিলেন, তিনিই এখন গল্প করছেন দরাজ গলায়। বাতি জ্বালিয়েছেন। জোলা খাল থেকে নৌকা নিয়ে এসে নোঙ্গর করেছেন খালের দোয়ায়, সেলা নদীর মুখে। এখানে বাতাস বইছে মনের মতো। ছোট্ট নৌকায় তিনজন মানুষ। রাতের খাবার হবে বড়শিতে প্রথম টান দেওয়ার পর। অবশ্য তার আগেই চুলা জ্বললো। চা হবে।
সুন্দরবনের জেলেরা কড়া রঙ চা খায়। এতো কড়া চা! খেলে আমার মাথা ঘুরায়। হুট করে নেমেছি বলে দুধ কেনা হয়নি। সাথে আছে শুধু পিঠের ব্যাগটি। কিন্তু এতেই অনেক কিছু থাকে। ব্যাগ হাতড়াতেই বের হলো ছোট্ট একটি সপিং ব্যাগ। তার ভিতরে গুঁড়া দুধের কয়েকটি ছোট প্যাকেট। কী আনন্দের ব্যাপার! ঝটপট সেগুলো বের করে দিলাম। দুধ চায়ের সাথে টোস্ট বিস্কিট। পরপর কয়েকটি টোস্ট বিস্কিট খেয়ে ফেললাম।
রাতের খাবার কখন খাবো চাচা? জিজ্ঞেস করতেই রহিম হাওলাদার বললেন, বড় মাছ খাওয়াবোনে কাকা। আল্লাহ দিলে প্রথম টানেই মাছ পড়বে। সেই মাছ দিয়ে হবে রাতের খাবার। মৃগামারীতে বড়শি ফেলবো আর মাছ হবে না তা হবে না। জানালেন, আজকে জোয়ার ভাটার দিকে তাকাবো না। আধা ঘন্টা পরেই বড়শি তুলবো। রাত তখন দুইটার মতো বাজে। ভাটা শেষের দিকে। এমনিতেও বড়শি তোলার সময় হয়ে গেছে।
এবার মন খুলে কথা বলার সময়। চাচাকে বললাম, এদিকে কোনো পার্টি আসবে আজ রাতে? কয়েক মুহুর্ত ভেবে বললেন, আসলেও আসতে পারে। তবে বড় সুমন বাহিনীর আসার সম্ভাবনা নাই। ওরা আছে নিচের দিকে। চাত্রী-ঘসিয়াঙ্গাড়ী অর্থাৎ চরাপুঁটিয়ার নিচের দিকে আছে ওরা। এদিকে খুব একটা আসে না। তবে মোশাররফের পার্টি এদিকেই আছে। কপালে থাকলে দেখা হয়ে যেতে পারে। বললাম, বড়শির টানটা দিয়ে বড় নদীর মধ্যে নোঙ্গর করবেন। দুই পাশ থেকে যেন আমাদের দেখা যায়।
আধা ঘন্টা সময় আছে হাতে। উনারা দুইজন মিলে ভাত চড়ালেন। ছোট্ট নৌকার খোলের ভিতরটাও ছোট। তার ভিতরেই রাজ্যের জিনিষপত্র। একটি সংসারে যা কিছু থাকে তার প্রায় সবাই থাকে এখানে। বস্তার ভিতরে রাখা কাঁথা বালিশ বের করলেন। সুন্দর করে বিছিয়ে দিলেন ওই পাটাতনের ওপর। বললেন, আপনি একটু শুয়ে পড়েন কাকা। আমরা রান্নাটা আগায়ে নেই। বললাম, এখন শুলে ঘুম আসবে না। বরং আপনাদের সাথে একটু গল্প করি।
টিনের চুলা। নৌকায় বসানোর জন্য মনে হয় বিশেষ করে তৈরি এই চুলাগুলো। সুন্দরবনের শুকনো কাঠ জ্বালানী হিসাবে দারুণ। ভালো জ্বলে। সুন্দরীর শুকনা ডালগুলো সবচেয়ে ভালো জ্বলে। চুলার পাশে রাখা কয়েকটি জ্বালানীগুলো কেটে টুকরো টুকরো করছেন রহিম চাচা।
সুন্দরবনের জেলেদের নৌকায় আর কিছু থাকুক না থাকুক, একটি করে দা থাকে। ভোঁতা সেই দা দিয়েই চলে তাবৎ কাজ। এই মুহুর্তে চলছে কাঠ চিড়াই এর কাজ। দা-এর ছোট ছোট কোপ দিয়ে কী সুন্দর করে চিঁড়ে ফেলা হচ্ছে জ্বালানীগুলো! ছোট টুকরোগুলো চুলায় দিতেই আগুন জ্বলে উঠছে।
সুন্দরী কাঠের আগুন সবচেয়ে ভালো জ্বলে, টিকেও অনেক ক্ষণ। সুন্দরবনের এই মানুষগুলোর প্রাণশক্তি অবাক করার মতো। এছাড়া কথাবার্তায় প্রচুর হিউমার (হাস্যরস)। প্রতিটি কথা যুক্তি আর তথ্যে ভরপুর। কখনও কখনও কথা বলে ওঠেন দার্শনিকদের মতো। এসময় বেলায়েত সরদারকে খুব মনে পড়ছে। তাকে আনতে পারিনি নৌকায় জায়গা নাই বলে।
ধীরে ধীরে আবার মূল গল্পে ঢুকছি। সুন্দরবনের দস্যুতা, মহাজনী চক্র আর বন বিভাগের ভূমিকা নিয়ে অনেক কিছু জানার আছে। এমনিতে অনেক কিছুই জেনেছি। আবার অনেক কিছু জানারও বাঁকী। আমি খুঁজছি বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদের। শহরের অনেকের কথা শুনি। কিন্তু এই জঙ্গলের দস্যু আর শহরের গডফাদারদের মধ্যে আরও কিছু মানুষ আছে। সেই মধ্যস্বত্বভোগীদের চিনতে হবে।
এই চাঁদা সংগ্রহকারীদের ছাড় দিয়ে রেখে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা যাবে না। তাই এই মুহুর্তের প্রতিটি কাজের মধ্য দিয়ে সেই লোকগুলোকে খুঁজছি আমি। এবিষয়ে এবারের সহযাত্রী আমার সোর্স কোনো কথাই বলছেন না।
বইশেল রহিম চাচা বলছেন, ডাকাতে টাকা নেয়, নিক। কিন্তু যে অত্যাচারটা করে! আগাম চাঁদা না দিয়ে একবার আটকা পড়লে বিশাল অংকের মুক্তিপণ চেয়ে বসে। সেই টাকা জোগাতে সূদে ঋণ নেওয়া লাগে। সেই ঋণ আর শোধ হয় না কাকা। একবার পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিলে সারা জীবন সূদ টেনে যাই। কিন্তু আসল আর শোধ হয় না। জঙ্গলের ডাকাতের চেয়ে এই সূদের কারবারীরা বড় ডাকাত।
চাচা বলে যাচ্ছেন, বনদস্যুরা ধরলে হাত-পা ধরে মাফ পাওয়া যায়। কিন্তু সূদের কারবারীদের মনে দয়া মায়া নাই। আবার ফরেস্টের নতুন বাহিনী নামছে, স্মার্ট বাহিনী। ওরা ধরলেও ছাড়াছাড়ি নাই। হয় চালান দেয়, না হয় জরিমানা নেয়। ওদের সাথে যোগাযোগ করে না আসলেও হয় না। বললাম, আপনার কি কোনো মহাজন আছে? বললেন, দাদন তো নেওয়াই লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, এই যে ডাকাত, ফরেস্টারদের টাকা দেন, এগুলো কি সরাসরি দেন?
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রহিম হাওলাদার বললেন, এতো কথা শুনে কী করবেন কাকা? আমাদের জীবনটাই এরকম। খালি দিতেই থাকি। আমাদের কেউ দেয় না। এই যে অবরোধের সময় সরকার টাকা দেয়। সেই টাকাও তো আমরা পাই না। কেমন করে চলি বলেন? যদি আল্লাহ একটু বেশি মাছ দেয় তাহলে চলতে পারি। মাছ না পেলে আবার ঋণ নেই। এভাবেই চলে আমাদের।
যা জানতে চাইছি তার উত্তর দিলেন না চাচা। আবারও জানতে চাইলাম, ডাকাতদের চাঁদার টাকা কি সরাসরি দেন? কতো করে দিতে হয় তাদের? রহিম চাচা আবারও কথা ঘুরালেন। বললেন, বড়শি টানার সময় হয়ে গেছে কাকা। চলেন, মাছ ধরি। তারপর রান্না করতে হবে। অনেক কাজ। বলেই গাছ থেকে দড়ি খুলে নৌকা বাইতে শুরু করলেন। নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে খালের দোয়ার ঠিক মাঝখানে। ভাসনাটি ওখানে দেওয়া। ভাসনা মানে খালি পানির বোতল। দাওন বড়শির তোলা শুরু হবে ওখান থেকে।
নৌকা এগিয়ে চলছে। সামনে আমার সেই সোর্স। পিছনে বসে বাইছেন ষাটোর্ধ বইশেল রহিম চাচা। কেউ কোনো কথা বলছেন না। আমার ওই প্রশ্নের পর থেকে উনি চুপ করে গেছেন। ভাবছি, হলোটা কী? হঠাৎ মনে পড়লো প্রশ্নের কথা…. দস্যুদের চাঁদা দেন কার মাধ্যমে?
আমার সহযাত্রী সামনে বসা এই সোর্স সম্ভবত সেই মানুষদের একজন। এরাই দস্যু আর বন বিভাগের নামে চাঁদা তোলে। মুক্তিপণের টাকাও দিতে হয় এই সোর্সদের মাধ্যমে। মজার কথা হলো, আমার এই সোর্স একাধারে আমার কাজ করেন, RAB, কোস্টগার্ড, পুলিশের সোর্সগিরিও করেন। আবার বনদস্যুদের প্রতিনিধি হিসাবে এরাই চাঁদা তোলেন। মোটকথা তীরে বসে শুধু দালালি করে তারা লাখ লাখ টাকা কামাই করেন।
সবাই সবকিছু জানেন। রহিম চাচা তাই আমার সোর্স-এর সামনে মুখ খুলছেন না, খুলবেনও না। অবশ্য আমাকে দারুণ ভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন তিনি। আপাতত তথ্যের দরকার নাই। ভালোবাসাটুকু উপভোগ করি।