চোরের মতো ঢুকলাম জোংড়া খালে | রূপান্তরের গল্প ২২৭ | Rupantorer Golpo 227 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২২৭ : জোয়ার-ভাটার সাথে সাথে পাল্টে যায় নদীর চেহারা। জোয়ারে নৌকা চলে উজানে। ভাটায় চলে ভাটিতে, মানে দক্ষিণে। শেষ জোয়ার ও শেষ ভাটায় নদী-সাগরের পানি একদম থেমে যায়। তখন পুকুরের মতো ভাসতে থাকি।
সুন্দরবন আর সাগরে এই সময়ে বড়শি ফেললে মাছ ওঠে। জঙ্গলের খাল নদীতে বড়শি ফেলানো নেশার মতো হয়ে গেছে। নামার সময় আর কিছু না হলেও বড়শি রাখি। আরেকটা জিনিষ রাখি সাথে- দুধ চায়ের সরঞ্জাম।
এখন অর্ধেক জোয়ার। ভরা গোন বলে নদীতে তীব্র স্রোত। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা সেই স্রোতের সাথে বেয়ে চলছে। তরতর করে হাতে বাওয়া নৌকার ছুটে চলার গতি নেহায়েত কম না। সুন্দরবনের জেলেরা এসময় বৈঠা বায় স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে।
বনদস্যুরা অবশ্য চলার সময় জোয়ার-ভাটা মানে না। ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে যারা থাকে তারা বাইচ চালানোর মতো করে নৌকা চালায়। তবে নি:শব্দে চলে তারা। পানিতে বৈঠা মারার সময় শব্দ হয় না একদম। প্রতিটি নৌকায় এক ছন্দে চলে ছয়টি বৈঠা। রাতে আমরা তেমন নৌকায় চড়বো- বনদস্যু সাগর বাহিনীর নৌকায়।
পশুর নদীর এদিকটায় নতুন সাইলো তৈরি হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির খাদ্য গুদাম। বিশাল এই সাইলোটি করা হয়েছে সিডর থেকে শিক্ষা নিয়ে। ভয়ঙ্কর সাইক্লোন- সিডরের পর দেশে খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। বিপন্ন এই উপকূলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে অন্য এলাকা থেকে খাবার পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়।
সেই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে মংলার জয়মনিরঘোলে সাইলো নির্মাণ করা হয়। বন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় নৌপথেই এখানে খাদ্য আসে।আবার উপকূলীয় জেলাগুলো এখান থেকে নৌপথে সংযুক্ত। দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে এখান থেকে উপকূলের যেকোনো জেলায় খাদ্য সরবরাহ করা যাবে। মোট কথা সিডরের পর খাদ্য নিয়ে যে সংকটে পড়েছিলো বাংলাদেশ, সেই বিপদ আর থাকছে না।
সাইলো’র সামনে বিশাল জেটি। অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বলে আছে কড়া পাহাড়া। তাই একটু দূরে নোঙ্গর করেছি ট্রলার। ট্রলানে বসে চলছে চা-আড্ডা।
বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামিন আলী এসেছেন। তিনিও যাবেন। খবির মামা কাকে জানি ফোন দিলেন। পাশের কোথাও থেকে দুটি ডিঙ্গি নৌকা আসলো। ওই নৌকাতে করে ট্রলারে আসলেন ইয়ামীন ভাই। সেগুলো বেঁধে ফেলা হলো ট্রলারের সাথে। খবির মামা বললেন, ট্রলার নিয়ে জোংড়া খালে ঢুকতে ঝামেলা হলে ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ঢুকে পড়বো।
হেলেদুলে গল্প করছি আমরা। মনের ভিতরে দুশ্চিন্তা। প্রকাশ করছি না। কিন্তু জামাল মেম্বার ছটফট করছেন। বিড়বিড় করে বললেন, বন্যা জোয়ারে খাল পারি দিতে হবে। জিজ্ঞেস করলাম, কোন খাল? মেম্বার চুপ।
বুঝতে পারছি দস্যুদের লোকােশন নিয়ে এখন কথা বলা যাবে না। তাই আমি চুপ করে গেলাম। এটাও বুঝতে পারছি আমাদের চিপা’র খাল পার হতে হবে।
না বললেও বুঝতে পেরেছি, জোংড়ায় ঢুকে চিপা’র খাল পেরিয়ে যেতে যাবো আমরা। তার মানে দস্যুরা জোংড়া খালের ভিতরে নাই। তারা ঝাপসি বা মরাপশুরের ভিতরে কোনো খালে আছে। বন্যা জোয়ারে খাল পার হতে হবে মানে ওদিকেই যাবো আমরা।
তিন পোয়া জোয়ার হয়ে গেছে। আরেক কাপ চা খেয়ে নিলাম। পরের কাপ চা কখন হবে জানি না। সব ঠিক থাকলে সাগর বাহিনীর নৌকা বহরে গিয়ে পরের কাপ চা খাবো। নোঙ্গর তুলতে বললাম।
জোয়ারের স্রোত থাকতে থাকতে জোংড়া খালে ঢুকতে হবে। ভরা জোয়ার বা বন্যা জোয়ারের সময় সরু কোনো খাল পারি দিতে হবে। সামনে আর কী কী অপেক্ষা করছে জানি না। গন্তব্য সুনির্দিষ্ট ভাবে জানা নাই বলে মনের ভিতর থেকে খটকা যাচ্ছেই না।
ঘটঘট শব্দে চলছি আমরা। পশুর নদী পারি দিয়ে চলে গেলাম উল্টো পাশে। জোংড়া খালের প্রবেশ মুখ থেকে একটু ভাটিতে গিয়ে আবার নোঙ্গর করলাম। সুন্দরবন ঘেঁষে এমন ভাবে ট্রলার রাখলাম যাতে দূর থেকে সহসা চোখে না পড়ি। ভিতরের সব আলো নিভিয়ে ফেললাম। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি নামলো। আধা ঘন্টার মতো ঝরলো ভারী বৃষ্টি।
গলুই-এ দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলছেন খবির মামা আর জামাল মেম্বার। পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, এখান থেকে কি আমরা নৌকা নিয়ে যাবো? খবির মামা একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে রওনা দিলেন। ফিরে আসলেন ২০ মিনিটের মধ্যে। বললেন, ফরেস্টাররা সব ঘুমাচ্ছে।
ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করলাম না। নোঙ্গর তুলে ভাসিয়ে দিলাম। তীরের জঙ্গল ধরে কিছু দূর গিয়ে পড়লাম জোংড়া খালের মুখে। এবার আর গাছের ডালপালা ধরে আগানোর উপায় নাই। কারণ এ পাশটায় চর জেগেছে।
ভাগ্যিস জোয়ারের স্রোত ছিলো। ভাসতে ভাসতে ট্রলার ঢুকে পড়লো খালের ভিতরে। একটু আগে বৃষ্টি ছিলো বলে বনরক্ষীরা সবাই ভিতরে। তা না হলে এই খালে ঢুকতেই পারতাম না। বনরক্ষীরা আমার কাজ এগিয়ে দিতে পারেন না। পারেন শুধু প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে। আমি তাই এড়িয়ে চলি উনাদের।
ইঞ্জিন আর চালু করবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু ট্রলার তো আর আগায় না। খালের ভিতরে পানি থমথমে হয়ে গেছে। মানে জোয়ার শেষ। চোরের মত নি:শব্দে জোংড়া বনটহল ফাঁড়ীর কর্মীদের চোখ এড়িয়েছি। তবে এখন আর ইঞ্জিন না চালালে হবে না।
খবির মামাকে বললাম, কম শব্দ করে আপনার ট্রলারের ইঞ্জিনটা চালু করতে পারেন? মামা হেসে দিলেন। বললেন, তা কী করে সম্ভব? ইঞ্জিন তো শব্দ করবেই। বললাম, তাই বলে এতো শব্দ? বলতে বলতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চালু করা হলো ইঞ্জিন। সিঙ্গেল স্ট্রোক বা এক গুতো মেশিন। ষব্দ করবেই। বনরক্ষীরা সত্যিই ঘুমাচ্ছে। তা না হলে ট্রলার চালানোর পর তাদের ইশারা দেওয়ার কথা।
তিন বাঁক পরেই চিপার খাল। কাছাকাছি যেতেই হাতের বাম পাশের জঙ্গল থেকে ইশারা এলো। বন্ধ করলাম ট্রলার। বনদস্যু সাগর বাহিনীর আগাম দল এসেছে। ডিঙ্গি নৌকায় করে ওরা আমাদের নিয়ে যাবে তাদের ডেরায়।
(ছবি: সাগর বাহিনীর একটি দল আমাদের নিতে আসে | সুন্দরবন | সেপ্টেম্বর ২০১৬)