আটকা পড়লাম চিপা’র খালে | রূপান্তরের গল্প ২২৮ | Rupantorer Golpo 228 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২২৮ : চিপা’র খালে ঢুকবো আমরা। গা ছমছম করছে। খালটি সত্যি সত্যি সরু। ডিঙ্গি নৌকায় করে লম্বা পথ। জোংড়া থেকে ওপাশের বড় খালে বের হতে সময় লাগে দুই ঘন্টা। শুরুতে খালটি একটু প্রশস্ত, ১৫/২০ ফুট হবে। তারপর ক্রমেই সরু হতে হতে এক সময় মনে হয় ডাঙ্গার ওপর দিয়ে চলতে হয়। পথে গাছ-গাছালির অভাব নাই। সেই গাছে বসবাস করে নানা জাতের সাপ। দিনের বেলায় তাও দেখেশুনে যাওয়া যায়। রাতের বেলায় আলো না জ্বালালে নিকষ অন্ধকার। আকাশে চাঁদ থাকলেও কিছুই দেখা যায় না। বড় বড় গাছের তল দিয়ে সেই খালটি রীতিমতো ভীতি জাগায়।
একবার এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় গাছ থেকে একটি বড় গুইসাপ এসে পড়ে ট্রলারের খোলের ভিতরে। রাতের বেলা বলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম সবাই। পরে লাফ দিয়ে সেটি জঙ্গলে নেমে যায়। আরেক বার এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় বিশাল একটি দাঁড়াশ সাপ সামনে পড়লো। সে কী অবস্থা আমাদের! এদিকের জঙ্গলে কেউটে সাপেরও অভাব নাই। গাছে গাছে ঝুলে থাকে সবুজ রঙ এর সাপ। এক কথায় সাপ দেখতে দেখতে বাঘের কথা ভুলে যাই আমি।
চিপার খালের মুখে আমাদের ট্রলারটি নোঙ্গর করা হলো। জোংড়া খালটি চওড়ায় বেশি বড় না হলেও গভীরতা অনেক। সামনে এগুলে দুই পাশে পড়বে অসংখ্য খাল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খালগুলো হলো ছোট বস্তা, বড় বস্তা, টগিরবগির। খালটি সোজা চলে গেছে পশ্চিমে। শেষ প্রান্ত একদম সরু হয়ে মিশেছে ভদ্রা নদীর আগায়। এই জায়গায় খালটিকে বলা হয় জোংড়ার ভাড়ানী। এদিক দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা চলে অহরহ। ট্রলার চলে না।
আমরা অতোদূর যাইনি। জোংড়া খালে ঢুকে আধা ঘন্টার পথ পেরিয়ে দাঁড়িয়েছি। ওখানে আগে থেকে সাগর বাহিনীর দস্যুরা এসে অবস্থান নিয়েছে। চারপাশে খোঁজ খবর নিয়ে দেখলো তারা। কয়েক দিন আগেই আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযানের মুখে পড়েছে তারা। তাই এ দফায় একটু বেশি সতর্ক। আমরা এসেছি সেই খবর পেয়ে গেলে হয়তো আবারও কোনো অভিযান চলতে পারে। ভাগ্যিস বন বিভাগের লোকজন আমাদের খেয়াল করেনি। সেখান থেকে আমাদের আসার খবর বের হওয়ার শংকা ছিলো সবচেয়ে বেশি।
ট্রলারটি ধীরে ধীরে জঙ্গল ঘেঁষে রাখা হলো। জঙ্গল থেকে একজন একজন করে বনদস্যু লাফিয়ে উঠলো। কাঁদা মাখা পা ধুয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। থরথর করে কাঁপছে এক একজন সশস্ত্র বনদস্যু। সবাই তরুণ। মনে হয় অনেক সময় ধরে এই জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়ানো তারা।
এই দলের নেতৃত্বে আছে কাবীর নামের এক দস্যু। মংলার ওদিকেই বাড়ি। মাছ ধরতো সুন্দরবনের এই অঞ্চলে। এই অঞ্চলে জেলেদের সাথে যখন আসতাম তখন অনেক বার দেখা হয়েছে তার সাথে। নান্না নামের লম্বা তরুণের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো চিলা বাজারে। তার বাবা ছিলো ডাকসাইটে দস্যুনেতা, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। তবে নান্না কখনও দস্যুতা করেছে বলে শুনিনি। জড়িয়ে ধরে সে বললো, আমাদের বাঁচান ভাই। বললাম, এই মরার লাইনে আসছো কেন? বললো, সে অনেক কথা ভাই।
এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না। ট্রলারটি এদিকেই থাকবে। আমরা যাওয়ার পর সামনের কোনো ছোট খালে ঢুকিয়ে রাখা হবে। আর আমরা উঠবো ডিঙ্গি নৌকায়। আমার সহকর্মী ভিডিওগ্রাফার মিরাজকে বললাম, ক্যামেরার যন্ত্রপাতিগুলো বের করো, দেখে শুনে সব নৌকায় উঠাও।
ট্রলারের ভিতর থেকে ক্যামেরার ব্যাগ বের করে নৌকায় উঠানো হলো। বাজারের ব্যাগগুলো তোলা হলো দস্যুদের নৌকায়। আমার কাঁধের ব্যাগটিও তুলে দিলাম নৌকায়। ব্যাগের ভিতর জরুরি জিনিষপত্র বলতে মোবাইল ফোনে চার্য দেওয়ার পাওয়ার ব্যাংক। আর আছে চা পাতা, চিনি ও গুঁড়া দুধের প্যাকেট। সুন্দরবনে এই জিনিষগুলো নিতে ভুল করি না। বনদস্যু নান্না বললো, তারাও কিছু বাজার করিয়েছে। দুধ চায়ের ব্যবস্থা তাদের নৌকাতেও আছে। বললাম, এই নৌকায় কি চয়ের ব্যবস্থা আছে?
নৌকার মাঝি বললো, চুলা আনা হয়নি। সাথে সাথে আমাদের সাথে আসা একটি নৌকা থেকে চুলা তুলে নিলাম। টিনের তৈরি লাকড়ির চুলা। এক বোঝা লাকড়ি নিলাম। ট্রলার থেকে একটি পাতিল নেওয়া হলো। নেওয়া হলো কয়েক বোতল পানি।
জামাল মেম্বার উসখুস করছেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বড় খালে ভাটা লেগে গেছে। এখন এই খাল দিয়ে ওই পাশে যাওয়া অসম্ভব। কাবীর বললো, ঠেলেঠুলে চলে যেতে পারবো। আমি বললাম, এই খালে চলাফেরার অভিজ্ঞতা আমারও আছে। ভাটা হয়েছে আধা ঘন্টা হলো। আমরা মাঝপথে গিয়ে আটকা পড়বো মনে হচ্ছে। বলেই লাফ দিয়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। আমাদের নৌকাটি থাকবে পরে। সামনে থাকবে দস্যুদেরটি। দ্রুত সবাই উঠে পড়লো। চলতে শুরু করলাম চিপার খাল ধরে বনের আরও গহীনে।
চলতে চলতে বনদস্যুদের বললাম, দুইজন অস্ত্রধারী এই নৌকায় আসো। রাতের বেলা বাঘের ভয় বেশি। ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। ওদের নৌকার পাশে ভিড়লাম। দুই জন এসে বসলো আমাদের নৌকার সামনে ও পিছনে। বৈঠা ধরলো তারাও। পরের আধা ঘন্টা কোনো কথা নাই। শুধু বইঠা বাওয়ার শব্দ। তরতর করে এগিয়ে চলছে দুটি নৌকা। অন্ধকারে কিছু দেখছি না।
হঠাৎ সামনের নৌকার সবাই হৈ হৈ করে উঠলো। বুকের ভিতরটা ধক করে উঠলো আমার। দেখতে দেখতে আমাদের নৌকা গিয়ে ধাক্কা খেলো দস্যুদের নৌকার সাথে। কোনো রকমে বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম। কিন্তু ধাক্কা খেয়ে আমাদের নৌকাটি ক্ষতিগ্রস্ত হলো। তলা ফেটে গেলো বেশ খানিকটা। তাকিয়ে দেখি সামনের নৌকা থেকে কয়েকজন কাঁদার উপর পড়ে গেছে। পানির নিচে একটি গাছের ডালে ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তারা। এই খালটি এমনই। বললাম, জোরে চালানোর দরকার নাই। প্রয়োজনে পরের জোয়ারে যাবো।
দুটি নৌকা চলছে পাশাপাশি। টর্চ জ্বালিয়ে এগুচ্ছি আমরা। দুই নৌকা মিলে ১২/১৩ জন মানুষ। কেউ কথা বলছে না। বললাম, এতো দুশ্চিন্তার কী আছে? আমরা তো তোমাদের কাছে পৌঁছে গেছি। এখন যেকোনো ভাবে মরাপশুরের ভাড়ানীতে গেলেই হবে। কাবীর বললো, নির্দিষ্ট সময়ে যেতে না পারলে ওরা টেনশন করবে। সময় না মিললে ওরা বর্তমান খাল ছেড়ে অন্য খালে চলে যাবে। তখন আর কেউ কাউকে খুঁজে পাবো না।
নান্না বললো, এদিকে ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। বললাম, গাছে উঠলেও পাওয়া যাবে না? বললো, তা পাওয়া যাবে। কিন্তু ওদেরও তো নেট এ থাকতে হবে। বললাম, এতো দুশ্চিন্তার দরকার নাই। আজকে না হলে কাল দেখা হবে। আমরাও না হয় কাল পুরো দিন ডাকাতদের মতো করে কোনো ছোট খালের আগায় উঠে বসে থাকবো। সবাই হেসে দিলো। বললাম, আমি চলে আসছি যখন, আর চিন্তা করো না। ঠান্ডা মাথায় বৈঠা বাও।
ছোট একটি টর্চ জ্বালিয়ে পথ দেখাচ্ছি আমি। এভাবে আরও মিনিট পনেরো চললাম। কিন্তু তার পর? দুই পাশের বন এখানে কাছে চলে এসেছে। মানে চিপা’র থাল এখানে অনেকটা সরু। সামনে দস্যুদের নৌকাটি গেলো। পিছনে পিছনে এগুচ্ছি আমরা। তবে কিছুক্ষণের মধ্যে নৌকা ঢেকে গেলো কাঁদায়। সবাই মিলে নেমে পড়লো। কাঁদার ওপর দিয়ে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে নৌকাগুলো। এভাবে আরও আধা ঘন্টা চলার পর সবাই হয়রান হয়ে পড়লো। বললাম, সুবিধাজনক জায়গা দেখে বিরতি নিবো।
নৌকাসহ আমরা আটকে রইলাম কাঁদার উপর। কিছুই করার নাই। রাত তখন প্রায় তিনটা। অন্ধকারে নৌকার ওপর বসেই আড্ডা শুরু হল। পরিবেশ হাল্কা রাখতে এর বিকল্প নাই। আমার সঙ্গী মেহেদী মিরাজ ও বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামিন আলী একটু দুশ্চিন্তায়। সম্ভবত বাঘের হামলার শংকা করছেন তাঁরা। এদিকে বেড়ে পোকার উপদ্রপ বেড়ে গেছে। শরীরের খালি জায়গাগুলোতে আক্রমণ করেছে শত শত, হাজার হাজার বেড়ে পোকা। বললাম, বাঘের বিষয়টি পরে দেখবো। আগে এই পোকার কামড় থেকে বাঁচাও।
একটি বাঘ নাকী এপাশে ঘোরাঘুরি করছে কয়েক দিন ধরে। তাই পুরোটা সময় আমাদের চারপাশে বন্দুক নিয়ে সতর্ক ছিল দস্যুরা। বেড়ে পোকার কামড় থেকে বাঁচতে জ্বালানো হলো মশার কয়েল। জ্বললো চুলা। কড়া করে এক কাপ চা খাবো সবাই মিলে। তারপর আবারও ছুটবো চিপার খাল ধরে মরাপশুরের উদ্দেশ্যে। দিনের আলো ফোটার আগে যে করেই হোক বনদস্যুদের ডেরায় পৌঁছাতে হবে। সাগর বাহিনীর মূল নৌকাগুলো অপেক্ষা করছে মরাপশুরের ভাড়ানীর কোনো এক সরু খালে।
(ছবিটি মরাপশুরের ভাড়ানীতে তোলা। এই খালটিও চিপার খালের মতো সরু। অক্টোবর ২০১৬)