রূপান্তরের গল্প ২৩৩ | Rupantorer Golpo 233

বনদস্যুদের ডেরায় দম বন্ধ করা পরিবেশ | রূপান্তরের গল্প ২৩৩

বনদস্যুদের ডেরায় দম বন্ধ করা পরিবেশ | রূপান্তরের গল্প ২৩৩ | Rupantorer Golpo 233 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৩৩ : নিরস্ত্র কয়েকজন বনদস্যু হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় আতঙ্ক। মনে হচ্ছিলো যেকোনো সময় দৌড়ে পালাবে। কিন্তু পালিয়ে তারা বাঁচতে পারবে? ওই যুবকেরা সকলেই শহরের বাসিন্দা। জঙ্গলে হারিয়ে গেলে বাঘে খেয়ে ফেলবে। এদিকে এমনিতে বাঘের চাপ বেশি।

এমনিতে পুরো বন ভর্তি প্রতিবন্ধকতার শেষ নাই। গাছের গোঁড়ায় গোঁড়ায় কেউটে সাপ। খাওয়ার পানি নাই। লবণ পানির মধ্যে ওরা টিকতেও পারবে না। এই পরিবেশে আমাকে ছেড়ে দিলেও বেঁচে থাকতে পারবো বলে মনে হয় না।

খুলনার ওই যুবকদের কাছে গেলাম। কাঁধে হাত রেখে বললাম, তোমরা কোনো দুশ্চিন্তা করবে না। তোমরা দস্যু হয়ে গেছো এই কথা যদি এখনও কেউ না জানে তবে নিশ্চিন্তে থাকো। আমি কাউকে বলবো না। পৃথিবীর কেউ জানবে না। তোমাদের নিরাপদে পৌঁছে দিবো আমি নিজে। তবে শর্ত একটাই। ভবিষ্যতে আর এই পথে আসবে না।

ওদের মধ্যে একটু নরম সরম একটি ছেলে আছে। কেঁদে দিলো সে। বললো, আমাদের অন্য কথা বলে এখানে পাঠিয়েছে ভাই। বলছিলো জঙ্গলে সবকিছু আছে। থাকা খাওয়ার কোনো সমস্যা নাই। মাস শেষে কুড়ি হাজার টাকা পারো। কিন্তু এই জঙ্গলে এসে দেখি সেই কথার সাথে কোনো কিছুর মিল নাই।

পাশ থেকে নেতা গোছের ছেলেটি ওকে চোখ দিয়ে থামার ইশারা করলো। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এতো কথার দরকার নাই। আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন।

ছেলেটিকে বললাম, সবাইকে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিবো। তবে তোমাকে এখানে বেঁধে রাখবো। আসলে ভয় দেখানোর জন্য কথাগুলো বলা। দেখলাম এই ছেলেটি ভাবলেশহীন। বাঁকী তিনজন মানষিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে।

চারজন যুবকের প্রত্যেকের চেহারার দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছি ওদের মনের অবস্থা। এর আগে তাদের অস্ত্রগুলো কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এবার ওদের পকেট হাতড়ে ফোনগুলোও নিয়ে নিলো দস্যুরা।

সাগর বাহিনীর একজন বললো, উঠিয়ে দেওয়ার সময় ফোনগুলো দিয়ে দিবো। না হলে আপনি যাওয়ার পর এরা আমাদের ধরিয়ে দিবে, আক্রমণ করবে। বললাম, এই বিষয়গুলো আগে ভাবোনি তোমরা? আমি আসার আগে এদের ফেরত পাঠানো উচিৎ ছিলো। এখন তোমাদের আত্মসমর্পণের পরিকল্পনার কথা ওরা জেনে গেলো।

কে জানে? আমরা যে এখানে আছি সেই খবরও নিশ্চয়ই ওরা দিয়েছে কাউকে। হাতে ফোন আছে। নেটওয়ার্ক কোথায় পাওয়া যায় জানে ওরা। হয়তো কাউকে জানিয়েও দিয়েছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মনের ভিতরে টান দিলো। ওরা যদি কাউকে আমাদের কথা, আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়ে দেয় তবে নিশ্চিত ভাবে এখানে অভিযান চলবে। সেটি হতে পারে কোনো আইন শৃংখলা বাহিনী, হতে পারে অন্য কোনো দস্যুদল।

ভাবনাটি মাথায় রাখলাম। দস্যুনেতাকে বললাম, এদের চারজনকে নজরবন্দী রাখেন। আমরা চলে যাওয়ার পর ওদের বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। আর এর মধ্যে কেউ যাতে পালাতে না পারে সেদিকে সবচেয়ে বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। ওরা বললো, পালায়ে গেলে যাক। এখানে বাঘের চাপ অনেক বেশি। বাঘে খেয়ে ফেলবে। বললাম, বাঘে তাকে খাবে। কিন্তু কিছু মানুষ তো জানে ওরা তোমাদের এখানে আছে। ঠিকঠাক বাড়ি না ফিরলে তখন কিন্তু মার্ডার কেস খাবে। আমি এখন জঙ্গলে আছি। দেখবে আমার নামেও মামলা হয়ে যাবে।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। ভাটা শেষ হয়ে আবার জোয়ার শুরু হলো। অবশ্য আমরা যেখানে আছি সেই জায়গা পর্যন্ত জোয়ারের পানি উঠতে সময় লাগবে। তার আগে আমাদের কাজগুলো শেষ করে নিতে হবে।

সবাইকে ডেকে নিয়ে বনের ভিতরে নামলাম। হেঁটে হেঁটে সাক্ষাৎকার নিলাম। টেলিভিশন সংবাদ প্রচারের জন্য বিস্তারিত কাজ করলাম। ঘন্টা দুই-এর মধ্যে শ্যুটিং শেষ করে ফিরলাম নৌকা বহরে। তখনও সরু খালে পানি ভরেনি।

সন্দেহভাজন ওই চারজন যুবকের বিষয়ে আবারও কথা বলে নিলাম। সবাইকে সতর্ক থাকতে বললাম আবারও। বললাম, আপনাদের সোর্সদের সাথে যোগাযোগ করেন। দেখেন কোনো আইন শৃংখলা বাহিনী আজ এদিকে আসে কী না। ওরা বললো, এদিকে আর অভিযান দিবে RAB? বললাম, আমি অভিযানের গন্ধ পাচ্ছি।

গোলাগুলি হলে, অভিযান হলে আমি পালাতে পারবো। কিন্তু আমার সহকর্মীদের সেই অভ্যাস নাই। সুন্দরবনে নতুন তারা। ওদের সতর্ক থাকতে বললাম। তবে বিস্তারিত জানাইনি, ভয় পেয়ে যেতে পারে। ওদের নৌকায় রেখে খালের গোঁড়ার দিকে হাঁটা দিলাম।

মরাপশুরের ভাড়ানী খালটি ছোট হলেও পানির চাপ খুব বেশি। জোয়ার আর ভাটায় অনেক স্রোত থাকে এখানে! গোনের সময় পানিও ওঠে অনেকটুকু। খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে দুই পাশে ভালো করে খেয়াল করলাম। পাহাড়ায় থাকা দস্যুদের বললাম, ঝাপসির এদিক থেকে প্রশাসনের আসার সম্ভাবনা আছে। তোমরা ভালো করে খেয়াল রাখো। মনে রাখবে, উত্তরের দিকটা খেয়াল রাখবে। দক্ষিণ দিকে মরাপশুর খাল। ওদিক দিয়ে আসলে শুধু বন বিভাগের লোকজন আসতে পারে। অন্য কেউ আসবে না।

হঠাৎ চুপ করতে বললো একজন। কান খাড়া করে কয়েক সেকেন্ড কিছু বুঝার চেষ্টা করলো। ফিসফিস করে বললো, নৌকা আসছে। জানতে চাইলাম কোন দিক থেকে? বললো, দক্ষিণ দিক থেকে। আমি বললাম, তাহলে দুশ্চিন্তার কিছু নাই, আসুক।

চুপ করে অপেক্ষা করছি আমরা। নৌকায় যারা আছে তারা বেশ গল্প করতে করতে আসছে। ধীরে ধীরে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বললাম, এভাবে কথাবার্তা শব্দ করে অভিযানে আসবে না কেউ।

কান খাড়া করে বুঝতে চাইছি। খবির মামার গলা কানে আসলো। আরেকটু পর দেখতে পেলাম তাদের। নৌকা বেয়ে এগিয়ে আসছেন খবির মামা, সাথে আরও দু্ইজন।

নৌকা ভিড়লো সামনে। দেখি খোলের ভিতরে বেশ কয়েকটি দাতিনা, পায়রা আর ভেটকী মাছ। আছে অনেকগুলো বড় বড় চিংড়ি মাছ। খালপাটার মাছ। খবির মামা বললেন, মাছ আরও ছিলো। কিন্তু ভরা গোন বলে পানি পুরোটা নামেনি। খালের পানি না নামলে হয়? যেটুকু হাত দিয়ে ধরা গেলো সেগুলো নিয়ে রওনা দিলাম মামা। মাছ না আনলে তো আজ আর খাওয়া হবে না আমাদের। বললাম, আপনাদের নিয়ে টেনশনে ছিলাম। এখন খালের ভিতরে ঢোকেন। নৌকা এখানে রাখা যাবে না।

জঙ্গলে দস্যুদলের সাথে দেখা করতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়বো ভাবিনি। এই সফরের শুরু থেকে প্রতিবন্ধকতার শেষ ছিলো না। খবির মামা ও তার সহযোগীরা কাঁদার ওপর দিয়ে নৌকা ঠেলে এগুচ্ছেন। পাশ দিয়ে হাঁটছি আমরা। ভাবছি, আমার কাজ শেষ। এখানে এখন দম বন্ধ করা পরিবেশ। এদের সাথে বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top