বুক ধকধক করছে, নৌকা চলছে | রূপান্তরের গল্প ২৩৬ | Rupantorer Golpo 236 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৩৬ : বুকের ভিতরটা ধকধক করছে। নিজেকে এতো বিপন্ন লাগেনি কখনও। এর আগে গোলাগুলির মধ্যে পড়েও নিজেদের শক্ত রেখেছিলাম। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণে নাই।
অন্ধকার, বৈরী আবহাওয়া, ছোট্ট ভাঙ্গা ডিঙ্গি নৌকা আমাদের চলার পথকে কঠিন করেছে। তার ওপর সামনে আইন শৃংখলা বাহিনীর অবস্থান এই যাত্রাকে করেছে ভয়ঙ্কর ঝুঁকিপূর্ণ। দিনের বেলা হলে দূর থেকে নিজেদের পরিচয়টুকু দেওয়ার সুযোগ থাকতো। কিন্তু এই অন্ধকারে তা সম্ভব না। এছাড়া ওরা এসেছে বনদস্যুদের ধরতে।
আমরা নৌকায় ছয়জন। সুন্দরবনে ডিঙ্গি নৌকায় দুই বা তিনজনের বেশি মানুষ মানেই সন্দেহজনক। এভাবে শুধু দস্যুরাই চলাফেরা করে। অন্যান্য সফরে সাথে বেলায়েত সরদার ও আমার পুরনো সহযাত্রীরা থাকেন। তখন সাহস পাই। যুক্তি-বুদ্ধি করে বিকল্প কোনো পথ বের করা যায় তখন। কিন্তু এখন এসব ভেবে কাজ নাই।
সামনের পথটুকু আমাদের পারি দিতে হবে। তা না হলে রাত কাটাতে হবে জঙ্গলের ওপর। ভাটা হয়ে গেলে এখানেই আটকে থাকতে হবে। হয়তো বাঘ মামার সামনেও পড়তে হবে।
সামনে চিপা’র খালের দোয়া। জায়গাটি বেশ প্রশস্ত। তিন খালের মিলন স্থল। এই দোয়া’র দক্ষিণে মরাপশুর খাল। পশ্চিমে ঝাপসির ভারানি, উত্তরে চিপা’র খাল। জোংড়া খাল থেকে ঝাপসির খালে বের হওয়া যায় বলে চিপার খালকে ভারানিও বলা হয়। এখন আমরা দোয়ায় উঠবো। উঠেই ঢুকে পড়বো উত্তর দিকে চিপা’র খালে। কিন্তু মনের ভিতরে সাহস সঞ্চয় করতে পারছি না।
পিছনে বসা মাঝি বললেন, চলেন মামা। সমস্যা হবেনানে। প্রশাসন আপনাদের কিছু বলবেনা। বললাম, গুলি কাউকে চিনবে না মামা। একটু দাঁড়ান। বুঝেশুনে সামনে আগাবো। মাঝি বললেন, বুঝতে বেশি সময় নিয়েন না মামা। জোয়ার কিন্তু শেষ। চিপার খালে ঢুকতে দেরি করলে মাঝপথে আটকা পড়তে হবে। এই খাল কিন্তু ভালো না। একজন বাঘ মামা কিন্তু সারা বছর এখানেই ঘোরাফেরা করে!
সন্ধ্যা থেকে ভয় পেতে পেতে মনে হচ্ছে মনের ভিতরে ভয় পাওয়ার আর জায়গা নাই। তবুও শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছি। এসময় হুট করে সিগারেট ধরিয়ে বসলেন আমাদের মাঝি। কী আশ্চর্য! বললাম, আমরা লুকিয়ে যাচ্ছি আপনি বুঝতে পারেননি এখন? এই সময়ে আগুন জ্বালালেন কী করে? ওরা দেখে ফেলবে না? সাথে সাথে সিগাটের ফেলে দিলেন পানিতে। বললেন, টেনশনে খেয়াল ছিলো না মামা। বললাম, টেনশন সব আমাকে দেন। আপনারা শুধু মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে যান।
সামনে থেকে মানুষের কথাবার্তার শব্দ পাচ্ছি। বুঝতে পারছি জঙ্গলে অনভ্যস্ত তাঁরা। অভিযান চালাতে এসেছেন কিন্তু বনের ভিতরে কথাবার্তা বললে যে অনেক দূর থেকে শোনা যায় জানেন না। ট্রলারের বাসিন্দাদের শব্দে আগেই সতর্ক হয়েছি। এবার গাছের আড়ালে বসে তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলাম।
ঝাপসির দিক থেকে আসতে শেষের খালের ভিতরে ঢুকানো প্রশাসনের ট্রলার। তবে পুরোটা ঢোকেনি। পিছনের দিকটা বের হয়ে আছে। সম্ভবত পুরোটা খালের ভিতরে ঢোকেনি অথবা পানির চাপে সরে এসেছে। পিছনের ছাউনির উপর বসে কেউ একজন সিগারেট খাচ্ছে। তার মানে ওরা প্রস্তুত না!
এখনই সুযোগ। বের হতে হবে। সবাই শক্ত হয়ে বসলাম। বৈঠা ধরলেন দুইজন। দেখতে দেখতে চিপা’র দোয়া অর্থাৎ তিন খালের মোহনায় আসলাম। বেরিয়েই উত্তরে ছুটলো নৌকা। হাতে বাওয়া নৌকার এমন দ্রুত গতিতে ছুটে চলা অবিশ্বাস্য। বসে বসে ভাবছি, এই যাত্রায় বোধ হয় বেঁচে গেলাম।
খাল ধরে উত্তরে এগুচ্ছে আমাদের নৌকা। শব্দ বলতে পানিতে বৈঠার শব্দ তালে তালে চলছে। দুই মাথার দুইজনের হাঁপিয়ে উঠেছেন। হুহ হুহ করে শব্দ বেরিয়ে আসছে তাদের ভিতর থেকে। আরেকটু এগিয়ে পাঁচ মিনিটের বিরতি নিলাম। পানি আর বিস্কিট খেয়ে আবার রওনা দিলাম। নৌকার ফাটলটি বড় হয়েছে। গলগল করে পানি ঢুকছে। থালা হাতে অবিরত পানি সেঁচছে নৌকার সহকারি কিশোরটি।
যতোই সামনে আগাচ্ছি খাল ততোই সরু হচ্ছে। সামনে খাল আরও সরু হয়ে এসেছে। বন্যা জোয়ার বলে খাল আর জঙ্গল এক হয়ে আছে। পথ ভুল করার সম্ভাবনা থাকে। তবে আমাদের মাঝি এই জায়গায় মাছ ধরেন। এদিকের পথঘাট ভালো চিনেন। RAB-এর ধাওয়া খাওয়ার বিপদ কেটেছে। মনটা এখন বেশ ফুরফুরে। এই সরু খালটি পেরিয়ে গেলেই জোংড়া খাল। সেখানে আমাদের ট্রলার রাখা।
সুন্দরবনে যে কাজ নিয়ে নেমেছি তাতে ঝুঁকি থাকবে। মৃত্যু ঝুঁকি আছে পদে পদে। এসব জেনেই নেমেছি। কারণ কাজটি শেষ করতে পারলে লাখ লাখ মানুষের জীবন নিরাপদ হবে।
এই অঞ্চলটি অভয়াশ্রম। মানে যে কারও প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু এখানে মানূষ ছাড়া কোনো জায়গা নাই। খালে খালে জেলেরা মাছ ধরছে। এই অঞ্চলে শিকারীরাও নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে। বিষ দিয়ে মাছ শিকার চলে নির্বিচারে।
পাশেই ঝাপসি খাল। অভয়াশ্রমের কেন্দ্রে এর অবস্থান। সেখানে বন বিভাগের একটি টহল ফাঁড়ি ছিলো। কয়েক বছর আগে দস্যুদের ভয়ে সেটি বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। তার আগে ও পরে এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করে বনদস্যুরা।
দস্যুদের সাথে সমঝোতা করে, চাঁদা দিয়ে এখানে মাছ ধরে জেলেরা। বনরক্ষীদের কিছু করার নাই। বনদস্যুদের দাপট এতো বেশি যে জীবন, অস্ত্র ও সম্মান নিয়ে টিকে থাকতে পারলেই খুশি বনরক্ষীরা।
সুন্দরবনের সুরক্ষার প্রধান দায়িত্ব বন বিভাগের। তাদের সামনে দিয়ে চলে বন ধ্বংসের মহাযজ্ঞ। বনদস্যুদের কারণে সুন্দরবনের আরও বেশ কয়েকটি জায়গা থেকে টহল ফাঁড়ি উঠিয়ে নিয়েছে বন বিভাগ।
হঠাৎ করে ধাক্কা খেলাম। নৌকার তলায় গাছ পড়েছে। ভাগ্যিস গতি কম ছিলো। নৌকাটি সাথে সাথে নামিয়ে আবার এগুতে থাকলাম। বললাম, ধীরে ধীরে আগান। মাঝি বললেন, এখন আর ধীরে যাওয়ার সময় নাই।
ভাটা হয়ে গেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে সামনের জায়গা পার হতে না পারলে আবার আটকা পড়বো। নৌকার তলা ঠেকলে আর আগানো যাবে না মামা। ঠেকলে কাঁদায় নেমে নৌকা ঠেলতে হবে। আপনাদের নৌকায় রেখে দুইজনে ঠেলে পারবো না।
বললাম, নৌকা ঠেকলে সবাই নেমে পড়বো। কষ্ট হলেও পারবো, অভ্যাস আছে আমার। সহযাত্রীদের মধ্যে ইয়ামীন ভাইকে নিয়ে দুশ্চিন্তা নাই। এদিকের মানুষ। জঙ্গল আর কাঁদায় নৌকা ঠেলার অভ্যাস আছে। কিন্তু আরেক সহকর্মীর সেই অভ্যাস নাই।
বয়সে তরুণ মিরাজের বাড়ি খুলনা হলেও জঙ্গলের বিপদ-আপদ সম্পর্কে ধারণা নাই। তাই এই মহা বিপদের মধ্যেও বেশ ফুর্তিতে আছে। মিরাজকে বললাম, সামনে গিয়ে নামতে হবে কিন্তু। সে বললো, কোনো অসুবিধা নাই ভাই, সাঁতার জানি। বললাম, কাঁদার মধ্যে সাঁতার কাটবে?
ছপাৎ ছপাৎ করে বৈঠার বাড়ি পড়লে পানিতে। এখন চিপা’র খালটি একদম চিপা হয়ে গেছে। পানির নিজের গাছপালার সাথে ধাক্কা খেতে খেতে এগুচ্ছি আমরা। গল্পে গল্পে দুশ্চিন্তা কমানোর চেষ্টা করছি। আধা ঘন্টা পার করে ফেলেছি এই খালে। সামনের ঘন্টা খানেক এভাবেই চলতে হবে। তারপর খালটি প্রশস্ত। আরও আধা ঘন্টা চলার পর পড়বে জোংড়া।
এই খালে অনেক বার এসেছি। এখান থেকে হরিণের ডাক শোনা যায়। গুইসাপ, সাপ, বানর আর নানা জাতের পাখির চলাফেরার শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু এই মুহুর্তে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ নাই। অনেক ক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছি।
কান পেতে বন্যপ্রাণিদের চলাফেরার শব্দ খুঁজছি। কিন্তু এদিকটায় সুন্দরবন একদম চুপ, অনেকটা মৃত্যুপুরির মতো লাগছে। আশেপাশে নতুন কোনো বিপদ নাই তো? বুকের ভিতরটা আবার ধকধক করতে লাগলো।
(ছবি: রাতের সুন্দরবনে জেলে নৌকা)