ফেরার পথে সরদারের আপ্যায়ন | রূপান্তরের গল্প ২৩৯ | Rupantorer Golpo 239 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৩৯ : তাড়া খেতে খেতে হয়রান হয়ে গেলাম। RAB-এর তাড়া, বাঘের তাড়া খেয়ে কোনো রকমে বের হলাম। বড় নদীতে এসে খেলাম বনরক্ষীদের তাড়া। সুন্দরবনে দস্যুদের সাথে দেখা করতে আসলে তাড়ার ওপর থাকি। কষ্ট হয়, আবার উপভোগও করি। তাড়া করা কাউকে বিভ্রান্ত করে পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে উত্তেজনা আছে। ভালোই লাগে যখন সফল হই। সুন্দরবনে চুরি করে যাওয়া-আসার প্রশিক্ষণটা ভালোই হয়েছে।
সহযাত্রী জামাল মেম্বার বললেন, ফরেস্ট ধরলে সমস্যা কী? বললাম, সমস্যা আছে ভাই। আমি যা করছি তা আইনসম্মত না। তবুও করছি, কারণ সুন্দরবনের দস্যুমুক্তির যাত্রা থামানো যাবে না। কয়েকটি দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করিয়ে নাম কামানো আমার উদ্দেশ্য না। আমি চাই পুরো সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হোক। কাজটি সহজ না। তবে এখন এসে বুঝতে পারছি যে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা অসম্ভব না।
ট্রলার নিয়ে পশুর নদী অতিক্রম করেছি। জোংড়া খালের বিপরীতে জয়মনির কাছাকাছি এসে উত্তরের পথ ধরলাম। আমাদের ধাওয়া করা বন বিভাগের ট্রলার ফিরে গেছে। এদিকটায় লোকালয় বলে আমাদের আর কেউ ধরতে আসবে না। এছাড়া গভীর রাতে ঝামেলায় যায় না বনরক্ষীরা। পাশ থেকে আমাদের নৌকার মাঝি বললেন, সেই জন্য আমরা বলি, এই সুন্দরবন দিনের বেলা চালায় প্রশাসন আর রাতের বেলা চালায় চোর-ডাকাতেরা।
বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনের আয়তন ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার। নদী, সাগর আর এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলকে পাহারা দেওয়া সহজ কাজ না। বন বিভাগের সীমিত জনবল ও জলযান দিয়ে সুন্দরবনকে নিশ্ছিদ্র করা সম্ভব না। অর্থনৈতিক ভাবে দেশ এগিয়েছে। সুন্দরবনকে গুরুত্বও দেওয়া হয় শুনি। তারপরও বন রক্ষায় কেন এতো গাফিলতি, বুঝি না।
পশুর নদীতে ভাটার পানি নামছে তীব্র গতিতে। তাই জয়মনিরঘোল থেকে উত্তর দিকে যেতে সময় লাগছে। উত্তরে চিলা বাজার। সেখানেই যাবো আপাতত। বেলায়েত সরদার দলবলসহ অপেক্ষা করছেন।
চিলা পৌঁছাতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। রাত বাজে তিনটার মতো। শেষ ভাটায় চর জেগে গেছে। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই আটকে গেলো ট্রলার। আবার জোয়ার আসার আগে নড়তে পারবো না।
ট্রলাররের পিছনে বাঁধা নৌকায় চড়ে বসলাম। পানি সেঁচতে সেঁচতে নৌকা চললো। চিলা খালে ঢুকলাম। বাজারের ঘাটে ভিড়লো নৌকা। পাশেই বেলায়েত সরদারের ট্রলার। রান্নাঘরে আলো জ্বলছে। সামনে বসে মন দিয়ে রান্না করছেন ক্যাপ্টেন সরদার। তাঁকে সহযোগিতা করছে মামুন।
নৌকা নিয়ে এসেছি বলে প্রথমে টের পায়নি ওরা। নৌকা থেকে নেমে ট্রলারে উঠে ভড়কে দিলাম ওদের। আমাদের দেখে হাসতে হাসতে শেষ বেলায়েত সরদার। বললেন, ও ভাই কী অবস্থা আপনাদের? চেহারার এই অবস্থা কেন?
ভাত, ডিম ভাজি আর ডাল রান্না হয়েছে। এখন শুকনা মরিচ ভাজা চলছে। পেঁয়াজ মরিচের ভর্তা হবে। বললাম, চেহারা এমন কেন বলবো। তার আগে খেয়ে নেই। সেই বিকাল বেলা ভাত খেয়েছি। তারপর থেকে তাড়ার ওপর আছি।
ভরপেট খেয়ে নিলাম। তারপর পশুর নদীতে রেখে আসা ট্রলারে যারা আছে তাদের জন্য খাবার পাঠালাম। খাওয়া দাওয়া শেষে ডাঙ্গায় নামলাম। চিলা বাজারে সুনশান নিরবতা। সহযাত্রী জামাল মেম্বার বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে বললেন, বনদস্যু সাগর বাহিনীকে দ্রুত আত্মসমর্পণ করানোর ব্যবস্থা করবেন। দেরি হলে সবকিছু ভেস্তে যেতে পারে।
চিলা বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে একটি চায়ের দোকান আছে। শহীদুল কাকুর দোকান। ওই রাতেই ডেকে তুললাম। চা জ্বালানো হলো। এদিকে ফজরের আযান দিলো। চা খেতে খেতে গত দুই দিনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা বললাম। সরদারর বললেন, সাগর বাহিনী নিয়ে লোকালয়ে তোলপাড় চলছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সরা পাগল হয়ে গেছে।
জানতে চাইলাম, আমাদের বনের ভিতরে যাওয়ার খবর পেয়েছে তারা? সরদার বললেন, স্যারেরা সোর্সদের বলেছেন যে সাংবাদিক সুন্দরবনে গেছে। সোর্সরা খোঁজ নিয়ে দেখে আমি বাড়ি আছি। এসে দেখে আমিও আছি, ট্রলারও আছে। তারপর ফিরতি রিপোর্ট দিয়েছে তারা। আমি বললাম, প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করতেই আপনাকে রেখে গেছি। কৌশল কাজে লেগেছে। বললাম, ট্রলার রেডি করে রাখবেন। আমি ঢাকা ফিরবো আজ। ওদিকে কথাবার্তা বলে সাগর বাহিনীর সারেন্ডারের দিন-ক্ষণ চূড়ান্ত করবো।
সাগর বাহিনীতে নাকি আমাদের হাসান আছে? বেলায়েত সরাদারের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, শুধু হাসান না, কামরুলও আছে। সরদার বললেন, কোন কামরুল? বললাম, বিষ কামরুল! এই কামরুলের নামে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগ আছে। সেজন্য তার নাম এলাকায় বিষ কামরুল। সরদারকে বললাম, নতুন এই ডাকাত দলের সদস্যদের সবাইকে চিনবেন, ওরা সকলেই আপনার প্রতিবেশি।
সাহর বাহিনীর ওপর এই অঞ্চলের মানুষ খুব রেগে আছে। পশুর নদী ও আশেপাশের সুন্দরবনে হামলা চালিয়ে অনেক জেলেকে জিম্মি করেছে তারা। মুক্তিপণ নিতে ছাড়েনি। সরদারের আত্মীয় স্বজনদের অনেকই সাগর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়েছে গত দুই মাসে। সরদারও খুব ক্ষিপ্ত। বললেন, তাড়াতাড়ি ওদের উঠায়ে আনেন। তা না হলে গ্রামের লোকজন জঙ্গলে নেমে অভিযান দিবে। ওরা কিন্তু গণপিটুনিতে মরবে। বললাম, ঢাকা ফিরেই সব ঠিক করে ফিরে আসবো। সে পর্যন্ত চুপচাপ থাকবেন। সতর্ক থাকবেন। কেউ যাতে আপনাকে বেকায়দায় ফেলতে না পারে, খেয়াল রাখবেন।
বেলায়েত সরদারের সাথে আমার সম্পর্ক বিশ্বাসের। তার সাথে সব কথা বলা যায়। সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়ায় তিনি সবচেয়ে ঘনিষ্ট সহযোগি। সেজন্য তার অবশ্য সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। এদিকের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো তাকে ভালো চোখে দেখে না। বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীরাও ক্ষিপ্ত তার ওপর। সরদারকে বললাম, শত্রু বেড়ে যাচ্ছে। সতর্ক থাকবেন।
এদিকে জোয়ার হয়ে গেছে পশুর নদীতে। খবির মামার ট্রলার ভেসেছে। ওই ট্রলারেই আমাদের ব্যাগবোচকা রাখা। ভোর বেলা বলে লোকজন নাই ঘাটে। সরদার বললেন, লোকজন দেখার আগে বিদায় নেন। জানাজানি হলে আমার ওপর চাপ আসবে। বললাম, জানি। চাপ আসলে জানাবেন। আমি পাশে আছি, চিন্তা করবেন না। বলতে বলতে উনি নিজেও ট্রলারে উঠে বসলেন।
জোয়ার ছিলো বলে মংলায় পৌঁছাতে সময় লাগলো আধা ঘন্টা। ট্রলার থেকে ব্যাগগুলো নামিয়ে গাড়িতে তুলে দিলেন সবাই মিলে। ক্যামেরার ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে সরদার জিজ্ঞেস করলেন, ক্যামেরার সাথে লাইট ছিলো না? বললাম, ছিলো তো! উনি বললেন, তাহলে চিপা’র খালে ওটা জ্বালালেই পারতেন! বললাম, দুশ্চিন্তায় মাথায় আসেনি এই লাইটের কথা!
গল্প করতে করতে গাড়িতে উঠে বসলাম। ঢাকা ফিরে পরদিনই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেখা করবো। দিন তারিখ ঠিক করবে RAB। তারপরই ফিরে আসবো সুন্দরবনে। দস্যুদল সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে।