জেলেরা খুশি, বেজার মহাজন | রূপান্তরের গল্প ২৪৫ | Rupantorer Golpo 245 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪৫ : সুন্দরবনের জোংড়া খালে গত কয়েক ঘন্টার অভিযানটি ছিলো দম বন্ধ করা। অন্য ভাবে বললে এই আত্মসমর্পণ দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের পথে আরেক ধাপ। নানা প্রতিকূলতা সামনে এসেছে। তবে প্রতিটি বাধা অতিক্রম করে বনদস্যু সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষক, সুবিধাভোগীদের কিছু বার্তা দিতে চাই। একই সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যাঁরা বিভ্রান্তিতে ভুগছেন তাঁদের ভুলগুলোও ভাঙ্গাতে চাই। মূল বিষয়, কেউ যেন বুঝে কিংবা না বুঝে বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকতা না করেন।
RAB-এর ট্রলার ছুটছে পশুর নদী ধরে। কার্তিক মাসের এলোমেলো বাতাস চারপাশে। বনদস্যু সাগর বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। পশুর নদীতে এখন ভাটা চলে। উত্তর থেকে স্রোত দক্ষিণে নামছে। তাই আমরা চলছি ধীর গতিতে।
বনদস্যু সাগর বাহিনীর আত্মসমর্পণ নিয়ে অনাকাঙ্খিত অনেক চাপ নিয়েছি। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের উঠিয়ে আনতে পেরেছি। আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে ষষ্ঠ দস্যু দল।
আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। বনদস্যুরা চলে গেছে RAB-এর হেফাজতে। এর পরের দায়িত্ব তাদের। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত দস্যুদের আত্মসমর্পণে মধ্যস্ততা করেছি আমি। এরপর একজন সাংবাদিক হিসাবে করবো বাকী কাজটুকু। সকালের মধ্যে আমাদের পৌঁছাতে হবে বরগুনায়।
প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। ভোর রাতে পৌঁছালাম মংলায়। সেখানে রাখা RAB-এর গাড়ি বহরে উঠানো হলো দস্যুদের। অস্ত্র-গুলিসহ তাদের নিয়ে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা হলো তারা। আমাদের গাড়িও প্রস্তুত ছিলো মংলা খেয়া ঘাটের পাশে। রওনা হলাম আমরাও।
গাড়িতে উঠে দিলাম ঘুম। আমার ফোন সাইলেন্ট করা। তবে বনদস্যু সাগর বাহিনীর মূল ফোন নাম্বারটি খোলা আছে। ফোনটি আছে RAB-এর কাছে। অন্যদের বিভ্রান্ত করতেই এই কৌশল।
অনেকেই ফোন দিচ্ছে। কিন্তু আমি তো ঘুম আর তন্দ্রার মাঝামাঝি। রাত জাগা। শরীর বিশ্রাম চাচ্ছে। দিনেও আজ কাজ করতে হবে। তাই একটু বিশ্রাম নিচ্ছি। এদিকে খুলনা আর মংলায় তোলপাড় চলছে টের পাইনি।
গাড়িতে বসা মংলার সাংবাদিক, আমাদের সহযোগী নিজাম উদ্দীন আমাকে ডেকে তুললেন। বললেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন জন ফোন দিচ্ছে তাকে। সাগর বাহিনী সুন্দরবন থেকে উঠেছে কী না তা জানতে চাচ্ছে। বললাম, ফোন সাইলেন্ট করে রাখেন।
বাগেরহাট হয়ে পৌঁছালাম পিরোজপুর। সেখান থেকে বেকুটিয়া ফেরি ঘাট। কচা নদী পার হবো ফেরিতে। তবে ফেরি পেতে সময় লাগবে। সারিতে গাড়ি রেখে নামলাম। নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতমুখ ধুয়ে চা বিস্কিট খাবো। এখানে গরুর খাঁটি দুধের চা পাওয়া যায়।
পর পর দুই কাপ চা খেলাম। এবার ফোনের কল তালিকা খুলে দেখলাম মংলার যে কয়জন সোর্স আছে তারা সবাই ফোন দিয়েছে। মংলার বৈদ্যমারীর এক পুরনো সোর্স ফোন দিয়ে বললেন, আপনেরা যা শুরু করলেন, আমাদের সোর্সদের না খেয়ে মরতে হবে। এই ব্যক্তি নিজেও এক সময় শিকার করতেন সুন্দরবনে। ইদানিং মামলার চাপে পড়ে একটু সংযত হয়েছেন। এখন পুরোদমে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সগিরি করেছেন। উনাকে মিথ্যা বললাম।
এদিকে সাগর বাহিনীকে আত্মসমর্পণের দায়িত্ব নেওয়া মংলার সেই সোর্স ফোন দিচ্ছে বার বার। ধরছি না। একই সঙ্গে সে ফোন দিচ্ছে সাগর বাহিনীর ফোন নাম্বারে। ফেরি ঘাটে বসে ফোন ধরে দস্যুনেতা। সেও তাকে মিথ্যা বলে বিভ্রান্ত করে। কাজগুলো পরিকল্পিত ভাবে করা হচ্ছিলো। কারণ একটু সময় পেলেই এই সোর্সরা দস্যুদের পরিবারের কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে।
আলমগীরের সাথে কথা বলে সোর্স নিশ্চিত হয়ে যায় যে সাগর বাহিনী সুন্দরবনেই আছে, সারেন্ডার করছে না। অর্থাৎ ভোর থেকে যে কানাঘুষা চলছে তা সত্য নয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর যাদের সাথে তার যোগাযোগ, তাদের সে নিশ্চিত করে বিষয়টি। বলে, অন্য কোনো দস্যুবাহিনী সারেন্ডার করতে পারে, সাগর বাহিনী নয়। এই খবরে মনে হলো স্বস্তি ফিরলো খুলনা-মংলায়।
ফেরি আসলো। গাড়ি নিয়ে কচা নদী পার হলাম। তারপর ঝালকাঠি হয়ে বরিশাল। সেখান থেকে বরগুনা। লম্বা পথ পারি দিয়ে পৌঁছে গেলাম অনুষ্ঠান স্থলে। পথ গাড়িতে বসে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। বরগুনায় গিয়ে বদলে নিলাম পোশাক। একজন টিভি রিপোর্টার হিসাবে দাঁড়ালাম ক্যামেরার সামনে।
সকাল দশটার খবরে যমুনা টিভিতে ব্রেকিং সংবাদ আসলো। সুন্দরনের দস্যুদল সাগর বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। ২০ অক্টোবর ভোর রাতে তারা এসেছে RAB হেফাজতে। এরপর আমার পাঠানো গত রাতের নিউজটি প্রচার হয়। বরগুনা থেকে সরাসরি সম্প্রচারে দাঁড়ালাম আমি। সকাল দশটার সংবাদ দেখে আবারও উল্টে পাল্টে গেলো বন উপকূলের অবস্থা। সোর্সরা আবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। সেদিন মংলার সব সোর্সদের উপর বেশ ঝড় গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসবেন এগারোটায়। তবে তার আগেই মঞ্চসহ সাজগোজ প্রস্তুত। বরগুনা উপকূলের কয়েক হাজার মানুষ এসেছে এই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান দেখতে। পাথরঘাটা থেকে এসেছেন ট্রলার মালিক ও জেলেরা। এসেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। মঞ্চের পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো আত্মসমর্পণ করতে আসা ১৩ জন বনদস্যু।
বেলা এগারোটায় হেলিকপ্টার আসলো। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নামলেন। যোগ দিলেন অনুষ্ঠানে। সঙ্গে আছেন RAB মহাপরিচালক ও ঊর্ধতন কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানটি বরিশাল বিভাগে হচ্ছে বলে খুলনা বিভাগের কর্মকর্তারা খোঁজ পাননি। এছাড়া সব মিলিয়ে বিষয়টি গোপনও রাখা হয়েছে।
সংস্থাটির গোয়েন্দা প্রধান জানতে চাইলেন, গোপনীয়তার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো? বললাম, আমার কাছে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ গোপন রাখার বিষয় না। কিন্তু কাজ করতে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়ছি, তা মোকাবেলায় গোপনীয়তার বিকল্প নাই। এতে করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু কর্মকর্তাদের সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে। সেই দূরত্ব মিটানোর আপাতত কোনো পথ নাই।
গোয়েন্দা প্রধান বললেন, আপনার কি নিরাপত্তা সংকট আছে? বললাম, আপনি খোঁজ নিয়ে এবিষয়ে আমাকে জানাতে পারেন। আমার সামনে ঝুঁকিগুলো হয়তো পরিস্কার না। তবে প্রচ্ছন্ন ঝুঁকির মধ্য দিয়ে আমি কাজ করছি, এটুকু বুঝতে পারছি।
একে একে ১৩জন বনদস্যু আত্মসমর্পণ করলো। সরাসরি সেই অনুষ্ঠান সম্প্রচার হলো। দস্যুরা জমা দিলো ২০টি অস্ত্র ও প্রায় ৬০০ গুলি। সবাই হাত তালি দিলো। অনেকে বাহবা জানালেন। কিন্তু আত্মসমর্পণের মধ্যস্ততাকারী হিসাবে আমার নামটি বলা হলো না। অবশ্য অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসে ধন্যবাদ জানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
অনুষ্ঠান শেষে দেখা হলো পাথরঘাটা থেকে আসা ট্রলার মালিকদের সাথে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন তাঁরা। ফুলের তোড়া আর একটি ক্রেস্ট দিয়ে সম্মান জানালেন আমাকে। মাঠে দাঁড়িয়ে সেই সম্মান গ্রহণ করলাম। সারা রাতের ক্লান্তি উড়ে গেলো। ভাবছি এই সম্মানটুকু আমার জন্য যথেষ্ট।
পটুয়াখালী, বরগুনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ট্রলার মালিক ও জেলেরা আমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। কোনো কথা বলছেন না সুন্দরবন উপকূল অর্থাৎ খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার বড় মাছ ব্যবসায়ীরা। ভাবছি, সুন্দরবনের জেলেরা বনদস্যুদের আত্মসমর্পণে খুশি। তাহলে তাদের মহাজনরা বেজার কেন?
আত্মসমর্পণ করা সাগর বাহিনীর দস্যুদের শরণখোলা থানায় নেওয়া হলো। সেখান থেকে পাঠানো হলো জেল হাজতে। আমরাও রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাসায় একটি ফোন দিলাম। তারপর ফোন বন্ধ করে গাড়িতে বসে দিলাম ঘুম। আপাতত একটু বিরতি নিতে চাই।
(ছবি: সুন্দরবনে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ)