বাঘ কুমিরের আস্তানায়! | রূপান্তরের গল্প ২৪৮ | Rupantorer Golpo 248 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৪৮ : ও ভাই, ওঠেন! পথ হারায়ে ফেলছি! মামুনের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। লাফ দিয়ে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি চারপাশে শুধু পানি আর পানি। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গছে বলে মাথা কাজ করছে না।
শুয়ে ছিলাম ডেক এর উপর। বেলায়েত সরদারের ট্রলারের এখানেই বিছানা করা থাকে। আমি আর সরদার এখানেই থাকি ঘুমের সময়। কিন্তু কোথায় সরদার? মামুন বললো, ভোরবেলা ঠান্ডা বাতাস হলো খুব। তখন নিচে চলে গেছে সরদার। কী আর করা? উঠে বসলাম। চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কোথায় আছি।
সেই মধ্যরাত থেকে একা দাঁড়িয়ে মামুন। ছেলেটা পারেও। কিন্তু এভাবে রাতের বেলা বন আর সাগরে চলাফেরা করার নিয়ম নাই। অন্তত দুইজনকে জেগে থাকতে হয়। কিন্তু মামুনের সাথে কেউ নাই। আশেপাশেও কেউ নাই। সবাই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
এখন হেমন্ত কাল। ভোরবেলা বেশ কুয়াশা পড়ে। মরা গোন বলে এদিকে কোনো নৌকা বা ট্রলার নাই। তাই কাউকে জিজ্ঞেস করবো তেমন কাউকে পাচ্ছি না। ব্যাগ থেকে ফোন বের করলাম। গুগল ম্যাপস খুলে লোকেশন দেখলাম।
মামুনকে বললাম, আমরা তো বেশি দূর আগাইনি। চরাপুঁটিয়া পার হইছি মাত্র। ট্রলার চলে আসছি পশুরের পশ্চিমে প্রায়। আরেকটু হলে অন্যদিকে চলে গেছিলাম। গতি মেপে দেখি মাত্র ৬ কিলোমিটার বেগে চলছি আমরা। তার মানে পুরো জোয়ার লেগে গেছে। হিসাব উল্টেপাল্টে গেছে। বললাম, জোয়ার ঠেলে আগানোর দরকার নাই। সামনে কোথাও নোঙ্গর করবো।
সুন্দরবনে মনে হলো শীত পড়ে গেছে। বাতাস পুরোপুরি উত্তরা না। তারপরও কেমন জানি শীত শীত ভাব চলে এসেছে। কাঁথা মুড়ি দিলে শুতে বেশ ভালো লাগে। তবে এখন ট্রলার চালাতে হবে। ঘুমানো যাবে না।
মামুনকে সরিয়ে হাল ধরলাম আমি। পথ চিনে চালাতে পারবো। তবে এই পরিবেশে নিজেকে জাগিয়ে রাখতে এক কাপ কড়া লিকারের দুধ চা লাগবে। মামুনকে ডেকে কানে কানে বললাম, একটু চা খাওয়াতে পারো? সে বললো, অবশ্যই!
রান্নাঘরের দরজা খুললো মামুন। চায়ের পাতিল ধুয়ে নিলো নদীর পানি দিয়ে। তারপর বোতল থেকে খাওয়ার পানি দিলো পাতিলে। জ্বললো চুলা। মামুনকে বললাম, বোতলের পানি দিলে যে? ড্রামের পানিও তো দিতে পারতে! মামুন বললো, ওই পানি পুকুর থেকে তোলা। খাওয়াও যায়। কিন্তু চা বানাতে গেলে লিকার হয় না ঠিকমতো, রং আসে না চায়ের। বললাম, ঠিক আছে, চা বানাও, আমি সুকানিতে আছি।
সকাল সাতটার দিকে পৌঁছালাম ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের মুখে। আর টানা যাচ্ছে না। মামুন বললো, আজকে নবমী চলে। দশমী মানে কাল থেকে গোন শুরু। জেলেরা আসবে রাতেই। পানিতে একটু স্রোত বাড়লে মাছ ধরা পড়ে জালে। গোনের শুরুতেই তাই জাল পড়বে সুন্দরবনের খাল আর নদীতে। তার মানে কাল থেকে জেলেদর পাবো আমরা? মামুন বললো, আজকে রাতেই নামবে সবাই।
পশুর নদীর ঠিক উল্টো পাশে মানে পশ্চিমে পাশাখালী। পিছনে রেখে আসলাম চাইলেবগীর ঠোঁটা। এই জায়গায় পশুর নদী একটু সরু। তাই জেলেরা এই জায়গা অতিক্রম করে দুরুদুরু বুকে।
চাইলেবগীর ঠোঁটা থেকে পাশাখালী পর্যন্ত পশুর নদীর দুই পাশে অনেকগুলো ছোট খাল আছে। সেখানে সহজেই লুকিয়ে থাকে বনদস্যুরা। নদী সরু বলে মাঝ দিয়ে গেলেও গুলির রেঞ্জ এর মধ্যে থেকে পার হতে হয়। দুই পাশে দুইটি দস্যু দল অবস্থান নেয় গোন এর সময়। জেলেরা যাওয়া বা আসার পথে ধরা খায় বনদস্যুদের হাতে। আগাম চাঁদা দেওয়া থাকলে রক্ষা, তা না হলে অপহরণ করবে ডাকাতেরা। তারপর নিবে মুক্তিপণ।
সুন্দরবন বা সাগরে ট্রলারে আক্রমণ করলে শুরুতেই গোলাগুলি ও মারপিট করে ভীতি ছড়ায় দস্যুরা। তারপর জেলেদের মধ্যে থেকে একজনকে অপহরণ করে। অন্যদের ছেড়ে দেয়। তারপর দস্যুদের ফোনে যোগাযোগ করতে বলা হয়। ছাড়া পাওয়া জেলেরা ফিরে যায় লোকালয়ে। ফোনে চলে দেন দরবার। মুক্তিপণের অংক নিয়ে চলে দর কষাকষি। তারপর নির্দিষ্টি ব্যক্তির হাতে দিতে হয় মুক্তিপণের টাকা। লেনদেন নিশ্চিত করে তারপর ছাড়া হয় অপহৃত জেলেদের।
মধ্য সুন্দরবনের এই জায়গাটি অতিক্রম করার সময় আমার বুকও দুরু দুরু করে। বিশেষ করে রাতের বেলা যাওয়ার সময় ভয় বেশি লাগে।এখানে এসে আমরা সিগন্যাল পেলে পাল্টা সিগন্যাল দিয়ে সোজা টান দেই।
এই কয় বছরে টর্চ এর আলোর সিগন্যাল সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। কী ভাবে টর্চ মারলে কী অর্থ দাঁড়ায় তা শিখে পেলেছি। এই অঞ্চল শুধু না, সুন্দরবনের যেকোনো জায়গায় রাতের বেলা সিগন্যাল পেলে পাল্টা সিগন্যালে দস্যুদের বুঝিয়ে দেই, আমি এমন কেউ যাকে তোমরা ধরে রাখতে পারবে না! সেই ইশারার পাল্টা ইশারায় আমাদের এগিয়ে যেতে বলা হয়। তবুও দুশ্চিন্তায় থাকি। কারণ গুলির রেঞ্জ এর ভিতর দিয়ে যেতে হয় এখানে। হঠাৎ কেই ভুল বুঝে গোলাগুলি শুরু করলে বিপদ!
বিপদের জায়গা পেরিয়ে গেছি বেশ আগে। আমরা ঢুকে পড়বো ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের ভিতরে। পশুর নদীর পূর্ব দিকের এই খালটি বেশ বড়। ভিতরের দিকে চওড়া। আঁকাবাঁকা পথে গিয়ে মিশেছে সেলা নদীতে। ভিতরে বেশ কয়েকটি ভাড়ানী আছে। তাই বনদস্যুদের থাকার উত্তম জায়গা। সুন্দরবনের এদাকটায় পূর্ব সুন্দরবনের বড় দস্যুদলটির দখলে থাকে। এই মুহুর্তে (২০১৬ সালের শেষ দিকে) বড় সুমন বাহিনী এদিকটায় দস্যুতা করে। হাড়বাড়িয়া থেকে কোকিলমনি পর্যন্ত এলাকা দখলে তাদের।
আপাতত আমরা আর ট্রলার চালাবো না। জোয়ারের চাপ অনেক বেড়েছে বলে এ সিদ্ধান্ত। ঘসিয়াঙ্গাড়ীর ভিতরে দুই বাঁক ঘুরে নোঙ্গর করলাম। চার খালের মোহনা বলে পানি বেশ ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই চাত্রী খালের ভিতরে কিছুটা এগিয়ে আরেকটি দোয়ায় নোঙ্গর করবো। মামুন বললো স্রোত বেশি। আরও ভিতরে যেতে হবে। বললাম, এর ভিতরে ঢুকলে ডাকাতে ধরবে। তাই ভিতরে না গিয়ে খালের পাশের একটি বাইন গাছের সাথে বাঁধলাম ট্রলার।
মামুনকে বললাম ঘুম দাও। ওদিকে ট্রলারের আরেক সহযোগী দেখি ঘুম থেকে উঠেছেন। বললাম, হাতমুখ ধুয়ে নেন। ভাত চড়াতে হবে। ছইয়ের নিচে গিয়ে বেলায়েত সরদারকে উঠালাম। বললাম, আমি ঘুমাতে যাবো। উঠে রান্নাবান্নার আয়োজন করেন।
ঘুম থেকে উঠেই সরদার বলে, আমরা কি দুবলার চরে? বললাম, সে অনেক দূরের পথ। আমরা ঘসিয়াঙ্গাড়ীর ভিতরে। বলতে বলতে বেরিয়ে আসলাম। ট্রলারের সামনে দাঁড়িয়ে সরদার বললেন, ও ভাই আর কোনো জায়গা পেলেন না? জঙ্গলের সবচেয়ে খারাপ জায়গায় এসর দাঁড়াতে হলো? সামনে চাত্রীর ঠোঁটার দিকটা দেখিয়ে বললেন, ডান দিকে চলে গেছে মাইটের খাল। বাম দিকের ভাড়ানী গিয়ে পড়ছে পশুর নদীতে। সোজা উত্তরে চলে গেলে চরাপুঁটিয়া। পুরো এলাকা কুমিরের রাজ্য। সুন্দরবনের এদিক থেকে প্রায় প্রতি বছর বাঘে মানুষ খায়। এছাড়া ডাকাতের কথা নাই বললাম।
মজা করে বললাম, মাছ আছে না এদিকে? সরদার বললেন, সব ধরনের মাছ আছে। বছরের এসময় বড় বড় পাঙ্গাস মাছ ধরা পড়ে এদিকে। বললাম, তাহলে আমরাও মাছ ধরবো আজ। কয়টা চিংড়ি মাছ ধরে দিবেন। সরদার বললেন, এই জায়গায় মাছ ধরে নামা যাবে না। জঙ্গলে বাঘ, পানিতে কুমির। বলতে বলতে চাত্রীর ঠোঁটায় তাকিয়ে দেখি মাঝারী আকৃতির দুটি হরিণ বেরিয়ে এসেছে। দুই পা উঁচু করে কেওড়ার পাতা খাচ্ছে। পিছনে আরও দুটি বড় শিং ওয়ালা হরিণ দাঁড়ানো।
সরদারের সাথে গল্প করতে গেলে বেশ মজা লাগে। তারচেয়ে বেশি মজা লাগে কথাগুলো যখন মিলে যায়। গল্প করতে করতে তাকিয়ে দেখি লাফঝাঁপ দিয়ে দৌড়ে পালালো হরিণগুলো। সরদার বললেন, ভালো করে খেয়াল করেন। চরের সামনে পানিতে পজিশন নিয়ে আছে কুমির। বিশাল কুমির! হরিণগুলো টের পেয়ে গেছে। বলতে বলতে কুমিরটি চরে উঠে পড়লো। মোচড় দিয়ে নেমে পড়লো খালে। আমরা ভাসছি ওই খালের ভিতর। কুমির যেখানে ডুব দিলো সেখান থেকে খুব বেশি হলে ত্রিশ হাত দূরে।
সরদারকে বললাম, ক্ষুধা লাগছে ভাই! উনি বললেন, আমার সাথে হেল্পারি করতে হবে। বললাম, চলেন। সুন্দরবনের ট্রলার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নানা কাজে সহযোগিতাও করি। ভালো লাগে।
চাত্রী খালের ভিতরে গত শীতে এক কিশোরকে বাঘে নিয়ে গেছে। মানে যে খালে আমরা আছি সেখানেই ঘটেছে সেই দুর্ঘটনা। বুকটা দুরুদুরু করছে। ভয় যতোই পাই এখানেই থাকবো আমরা। শুধু খালের পাশ ছেড়ে মাঝ খালে নোঙ্গর করতে হবে। জঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়ানো যাবে না। এখানকার একটা বাঘ নাকী বেশ দুষ্টু। নৌকার উপর ঝাঁপ দেয়!