রূপান্তরের গল্প ২৪৯ | Rupantorer Golpo 249

নিষিদ্ধ খালে নিষিদ্ধ জেলে বহর! | রূপান্তরের গল্প ২৪৯

নিষিদ্ধ খালে নিষিদ্ধ জেলে বহর! | রূপান্তরের গল্প ২৪৯ | Rupantorer Golpo 249 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৪৯ : কুয়াশা কমেছে। কিন্তু আলো নাই। আকাশে জমাট বাঁধা মেঘ। তাই সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি এখনও। সকাল দশটা বাজে। সুন্দরবনের এই দিকটা কেমন জানি গুমোট হয়ে আছে। সহসা বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু সুন্দরবনের কথা বলা যায় না। শেষ জোয়ার বা শেষ ভাটায় হুট করে বৃষ্টি নেমে যায়। এভাবে বৃষ্টি হতে হতে নামে শীত।

কার্তিক মাস বলে এখনই একটু শীত শীত ভাব আছে। ট্রলারের ছাদ, পাটাতনসহ সব জায়গা কুয়াশায় ভেজা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পূর্ব সুন্দরবনের চাত্রী খালের দোয়ায় ট্রলার নোঙ্গর করা। মরা গোন বলে জেলেদের দেখা নাই। অবশ্য নবমী বা দশমীতে জেলেরা নেমে যায় জঙ্গলে। আজ রাত থেকেই নামতে শুরু করবে জেলেরা। কাল থেকে দেখা মিলবে তাদের সাথে।

মরা গোনে সুন্দরবনে দেখা যায় শুধু বড়শির জেলেদের। তবে আগের মতো মাছ হয় না। বইশেলরা বলে, বিষ দিয়ে জঙ্গলের মাছ সব শেষ হয়ে গেছে। বড়শিতে আগে এক দিনে যা মাছ ধরা পড়তো এখন সাত দিনেও তা পাওয়া যায় না। বিষ দস্যুদের ওপর তাদের অনেক রাগ। কিন্তু ভয়ে কিছু বলতে পারে না।

সহযাত্রীদের ঘুম ভাঙ্গেনি। উঠেছেন শুধু বেলায়েত সরদার আর একজন সহকারী। ঘুমে শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। কিন্তু ঘুমানো যাবে না। এখানে হুট করে বনদস্যুরা সামনে পড়তে পারে।

জোয়ার হচ্ছে। সরসর করে স্রোত বইছে। পানি বাড়ছে। একটি নোঙ্গর দিয়ে মনে হয় ট্রলার আটকে রাখা যাবে না। আরও দুই ঘন্টার মতো জোয়ার হবে। পানি বাড়তেই থাকবে। স্রোতের গতিও বাড়বে।

বেলায়েত সরদার ব্যস্ত রান্নাঘরে। সেখানে গিয়ে বসলাম। কানে কানে বললাম, এক কাপ চা বানানো যাবে? উনি বললেন, চা হবে। কিন্তু একটা শর্ত আছে। রান্নাঘরের কোনো কাজে হাত দিতে পারবেন না। বললাম, কেন ভাই? আপনিই তো হেল্পারি করতে বললেন!

সরদার বললেন, ট্রলারের নোঙ্গর উঠে যায় কী না খেয়াল রাখবেন। আশে পাশে বাঘ-কুমির আসে কী না দেখবেন। আর ডাকাত আসলে তাদের সাথে কথা বলবেন। হাসতে হাসতে বললাম, এটা কোনো কাজ হলো? সরদার বললেন, রান্নার কাজে আপনি হাত দিলে কাজ পিছায়ে যায়। তারপরও পেঁয়াজ আর রসুনের গামলাটি টেনে নিলাম। ছুরি দিয়ে সেগুলো কাটতে থাকলাম।

চুলা জ্বালিয়ে তাতে চায়ের পানি উঠানো হলো। গরম গরম দুধ চা তৈরি হলো। বিস্কিট আর চা নিয়ে ট্রলারের গলুইয়ের দিকে চলে আসলাম। সেখানে বসে দেখছি সুন্দরবনকে। আশেপাশে কেউ নাই। একমনে সুন্দরবনকে উপভোগ করছি।

পানি সরার শব্দ, বাতাসের শব্দ, পাখির শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। কী যে অদ্ভুত এক পরিবেশ! মাঝে মাঝে ডাকছে হরিণ। এদিকে চিত্রা হরিণ ছাড়াও আরেক জাতের হরিণ আছে। বার্কিং ডিয়ার নামের সেই হরিণের ডাক অনেকটা কুকুরের ডাকের মতো।

চোখে না দেখলেও জায়গায় জায়গায় এই হরিণের ডাক শুনি। সুন্দরবনের করমজলের ওদিকটায় এই হরিণ আছে। আমরা যেখানে আছি সেখানেও আছে। উত্তরে চরাপুঁটিয়া থেকে দক্ষিণে কোকিলমনি পর্যন্ত সুন্দরনে প্রায়ই বার্কিং ডিয়ারের ডাক শুনি।

সকাল থেকেই এদিকে বন মোরগের ডাক শুনছি। তাদের ডাক শুনে আমাদের ট্রলারের ভিতর থেকে চিৎকার করে ডাক ছাড়ছে দেশি মোরগ। চিলা বাজার থেকে বেশ কয়েকটি দেশি মোরগ মুরগি তুলেছেন বেলায়েত সরদার। কয়েকটি হাঁস আছে, রাজহাঁসও আছে। ট্রলারের সামনে পাটাতনের নিচে একটি খুপড়িতে রাখা আছে সেগুলো। নিয়মিত তাদের খাবার দেওয়া হয়।

নিজেদের খাওয়ার জন্য এতোগুলো হাঁস-মুরগি কিনতে হয় না। তবুও নিয়ে আসি অন্য কারণে। ট্রলারে বেশি করে চাল-ডাল রাখি, শুকনা খাবার ও বোতলজাত পানিও রাখি বেশি করে।

সুন্দরবনের খাল-নদীতে জেলেদের সাথে দেখা হয়। তাদের কাছ থেকে মাছ কিনি। কখনও কখনও জেলেরা মাছের দাম নিতে চায় না। তখন তাদের নৌকায় হাঁস বা মুরগি তুলে দেই। অনেকটা সেই আগের আমলের বিনিময় প্রথার মতো। কোনো কিছু বিনিময় হোক বা না হোক, শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে দেই নৌকায়। জেলেদের কাছে খাবার পানি মানে বিরাট ব্যাপার। সুন্দরবনে কোটি টাকা খরচ করেও মিঠা পানি পাবেন না।

জোয়ার আরও বাড়লো। পানির চাপে কখন জানি ছুটে গেছে নোঙ্গর। আমাদের ট্রলার ভাসতে ভাসতে গিয়ে ধাক্কা খেলো চাত্রীর সেই ঠোঁটায়, যেখানে বড় একটা কুমির দেখেছি ঘন্টা দুই আগে। বেলায়েত সরদার হাঁক দিয়ে বকাঝকা শুরু করলেন।

মেজাজ বিগড়ে গেছে সরদারের। আমাকে তো কিছু বলতে পারেন না! তাই ঘুমিয়ে থাকা লোকজনদের ডেকে ব্যাপক বকাঝকা করলেন। সবাই উঠে পড়লো। লগি হাতে একজন এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। অনেক চেষ্টা করেও ট্রলারের উঠে পড়া অংশ নামাতে পারলো না। বললাম, একটু অপেক্ষা করো। পানি আরেকটু বাড়লেই ভাসবে ট্রলার।

মিনিট পাঁচ এর মধ্যে ভাসলো ট্রলার। তারপর লগি দিয়ে ঠেলে খালের ভিতরের দিকে যাচ্ছি। সামনে সুবিধাজনক জায়গায় আবার নোঙ্গর করবো। না পারলে কোনো গাছের সাথে বেঁধে রাখবো ট্রলার।

এক বাঁক ঘুরতেই দেখি বেশ কয়েকটি নৌকা একসাথে বাঁধা। প্রথমে একটু থমকে গেলাম। ডাকাত দলের বহর না তো? এখন থামারও সুযোগ নাই। স্রোত আমাদের ঠেলে নিচ্ছে সামনের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করেই বুঝলাম, ওরা বনদস্যু না।

আপনারা কারা? জেলেরা একজন আরেক জনের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু কারও মুখে উত্তর নাই। এবার সরদার রান্নাঘর থেকে উঁকি মারলেন। মাথাটা বের করে গরগর করে স্থানীয় ভাষায় কিছুক্ষণ গালি গালাজ করলেন। সাথে সাথে সবাই বলে উঠলো, আমরা কাঁকড়ার জাইলে। পাশে তিনটি বড়শির নৌকাও আছে।

ট্রলার নোঙ্গর করতে পারিনি। তাই এখানেই একটি বড় কেওড়ার গাছের ডালের সাথে বেঁধে ফেললাম ট্রলার। নৌকা আছে ১১টি। তার মধ্যে আটটি কাঁকড়ার নৌকা। তিনটি বড়শির। জেলেরা কথা বলছেন বরিশালের ভাষায়। বাড়ি তাদের মোড়েলগঞ্জ।

প্রথমে বুঝিনি কেন তারা আমাদের দেখে থতমত খেলো! পরে বুঝলাম, ওদের বহরে হরিণের মাংস রান্না হচ্ছিলো। আমাদের দেখে চুলায় রাখা হাঁড়ি ভর্তি মাংস পানিতে ফেলে দেয়। ওরা ভেবেছে আমরা হয়তো বন বিভাগ বা অন্য কোনো প্রশাসনের লোকজন।

কিছু বললাম না। কারণ অকারণে ওদের ভয় দেখিয়ে লাভ নাই। বরং একটু খাতির করে গল্প জমাতে পারলে এদিকের দস্যুদের খবর পাওয়া যাবে। বড় সুমন বাহিনী নামের দস্যুদলটির প্রধান জামাল শরীফের বাড়িও মোড়েলগঞ্জ। দলের অন্য সদস্যদের বাড়িও ওদিকেই। মানে দস্যুদলের ছত্রছায়ায় এরা মাছ-কাঁকড়া ধরে সুন্দরবনে।

জেলেদের নৌকায় নেমে গেলাম। দুটি রাজহাঁস বের করে খেতে দিলাম তাদের। বললাম, আর হরিণ মারবেন না। তারপর কিছু শুকনা খাবার আর নৌকা প্রতি একটি করে পাঁচ লিটারের পানির বোতল দিলাম। জেলেরা সেই বোতল থেকে পানি তাদের নৌকায় রাখা হাঁড়ি বা ড্রামে ঢেলে ফেললো। তারপর খালি বোতলগুলো ফিরিয়ে দিলো ট্রলারে।

বললাম, পানিগুলো ঢেলে ফেললেন কেন? বোতলসহ রাখলে ভালো হতো না? ওরা বললো, পানির বোতল রাখলে বিপদে পড়তে হবে। বললাম, পানির বোতলে বিপদ কীসের?

জেলেরা বললো, আমরা জেলেরা ড্রামে করে খাওয়ার পানি আনি। বোতল পানি তো আনি না। এখন আমাদের নৌকায় বোতল দেখলে ডাকাতেরা মনে করে প্রশাসনের লোকজনের কাছ থেকে পানি নিছি। আবার প্রশাশন দেখলে মনে করে আমরা ডাকাতের কাছ থেকে পানি নিয়ে খাচ্ছি। কারণ এই জঙ্গলে বোতলের পানি ডাকাত আর প্রশাসন ছাড়া কেউ রাখে না।

কতো বিপদ এই মানুষগুলোর! চারপাশের বিপদ সামাল দিতে দিতে জীবন শেষ। এসব সামাল দিতে গিয়ে বাঘ-কুমিরের কথা ভুলে যায় জেলেরা। মাছ-কাঁকড়া ধরতে গিয়ে মৃত্যুর মুখে পড়ে। গল্প করতে করতে ওদের কাছে চলে গেলাম। কড়া রঙ চা আসলো পাশের নৌকা থেকে। চায়ে চুমুক দিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো। এতো কড়া চা! বললাম, একটু গরম পানি ঢালেন আমার কাপে। লিকারটা হাল্কা করে দেন।

চা খেতে খেতে শুনলাম, কয়েকদিন আগে যে ছেলেটিকে বাঘে মেরেছে তার বাবাও আছে এই বহরে। তাকিয়ে দেখি চুপচাপ নৌকার কাজ নিয়ে ব্যস্ত তিনি। বাড়ি শরণখোলা।

পাশে গিয়ে বসলাম। ছেলেকে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। আগের গোনে বাঘে নিয়েছে ছেলেকে। পরের গোনে ছোট ছেলেটিকে নিয়ে বনে নেমেছেন বাবা। শোক পালনেরও উপায় নাই। পেটের টান কাকে বলে!

পিঠে হাত রেখে সান্ত্বনা দিলাম। গল্পে গল্পে শুনলাম ছেলেকে কী করে বাবার সামনে থেকে বাঘে নিয়ে গেলো! শুনলাম, সামনের দোয়ায় যে বড় কুমিরটি দেখেছি সেই কুমির নাকী গতকাল ছোট ছেলেটাকে টার্গেট করেছিলো। একটুর জন্য জানে বেঁচে গেছে সেই কিশোর। ভয়ঙ্কর ব্যাপার! আমরাও দেখে আসলাম কুমিরটিকে।

বেলায়েত সরদারকে ডাক দিলাম। বললাম, আজ আমরা এই বহরের সাথে থাকবো। দুপুরে একসাথে খাবো। সরদার বললেন, এই খাল তো অভয়াশ্রম ভাই। নিষিদ্ধ খালে থাকবেন? বললাম, নিষিদ্ধ খালে জেলেরা থাকে, বিষদস্যুরা ঘুরে বেড়ায়, বনদস্যুরা বাড়িঘর বানিয়ে থাকে। তাহলে আমাদের থাকতে সমস্যা? সরদার বললেন, নো সমস্যা!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top