ছেলেটাকে বাঘে নিয়ে গেলো! | রূপান্তরের গল্প ২৫০ | Rupantorer Golpo 250 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৫০ : শেষ ভাটায় ছোট খালের ভিতরে ঝাঁকি জাল দিয়ে বড়শির আধার ধরতে হয়। দাওন বড়শির আধার মানে পারশে আর চিংড়ি মাছ। জীবিত মাছ দিয়ে আধার ফেলতে পারলে বড় মাছ ধরে। তাই বড়শির প্রতি খ্যাওনের আগে বইশেলরা তাজা মাছ ধরে।
এক একটি নৌকায় দুইজন জেলে থাকে। একজন মাছের আধার ধরতে যায়। আরেকজন রান্নাবান্নার কাজ করে, বড়শি গোছানোর কাজ করে। আধার ধরে আনার সাথে সাথে বড়শিতে সেগুলো গেঁথে ফেলে। মাঝ নদীতে গিয়ে বড়শি ফেলে অর্থাৎ খ্যাওন দিয়ে ফিরে আসে। ছোট খালের আগায় এসে অবস্থান নেয়।
খাওয়া দাওয়াসহ অন্য কাজগুলো সেরে আবার সময় মতো বড়শি উঠাতে যায়। এই হলো বইশেলদের প্রতিদিনের জীবন। মরা গোন অর্থাৎ যখন মরা কাটাল বা ঢালা চলে তখনই বড়শি ফেলার সময়। তারপর গোন আসলে স্রোত বাড়ে। তখন বড়শিও ফেলা যায় না, মাছও দাঁড়ায় না।
ছেলেকে বাঘে নেওয়া বড়শির জেলের নৌকায় বসে আছি। মধ্যবয়সী লোকটির দুই ছেলে। বড় জনকে বাঘে নিলো দশদিন আগে। ছোট ছেলেটাকে জঙ্গলে আনার চিন্তা ছিলো না। কিন্তু পেট তো কথা শোনে না।
আনমনে বলে যাচ্ছেন ওই জেলে। চোখে পানি নাই। কিন্তু তার ভিতরের কান্না অনুভব করতে পারছি। বললেন, জঙ্গলে অ্যাক্সিডেন্ট হবে এটা ধরে নিয়েই আসি। কিন্তু ঘটনাটা ছেলের সাথে না হয়ে আমার সাথে হতে পারতো। আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। ছেলেটা বাঁচতো মেলা বছর! মনটা ভীষণ খারাপ হলো। কী বলবো আর? বললাম, আপনার ছেলেটা গত বছর আমাদের নৌকায় করে ঘুরিয়েছিলো। আলোর কোলে এক বেলা ছিলো আমাদের সাথে।
শরণখোলার বইলেল বললেন, জঙ্গলে নামার সময় কিছু টাকা খরচ হয়। নিজেদের বাজার, বন বিভাগের পারমিশন, দালালরা ঘুষের টাকা নেয়, ডাকাতদের টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই টাকা জোগাড় করতে আগের মরা গোন-এ বাড়ি থেকে নেমে আসতে একদিন দেরি হলো। ইচ্ছা ছিলো পশুর বাওনে বড়শি ফেলবো। কিন্তু সময়ে কুলাতে পারিনি। তাই প্রথম খ্যাওনটা এদিকে দেই। শেষ ভাটায় ছেলেটা গেলো আধার ধরতে। বললাম, বিকাল হয়ে গেছে, সন্ধ্যা নামার আগে ফিরে আসিস।
জানতে চাইলাম, কোন খালের ঘটনা এটা? উনি বললেন, পাশেই সেই খাল খাল। এখান থেকে আধা ঘন্টার পথ। মাইটে আর চাত্রীর মাঝামাঝি জায়গায় ঘটলো অ্যাক্সিডেন্ট। মানে বাঘে আক্রমণ করলো ছেলেটাকে।
আমি বসে আছি। কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু লোকটি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন। বললেন, ছেলের চিৎকার শুনে আমি তো শিওর বাঘে ধরছে। কুমিরেও ধরতে পারে। কিন্তু জঙ্গলের ভিতর থেকে যেভাবে আওয়াজ আসলো তাতে করে বাঘই মনে হলো। কিন্তু আমি একা কী করে কী করবো? ভাবতে ভাবতে ওই খালের ভিতরে ঢুকে পড়লাম। নৌকা বেয়ে যাওয়ার সময় দুইটা কাঁকড়ার নৌকা পেলাম। ওরাও সাথে যোগ দিলো।
জেলে ভাই বলছেন এক নি:শ্বাসে, খালের পাশ দিয়ে নরম কাঁদা। ছেলে হেঁটে গেছে এদিক দিয়ে। পায়ের ছাপ ধরে কিছু দূর গিয়েই দেখলাম ছাপ শেষ। খুব বেশি দূর না। আমরা মোট পাঁচ জন ছিলাম। হাতে দা আর লাঠি নিয়ে জঙ্গলে নেমে পড়লাম। বাঘে টেনে নিয়ে গেছে আমার ছেলেটাকে।
পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে, সব আলামত আছে। আমরা চিৎকার করছি আর লাঠি দিয়ে জঙ্গলে বাড়ি মারছি। এভাবে মিনিট দুই যাওয়ার পর দেখি হরগজার ঝোপের ভিতরে সে বসা। মুখ আমাদের দিকে ফিরানো।
ছেলেটাকে পেটের তলে নিয়ে বসে আছে বাঘ। আমাদের দেখে দাঁত মুখ আর চোখ দিয়ে এমন ভাবে ভেচকি দিলো! বাঘের এতো ভয়ঙ্কর চেহারা আর দেখিনি। মুখটা হা করা। লালা ছিটকে বেরুচ্ছে। সেই চেহারা দেখে অন্যরা একটু পিছায়ে গেলো। কিন্তু আমি তো বাপ লাগি। পিছালাম না। এবার একটু সাহস করে অন্য চারজন আবার এগিয়ে আসলো। একটু পর ভয় পেলো বাঘ। লাফ দিয়ে চলে গেলো ঝোপের আড়ালে।
আমি ছেলেটার রক্তাক্ত শরীরটাকে কাঁধে তুলে নিলাম। অন্যরা চিৎকার করতে থাকলো। যাতে বাঘ আবার না ফিরে। ছেলেটাকে নিয়ে কেমন করে যে খালের কিনারে ফিরলাম জানি না।
ছেলেটাকে নিয়ে নৌকায় শোয়ায়ে দিলাম। মাথার পিছনে ক্ষত। রক্ত পড়ছে। কিন্তু সে বেঁচে আছে। কাঁকড়ার জেলেরাসহ সবাই তুফানের গতিতে নৌকা নিয়ে বের হলাম। সরু খাল থেকে এসে পড়লাম এই চাত্রীর খালে। তারপর কাটা জায়গাগুলো কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেললাম।
এরপর কী হলো? প্রশ্নটি আনমনেই করে ফেললাম। লোকটির চোঁয়াল শক্ত হয়ে গেছে। চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। বুঝতে পারছি চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। পাশে রাখা ড্রাম থেকে পানি নিয়ে গলায় ঢাললেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন সেই হৃদয় বিদারক কাহিনী। বললেন, ছেলেটা বেঁচে আছে। মুখে পানি দিচ্ছি। কিন্তু ও কিছু বলে না। চোখ দুটো খোলা। বুঝতে পারছি কী কষ্টটাই না ছেলেটা পাচ্ছে। নিজের সন্তানের এই কষ্ট দেখা যায় না ভাই!
নৌকা বেয়ে মংলা বা শরণখোলা যেতে হবে। কিন্তু ততোক্ষণে ছেলেটাকে বাঁচাতে পারবো না। তাই নৌকা বেয়ে চলে গেলাম কোকিলমনি। এখান থেকে যেতে ঘন্টা দুই লাগলো। ওখানে কোস্টগার্ডের ক্যাম্প এ গেলাম।
কোকিলমনির ক্যাম্প কমান্ডার স্যার খুব ভালো মানুষ। আমরা পৌঁছানোর সাথে সাথে ছেলেটাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিলো। তারপর ট্রলারে করে আমাদের নিয়ে গেলো মংলায়। যেতে যেতে রাত হলো। সেখান থেকে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিলাম। ডাক্তার বললো, ছেলে মারা গেছে।
দশদিন আগের দুর্ঘটনা। এই জঙ্গলে মাছ ধরতে এসে ছেলেটাকে বাঘে নিলো। বললাম, এতো বড় দুর্ঘটনার পর আবার আসলেন জঙ্গলে? উনি বললেন, সংসার চালাতে হলে আর উপায় তো নাই। ছোট ছেলেটাকে এই বনে আনার চিন্তা ছিলো না। কিন্তু একটা লোক নিতে হলে তাকে তো বেতন দিতে হবে। নিজেই চলতে পারি না, আরেক জনকে বেতন দিবো কী করে? কিছু বলতে পারছি না আমি। কী জীবন এই মানুষগুলোর!
শুনেছি উন্নত দেশগুলোতে যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্পদ আহরণ করে তাদের পণ্যের সাথে ঝুঁকিমূল্য যোগ হয়। গ্রাহক সেই পণ্য কেনার সময় ঝুঁকিমূল্য সহ দাম দেয়। সেই অর্থ সরাসরি যায় সেই মানুষদের হাতে। কিন্তু আমাদের এখানে সেই নিয়ম নাই।
কী সব চিন্তা করি! ঝুঁকি মূল্য অনেক দূরের বিষয়। তারা আহরণ করা মাছ কাঁকড়ার বাজার দর পায় না। অনেক কম দামে এদের মাছ বিক্রি করতে হয়। শুধু তাই না। সুন্দরবনে মাছ ধরতে আসলে নিয়মের চেয়ে বেশি টাকা দিতে হয়। বনদস্যুদের চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা না দিয়ে ধরা পড়লে অপহরণ করা হয়, মুক্তিপণ দিতে হয়। আবার সরকারি নিয়ম না মেনে ধরা পড়লে মামলা খেতে হয়। কেউ বাঘ বা কুমিরের হাতে আক্রান্ত হলে ক্ষতিপূরণ পেতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। কী জীবন তাদের!
মনটা খুব খারাপ। কিছুই ভালো লাগছে না। এদিকে বেলায়েত সরদারের রান্নাঘরে তুমুল হইচই চলছে। ত্রিশ জনের রান্না হচ্ছে। দুপুরে একসাথে খাবো। ভাত রান্না হচ্ছে নৌকায় নৌকায়। আর তরকারি হচ্ছে ট্রলারের রান্নাঘরে। আমার সহযাত্রীরা ততোক্ষণে উঠে গেছে। একসাথে খাওয়া দাওয়া করে জেলেরা বিদায় নিবে। তাদের হাতে সময় নাই।
আবহাওয়া বেশ গোলমেলে। জেলেদের ধারণা বড় রকমের ঝড় আসবে। গোন শুরুর আগেই পানির চাপ বেড়ে গেছে। সরদারকে বললাম আমরা কি সামনের ভাটায় নামতে পারবো? বেলায়েত সরদার বললেন, নদীতে তুফান থাকবে। তবে যাওয়া যাবে। বললাম, বেশি ঝুঁকি হয়ে যাবে না? এদিকে আমার সহযাত্রীরা একটু দুশ্চিন্তা করছে। অনেকটা উভয় সংকটে আমরা। এখানে থাকলে নেটওয়ার্ক পাবো না। আবার নেটওয়ার্কে যেতে হলে উত্তাল নদীতে নামতে হবে।
আমার এই সফরের উদ্দেশ্য তেমন কিছু না। নিজেদের মতো করে সুন্দরবন ঘুরবো। কয়েকটা দিন কাটাবো বনের ভিতরে। কিছুদিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবো। বনদস্যুদের সাথে দেখা করার কোনো পরিকল্পনা নিয়ে নামিনি এবার। তবে আমার এই জঙ্গলে আসার প্রভাব পড়বে বিভিন্ন মহলে। অনেকেই ভাববে নতুন কোনো দস্যুদলের সাথে দেখা করতে নেমেছি। ওদের বিভ্রান্ত করতে পারলে আমার কাজ সহজ হয়। তবে দিনকে দিন সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর কাজটি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
রান্না শেষ। দ্রুত সবাইকে খাবার দিতে বললাম। ভাটায় এই জেলেরা চলে যাবেন যার যার কাজের জায়গায়। ঝড় বাদলের সময় নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার বিষয়ও আছে। সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে তাদের। পাশাপাশি আমাদেরও এই জায়গা ছাড়তে হবে। এতোজনের থালা-বাসন আমাদের কাছে নাই। তাই জেলেরা সবাই যার যার নৌকায় বসে পড়লেন। এই জঙ্গলে বসে সুস্বাদু মুরগির তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়াটা তাদের কাছে বিরাট ব্যাপার। এছাড়া একসাথে খাওয়া দাওয়া করার মধ্যে পিকনিক পিকনিক ভাব আছে।
খাওয়া শেষে একে একে বিদায় নিলো জেলেরা। শুধু বইশেলদের নৌকাগুলো থেকে গেলো। ওরা বড়শি ফেলেছে পাশের খালে। একটু পরে বড়শি তুলতে যাবে। প্রথম জোয়ারে তাদের নৌকা করে বড়শি তোলা দেখতে যাবো। শরণখোলার সেই ছেলে হারানো জেলের নৌকায় উঠবো।
মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, পাথঘাটা, চরদোয়ানীর মানুষ বাঘকে বলে হিয়াল। মানে শুদ্ধ বাংলায় শিয়াল। কেউ বাঘকে বলে মামা। অনেকের মধ্যে বাঘ নিয়ে অনেক কল্পকথা শুনি। সুন্দরবনের মানুষদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে সেই কল্পকথার সাথে বাস্তবতাকে মিলানোর চেষ্টা করি। সত্যি বলতে, বাস্তবতার সাথে তেমন পাই না। বরং এই জীবন পৃথিবীর অন্য যেকোনো ঝুঁকির জীবনের চেয়েও ভয়ঙ্কর। বনদস্যুদের অত্যাচার বাদ দিলেও নিপীড়নের অনেকগুলো অনুসঙ্গ আছে এই জীবনে। সুন্দরবন জীবন নিয়ে যে কল্প কথা শুনি বা পড়ি, তার সাথে বাস্তবতার ফারাক আকাশ পাতাল।
(ছবি: সুন্দরবনের বাঘের হাতে নিহত এক জেলের মরদেহ নিয়ে ফিরেছেন সহযাত্রীরা। ছবিটি সাতক্ষীরা বন উপকূলের। গল্পের ঘটনার কোনো ছবি ছিলো না।)