রূপান্তরের গল্প ২৫২ | Rupantorer Golpo 252

সরদার বলে, বড়শি ফেলেন! | রূপান্তরের গল্প ২৫২

সরদার বলে, বড়শি ফেলেন! | রূপান্তরের গল্প ২৫২ | Rupantorer Golpo 252 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৫২ : উজান মেরে যাচ্ছি। মানে স্রোতের বিপরীতে নৌকা চলছে। নৌকা বাইছে সামনে পিছনে বসে সরদার আর বড়শির জেলে। মাঝখানে বসে একটু আগে ধরা মাছগুলো দেখছি আমি। ছোট্ট ছেলেটা একটা একটা করে মাছের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। এতোক্ষণে মুখে কথা ফুটেছে ছেলেটির।

মাত্র দশদিন আগে বড় ভাইটি মরেছে বাঘের আক্রমণে। সেই একই জায়গায় বাবা তাকে এনেছে। সম্ভবত ভয় কাটেনি ছেলেটার। তবে কয়েক ঘন্টা আমাদের সাথে থেকে মনটা মনে হয় একটু ভালো হলো। এছাড়া অনেকগুলো মাছ দেখে তারও ভালো লাগছে। গল্পে গল্পে ছেলেটি বললো, কয়টা মাছের জন্য সারা জীবন বাবাটা জঙ্গলেই কাটিয়ে দিলো!

স্রোতের তোড় অনেক বেশি। আকাশের অবস্থা অনেক বেশি গুরু গম্ভীর। সারাদিন সূর্যের দেখা পাইনি। আবার বৃষ্টিও নাই। দম বন্ধ করা গরম পড়েছে। কার্তিক মাস বলে মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাস হচ্ছে। ওই বাতাসটুকুই শরীরটাকে শীতল করছে।

স্রোতের চাপ এড়াতে নৌকা চলে গেলো একদম খালের কিনারে। জঙ্গল ঘেঁষে স্রোত কিছুটা কম। তবুও নৌকাটিকে এগিয়ে নিতে হিমসিম খাচ্ছি আমরা।

হেমন্ত কালে আকাশে এমন মেঘের ঘনঘটা থাকে না। গোনের সময় মেঘ একটু জমে। তবে সেগুলো নিল আকাশে তুলার মতো ভেসে বেড়ায়। উন্মাতাল বাতাসে সেগুলো এদিক সেদিক যাওয়া আসা করে। এমন আবহাওয়ায় ভালো মাছ হয় নদী-খালে। শুনেছি বন্যপ্রাণিরাও এই মৌসুমে সবচেয়ে বেশি আরামে থাকে, আনন্দে থাকে।

নৌকায় বসে পানিতে পা নামিয়ে দিলাম। মনে হলো পা দুটো ভিজাতে পারলে একটু আরাম লাগবে। সাথে সাথে পিছন থেকে মাঝি ভাই বললেন, এখানে পা নামায়েন না ভাই। কুমিরে টেনে নিয়ে যাবে। বলে কী? এতো কুমির এদিকে? সামনে থেকে সরদার বললেন, এই খালে আসার পর দেখলেন না কুমির একটা? বললাম, দেখছি তো! সেই কুমির কি এখনও এদিকেই আছে? পিছন থেকে জেলে ভাই বললো, কুমির কই থাকবে কেউ বলতে পারে না। তবে এদিকে যে অনেকগুলো বড় বড় কুমির আছে সেবিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই, আমরা সব সময় দেখি।

বেলায়েত সরদার বললেন, কুমিরের সে আকৃতি দেখলেন তার সাইজ এই নৌকার দ্বিগুণ হবে। এখন সে যদি ইচ্ছা করে তাহলে আমাদের সবাইকে লেজের বাড়ি দিয়ে পানিতে ফেলতে পারবে। শোনেন ভাই, এই জঙ্গলের বাঘ, কুমির আর সাপ যদি মানুষকে আক্রমণ করতো তাহলে আমাদের আর জঙ্গলে আসা লাগতো না। ওরা বিনা কারণে কাউকে অ্যাটাক করে না। করলে জেলেরা এই বাদায় পা রাখতে পারতো না।

জেলে ভাই বললেন, এই জঙ্গলে গাছের গোঁড়ায় গোঁড়ায় কেউটে সাপ থাকে। আমরা যখন নামি তখন দেখি। এগুলো এলাকার সাপের মতো না। বিরক্ত না করলে ওরাও কিছু বলে না। দেখা হলে আস্তে করে অন্য পথ ধরি। ওরাও আপন মনে থাকে। একই ভাবে বাঘ যে সব সময় আক্রমণ করবে তাও না। জঙ্গলে যে পরিমান কুমির আছে এই বাদার খাল-নদীতে, মানুষ টার্গেট করলে একটা নৌকাও ভাসানো যাবে না। মাছ মারা তো দূরের কথা। তারপরও মাঝে মাঝে আক্রমণ করে বসে। যখন ওরা ডিম দেয় তখন বেশি হিংশ্র থাকে। মানুষ দেখলেও ধাওয়া দেয়।

শোনেন ভাই! সামনে থেকে বেলায়েত সরদার বললেন, ঢাংমারির এক মৌয়ালকে একবার কুমিরে ধরলো। আপনি চিনেন তাকে। ওরা করমজল আর জোংড়ার বাওনে মধু কাটে। গেলো বছর ঝাপসির ওদিকে মধু কাটলো। মেলা মধু পেলো এক সফরে। তারপর ঝাপসির দোয়ায় এসে নোঙ্গর করলো। সবগুলো নৌকা একসাথে করে চাক থেকে মধু আলাদা করতে বসলো। জঙ্গলের ভিতরেই ওরা মধুতে ভেজাল মিশায়। ভেজাল হিসাবে চিনি জ্বালায়ে মিশায় মধুর সাথে। আবার একটু গোলাপ জলও দেয়। মধু কাটা শেষ করে তারা একসাথে বসে সেই অপকর্ম করে। তবে তার আগে চাক থেকে মধু চিপে বের করে।

আমি আর নৌকার কিশোরটি এক মনে শুনছি গল্প। সরদার নৌকা বাইছেন আর বলে চলেছেন। জানতে চাইলাম এরপর কী হলো? বললেন, নৌকায় বসে মধু চিপে বের করে মৌয়ালরা। ওদিকে কুমিরের চাপ খুব। তাই পানিতে পা দেয় না মানুষ। সেদিন মধু চিপে হাত ধোওয়ার জন্য খালের পানিতে হাত ডুবানোর সাথে সাথে একটা কুমির ওই ছেলেটার হাত ধরে টান দেয়। মানে পানির নিচে কুমির পজিশন নিয়ে ছিলো।

বললাম, ছেলেটাকে নিয়েই গেলো কুমির? কই, আমি তো জানলাম না সে খবর? সরদার বললেন, ওরে না ভাই। শোনেন পুরোটা। হাতে কামড় দিয়ে হ্যাঁচকা টান মারছে কুমির। নৌকা থেকে সোজা খালের মধ্যে পড়লো সে। অন্যরা বুঝে ওঠার আগেই পানির নিচে হারায়ে গেলো ছেলেটা। সবাই আল্লাহ আল্লাহ করে উঠলো।

এক কয়েক সেকেন্ড পর একটু সামনে হুস করে ভেসে উঠলো ছেলেটা। দ্রত নৌকা বেয়ে তাকে উঠায়ে নিলো অন্যরা। তার মানে কুমিরে ছেড়ে দিছে? তা নয়।

জঙ্গল করা লোকজন জানে কুমিরের সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হলো চোখ। এ ছাড়া ওদের নরম কোনো জায়গা নাই। এক হাতে কামড় দিয়ে টান দিছে কুমির। ছেলেটা আরেক হাত দিয়ে হাতড়ায় হাতড়ায়ে কুমির চোখে গুতো দেওয়ার চেষ্টা করছে। চোখে যখন গুতো খাইছে কুমির, তখন হা করছে, হাত গেছে ছাড়ায়ে। এক তালে সে সাঁতরায়ে পানিতে ভাসছে। ছেলেটির যে হাত ধরে কুমির টান দিলো সেই হাত ভেঙ্গে গেছে। এরপর অবশ্য আর সে সুন্দরবনে আসেনি।

সরদারের মুখ থেকে গল্প টেনে নিয়ে মাঝি ভাই আরেকটি কুমিরের আক্রমণের গল্প বললো। কুমিরের প্রজণন মৌসুমে তালপট্টির খালের ভিতরে কুমিরের ধাওয়া খাওয়ার গল্প শুনলাম। এসব শুনতে শুনে গিয়ে পৌঁছালাম চাত্রী খালের দোয়ায়। ওখানে আমাদের ট্রলার থাকার কথা। কিন্তু যেখানে থাকার কথা সেখানে ট্রলার নাই।

কোথায় গেলো আমাদের ট্রলার? সরদার বললেন, আশেপাশেই আছে। একটু খুঁজলেই পেয়ে যাবো। খালটি এখানে দুই দিকে চলে গেছে। আমরা ছিলাম ডান পাশের খালের ভিতর। তার মানে ওরা বের হয়ে বাম পাশের খালে গেছে। নৌকা বেয়ে বামের খালে ঢুকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে কথাবার্তার শব্দ শুনলাম। সেদিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম।

অসম্ভব সুন্দর জায়গাটি। এখানে আরেকটি খালের তিন মোহনা। বেশ বড় একটি দোয়া। ট্রলারটি নোঙ্গর করা ঠিক মাঝখানে। এদিকে প্রচুর বাতাস। ট্রলারের পাশে নৌকা ভিড়লো। উঠে পড়লাম ট্রলারে। ডেক-এর ছাদে হাত পা ছড়িয়ে ঘুম দিয়েছেন আমার সহযাত্রীরা। আমরা উঠতেই স্যালাইন মিশানো পানি খেতে দিলো মামুন। তারপর একটি গামলা বের করে আনলো নিচ থেকে। ঝাল করে আমড়া মাখা। এই পরিবেশে গহীন জঙ্গলে বসে এই খাবারটি মনে হলো প্রাণশক্তি ফিরিয়ে দিলো। কোথায় চলে গেলো ঘুম বলতে পারি না।

ভাটা প্রায় শেষের দিকে। এদিকে কুকু পাখির ডাক তেমন শুনছি না। বন মোরগের ডাক শুনছি। কিন্তু আগের মতো না। হরিণ অবশ্য প্রচুর আছে। মাঝে মাঝে ডাক দিচ্ছে। খালের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখাও দিচ্ছে তারা। তবে সবচেয়ে বেশি মজা পাচ্ছি এখানকার মাছ দেখে। ট্রলার রাখা যেখানে সেখানে একটু পর পর বড় বড় মাছ লেজ দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। বইশেল ভাই বললেন, ওগুলো ছিলেট মাছ। বড়শি খায় না। তবে এদিকে অন্য মাছও আছে।

এখানে বড়শি ফেলবো। সামনের শেষ ভাটায় ফেলবো বড়শি। কিন্তু আধার কোথায়? মাছ ধরতে হলে আধার হিসাবে চিংড়ি মাছ লাগবে। কিন্তু এই জঙ্গলে ঝাকি জাল নিয়ে কাউকে নামতে দিবো না। বাঘ আছে।

মামুন বললো, বাঘ কোনো সমস্যা না। কাছাকাছি জায়গায় নেমে জাল খেওয়ালেই চাকা চিংড়ি পাওয়া যাবে। এই দেখেন কূলের দিকে। চিংড়ি লাফালাফি করছে। বললাম, ভিতরে বাঘ মামাও লাফালাফি করে। পানিতে ডুবোডুবি করে কুমির। এখানে নামবে না খবরদার!

পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছে বড়শির জেলে। বললো, চিংড়ি মাছ তো আমাদের নৌকায় আছে। জ্যান্ত চিংড়ি রাখা আছে নৌকার খোলে। বলেই ট্রলার থেকে নৌকায় নেমে গেলেন। নৌকার খোলের এক পাশে রাখা একটি ছোট ড্রাম থেকে এক মুঠ ভরে চিংড়ি মাছ এনে রাখলেন পাশে। বললেন, বড়শি বাইবেন বলবেন না?

সাথে সব সময় হুইল বড়শি থাকে। কিন্তু এবার আনা হয়নি। তাই হাত বড়শিই ভরসা। ঝটপট কয়েকটি বড়শি নিয়ে সূতায় বেঁধে হাত বড়শি বানানো হলো। এটাকে সুন্দরবনের মানুষ বলে হাত সূত। ভর হিসাবে বাঁধা হলো কয়েকটি নাট-বল্টু। দুটি বড়শিতে আধার গেঁথে ছুঁড়ে ফেললাম মাঝ খালে।

বড়শি মাটি ছুঁতে ছুঁতেই পড়লো টান। টেনে তুললাম বিশাল একটা ঘাগড়া টেংড়া। এদিকে কম দামী মাছ এটি। এই জঙ্গলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ঠিকঠাক রান্না করতে পারলে ভালোই লাগে। বুঝতে পারছি এখানে প্রচুর মাছ আছে। এই বেলাটা ভালোই কাটবে।

একটু পর সাথে থাকা বৈশেলদের নৌকায় গিয়ে বসলাম। এক পাশে আমি, অন্য পাশে মামুন। এদিকে সন্ধ্যা নামবে নামবে করছে। আকাশে মেঘ বলে একটু তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামলো আজ। অন্ধকার হতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। তার আগেই কিছু মাছ ধরে ফেলবো। আশায় আছি যদি বড় কোনো মাছ পাওয়া যায়।

বড়শির জেলেরা বললো, এখানে দাতিনা মাছ পাবেন, কপাল ভালো থাকলে তাইড়েলও পাবেন। ভোলা মাছ আর ঘাগড়া টেংড়া প্রচুর আছে। বললাম, এই দোয়ায় পাঙ্গাস মাছ বাড়ি দিচ্ছে একটু পর পর। ওগুলো ধরা যায় না?

এদিকে নৌকা থেকে বড়শির মাছগুলো বের করা হলো। ধুয়ে, পরিস্কার করে রাখা হলো ট্রলারের বরফের কেবিনে। সেখান থেকে বড় কাউইন মাছটা নিয়ে কাটাকুটি শুরু করলেন সরদার।

কিছু বলার আগেই বললেন, এই মাছ আমরা কিনে নিবো। মাছের মালিক বললো, ওর দাম কি নেওয়া যায়? জঙ্গলে আসছেন। একটা মাছ তো খেতে দিতেই পারি। আপনারা কতো কিছু দিলেন! বললাম, আপনারা আজ রান্না করবেন না। রাতে একসাথে খাবো। উনি বললেন, এই জোয়ারে আমরা নিচের দিকে নেমে যাবো। বললাম, আপনি যেখানে যাবেন আমরাও সেখানে যাবো। আপনার মাছ তো আমাদের কাছে। ওগুলো ভরের নৌকায় দিতে হবে না?

কী বিশাল হৃদয়ের মানুষ এরা! এতো টানাটানির জীবন! তবুও অতিথি আপ্যায়নে সবচেয়ে বড় মাছটি বের করে দিলেন! জেলেরা প্রায়ই খাওয়ার জন্য মাছ দিতে চায়। বড় মাছটিই এগিয়ে দেয়। সচরাচর সেই মাছ নেই না। ছবি তুলে আবার দিয়ে দেই। কিন্তু খুব জোর করলে, ছোট মাছ নেই। দাম দেই। সাথে উপহার হিসাবে কিছু বাজার সদাও দেই। এই বিনিময়টা দারুণ লাগে।

এবারে আমাকে বোকা বানিয়ে আগেই বড় মাছটি তুলে দিয়েছে জেলে ভাই। সবশেষে বললেন, কাইউন মাছ বরফে দিলে চেহারা নষ্ট হয়ে যায়। মহাজনে দাম দেয় না। সেদিন বাঘে খেলো ছেলেটিকে! কতো অভাব আর টানাটানি তার! অথচ কতো বিশাল হৃদয় তার!

কাউউন মাছ রান্নার আগে কিছু জরুরি কাজ করতে হয়। কাটার আগেই খুব ভালো করে পরিস্কার করতে হয়। তা না হলে মাঝের গন্ধ রয়ে যায়। সরদার প্রথমে পানি দিয়ে ধুলেন। তারপর মাজুনি দিয়ে অনেক ক্ষণ ধরে ঘঁষামাজা হলো। এরপর ঢেলে দিলেন গরম পানি। তারপর আরও কয়েক বার ধুয়ে মাছটিকে একদম সাদা বানিয়ে ফেললেন। এরপর কেটেকুটে নিয়ে বসলেন ট্রলারের পিছনে, রান্না ঘরের সামনে। রাতের খাওয়াটা দারুণ হবে!

সরদার বললেন, আপনারা বড়শি ফেলেন ভাই। বড় মাছ একটা না ধরলে চলবে না!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top