চরপাটার জেলে বহর | রূপান্তরের গল্প ২৬২ | Rupantorer Golpo 262 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৬০ : ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গলো। তখনও ভাটা চলে। ট্রলারের ডেক-এ বিছানা আমার। চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি আমরা কাঁদার উপর। চারপাশে চর জেগেছে। মরাখাজুরে খালের মাঝ দিয়ে পানি নামছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। ভোরের আলোয় সবকিছু খুব বেশি সুন্দর লাগছে।
পাশেই ঘুমাচ্ছেন বেলায়েত সরদার। ডেকে তুললাম। বললাম, জেলেরা সবাই চলে গেছে। আমাকে ডেকে নেওয়ার কথা ছিলো না? লাফ দিয়ে উঠে বসলেন সরদার। চিৎকার করে ডাক দিলেন মামুনকে। ইঞ্জিন রুম থেকে বের হলো সে। বললো, জেলেরা চরপাটা উঠাতে গেছে। মাছ ধরতে গেছে তারা। একটা নৌকা রেখে গেছে। বলছে, আপনারা উঠলে ওটা নিয়ে যাবো।
মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো। বলতে বলতে বেলায়েত সরদার উঠলেন। বললেন, আপনারা নৌকা নিয়ে যেতে পারবেন? মামুন কিন্তু যাবে না। ওকে নিয়ে ট্রলারের তলায় কাজ করতে নামবো। কাল যে ফাটলো সেটা ঠিক না করলে নদীতে যাওয়া যাবে না।
গত রাতে চারগাঙ পারি দেওয়ার সময় বড় রোলিং পার করেছি। ঢেউয়ের ধাক্কায় ট্রলারের তলে ফাটল ধরেছে। এই ভাটায় সেই ফাটল মেরামতের কাজ করা হবে। ঘুম থেকে উঠে তাই দেরি না করে কাজে নেমে পড়লো তারা। মেরামতের সরঞ্জাম বের করে কাঁদায় নেমে পড়লো মামুন। সামনের জোয়ার আসার আগে ট্রলারের ক্ষতিগ্রস্ত জায়গাটা মেরামত করতে হবে। হাতে খুব বেশি সময় নাই।
নৌকা বাইতে পারি সামান্য। খুব ভালো না। তবে এই খাল ধরে যেতে পারবো। স্রোতের বিপরীতে যাওয়া আমার জন্য কষ্ট হবে। বলতে বলতে ট্রলার থেকে নেমে নৌকায় উঠলাম। সরদার বললেন, আপনি কি না খেয়ে যাবেন? বললাম, ক্ষুধা লাগলে চলে আসবো। পানির বোতল আর কিছু শুকনা খাবার দেন। চালিয়ে নিবো। একটা ব্যাগে করে খাবার দাবার তুলে দিলেন সরদার। সাথে দিয়ে দিলেন গুঁড়া দুধের প্যাকেট।
নৌকা ঠেলে কাঁদা থেকে নামিয়ে দিলো মামুন। সাথে ট্রলারের আরেক সহযোগী শহীদুল কাকু। দুজন মিলে নৌকা চালাবো আজ। নৌকার গলুইয়ে বসা আমি। পিছনে শহীদুল কাকু। দুজন মিলে বেয়ে চললাম নৌকা।
বেলায়েত সরদারের ট্রলারটি দূর থেকে দেখতে অন্য রকম লাগে। ঠিক এদিকের ট্রলারগুলোর মতো না। লঞ্চ বডি ট্রলার মানে সামনের দিকটা লঞ্চের মতো কাটা। পানি কেটে এগিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে রোলিং বা বড় বড় ঢেউ কাটাতে সহজ হয় এমন ট্রলারে। ডুয়েস ইঞ্জিনে গিয়ার লাগানো। ডেক-এ দাঁড়িয়ে চালানো যায় এ ট্রলার। গিয়ার টানা যায় ওখানে দাঁড়িয়ে।
সরদার নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন ট্রলার। নিজেই ইঞ্জিনিয়ার। খোলের ভিতরে খোপগুলো করা হয়েছে মাপ মতো। কোনোটাতে মাছ রাখার কেবিন। কোনোটা বরফ রাখার। একটি শুধু বাজার সদা রাখার জায়গা। পিছনের দিকে টয়লেট।
ট্রলারের রান্নাঘরটি করা হয়েছে স্টোরের সাথে। মাঝখানে ইঞ্জিন রুম। বেশ জায়গা নিয়ে করা। তলের কাঠগুলো বেশ মজবুত করে জোড়া লাগানো। আলকতারা মোড়ানো ট্রলারের ফাটা অংশটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানেই মেরামতের কাজ চলবে।
নৌকা বাইতে শুরু করলাম। যাবো উজান ঠেলে পূর্ব দিকে। তবে ভাটার স্রোত এখন কম। শেষ ভাটায় স্রোত কমে আসে। এছাড়া সাথে শহীদুল কাকু আছেন। নৌকা বেয়ে এগিয়ে যেতে খুব কষ্ট হবে না। তবে আমার বৈঠা বাওয়া কাকুর পছন্দ হচ্ছে না। বললেন, আপনি রাখেন কাকু।
হাত পা গুটিয়ে বসলাম। এক বাঁক পেরুতেই নজরে আসলো চরপাটা জাল। এপাশ ওপাশ প্রায় আধা কিলোমিটারের জাল। দুই পাশ থেকে মাছ তুলছে জেলেরা। জেলেরা বললো অন্য প্রান্তে যেতে। এদিকে নাকী জাল উঠে গেছে স্রোতে। মাছ কম। নৌকা বেয়ে এগিয়ে গেলাম। নেমে পড়লাম কাঁদায়।
চিংড়ি আর পারশে মাছ আটকেছে মণকে মণ। তুলে শেষ করা যাচ্ছে না। কাঁদায় ছটফট করছে কোরাল, ইলশে তাড়িয়াল মাছ। আরেকটু দূরে দেখি এক জোড়া কাউইন মাগুর। এক একটার ওজন হবে পাঁচ কেজির ওপর। একটা কই কোরাল মাছ আটকা পড়েছে যার ওজন কুড়ি কেজির মতো হবে।
এদিকে জাবা মাছ পড়ে। কিন্তু এই জালে বড় জাবার খোঁজ পেলাম না। দাতিনা আর পায়রা মাছ আটকেছে, তবে সংখ্যায় কম। জেলেরা বললো, এসব মাছ বেশি পাওয়া যায় পশ্চিম সুন্দরবনে। বললাম, ওদিকে তো অভয়াশ্রম। ওরা বললো, তারপরও যাই। ওদিকে না গেলে মাছ ধরার মজা পাওয়া যায় না। বললাম, ওদিকে তো দস্যুদলও বেশি। তারা কিছু বলে না? জেলেরা বললো, দুইটা দলকে চাঁদা দিলে যাওয়া যায়। বর্ষায় এক গোন জাল টানলে তিন মাসের সংসার খরচ উঠে যায়।
জেলেরা তুমুল ব্যস্ততার মধ্যে। এই ফাঁকে তাদের নৌকায় উঠে চুলা ধরায় শহীদুল কাকু। মিনিট দশের মধ্যে গ্লাস ভর্তি দুধ চা নিয়ে হাজির হলো জালের পাশে। হেমন্তের মিষ্টি সকালটা আরও মধুর হয়ে উঠলো।
জাল পুরোপুরি তুলতে আরও অন্তত দুই ঘন্টা লাগবে। এদিকে কাঁদার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটানা বেড়ে পোকার কামড় খাচ্ছি। শরীরের খোলা অংশের কোনো জায়গা বাদ রাখেনি ওরা। অবস্থা বেগতিক। আমার কষ্ট দেখে জেলেরা বললো, নামার আগে গায়ে একটু কেরোসিন মেখে নিবেন না? বললাম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনারা মাছ ধরেন। শেষ করে যাবো আমি।
কাঁদা থেকে মাছ তুলে রাখা হচ্ছে ড্রামে। একটা ভরলে আরেকটাতে রাখা হচ্ছে মাছ। ভরা ড্রামগুলো তুলে নিচ্ছে নৌকায়। এই বহরের সদস্য ১২ জন। তারা সবাই মাছ ধরায় ব্যস্ত। হাতে সময় নাই। ভাটা থাকতে থাকতে মাছগুলো তুলতে হবে। জোয়ারের পানি এসে গেলে মাছগুলো চলে যাবে।
আধা ঘন্টা পর ভাটা শেষ হলো। কিছুক্ষণ পানি থেমে থাকবে। তারপর আসবে জোয়ার। তলানিতে নেমে যাওয়া পানি আবার বাড়তে শুরু করবে। স্রোত বইবে উল্টোদিকে, মানে পশ্চিমে। সেই স্রোত তীব্র হওয়ার আগে আমরা ফিরবো। চতুর্দশীর জোয়ার, পানি বেশ বড় চাপ দিবে। তখন উজান স্রোতে এগিয়ে যাওয়া খুব কষ্টের। শহীদুল কাকুর একার পক্ষে সম্ভব না।
বড় কাউইন মাছটা নিবো। দুপুরের খাবারের জন্য। বলতেই জেলেরা এনে তুলে দিলো নৌকায়। মাছের মাথাটা কুমিরের মতো বিশাল। দেখলেই ভয় লাগে। দাম দিবো। তবে বুঝতে পারছি না কতো দিবো। শহীদুল কাকুকে বললাম, দাম কতো দেখেন। বলতেই জেলেরা বললো, মাছের দাম দেওয়া লাগবে না। বললাম, দাম না দিয়ে মাছ নিবো না। কিন্তু তারা নাছোড়বান্দা। কোনো ভাবেই দাম নিবে না। বললো, কাল রাতে খাওয়ালেন। একটা করে মুরগি খেতে দিলেন। আরও বাজার দিলেন, পানি দিলেন। আপনার কাছে মাছের দাম নেওয়া যায়?
উপায় নাই। ভাবলাম এই ভালোবাসা ফিরানো যায় না। এরপর কাঁদায় নেমে একটা মাছের ড্রামের কাছে গেলাম। ভিতর থেকে কয়েকটা দাতিনা মাছ নিলাম। সেগুলো রেখে ফেরত দিলাম বড় কাউইন মাছটা। বললাম, আমরা তো কয়েকজন মানুষ। এতো বড় মাছ নিলে নষ্ট হয়ে যাবে।
জেলেরা মন খারাপ করলো। আবার আনন্দও পেলো। বড় মাছের বাজার দর ভালো। এমন একটা মাছের দাম দিয়ে প্রান্তিক পরিবারের মাসের চাল খরচ হয়ে যায়। জেলে বহরের প্রধান বললেন, এই জঙ্গলে কোনো সাহেবের সাথে দেখা হলে সবার আগে বড় মাছগুলো তুলে নেয়। বললাম, আমি তো আর সাহেব না।