হরিণ শিকারীদের তান্ডব | রূপান্তরের গল্প ২৭০ | Rupantorer Golpo 270 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৭০ : বুকের ভিতর ধকধক করছে। শ্বাস প্রশ্বাস চলছে দ্রুত গতিতে। মনে হচ্ছে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো না। লাঠিতে ভর করে তবুও এক পা করে এগিয়ে একটি বসার জায়গা খুঁজছি। একটা ভাঙ্গা কেওড়া গাছ পড়ে আছে সামনে। সেখানে যেতেই দেখি বিশাল এক সাপ সরসর করে দৌড়ে পালাচ্ছে। ভাঙ্গা গাছটির নিচে ছিলো সে। কেওড়া বনের ভিতরটা ফাঁকা বলে দেখতে পেলাম। ঝোপঝাড় থাকলে কী হতো কে জানে!
দৌড়ে ফিরে আসলাম আগের জায়গায়। মামুন আমার হাত ধরে রেখেছে। ধকধকানিটা বেড়েছে আরও কয়েক গুন। কেওড়া বনের মাছখানের এই জায়গাটা বেশ পরিস্কার। চারপাশে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। পাশেই বসে পড়লো মামুন। তারপর চারপাশে ভালো করে দেখে নিলো। সুন্দরবনে আবার দাঁড়িয়ে থাকে দূরের কিছু দেখা যায় না। কুঁজো হয়ে বা বসে পড়লে চার পাশটা বেশ ভালো দেখা যায়।
কিছু দেখা যাচ্ছে মামুন? জানতে চাইলাম। সে বললো, চারপাশে কিছু নাই, কেউ নাই। বেলায়েত সরদারসহ অন্যরা চারপাশে ছড়িয়ে গেছে। যারা দৌড়ে পালালো তাদের অপকর্মের খোঁজ করতে গেছে ওরা। কিন্তু এভাবে ছড়িয়ে যাওয়ার কথা ওদের বলিনি।
খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। অপরাধীরা যদি আমাদের কাউকে একা পায় তবে আক্রমণ করে বসতে পারে। এছাড়া বাঘের দুশ্চিন্তা তো থাকেই। তার ওপর যে বিশাল আকৃতির সাপ দেখলাম! যদি সাপে কাটে তাহলে কী হবে?
মামুন বললো, ওদের কিছু হবে না ভাই। আপনি দুশ্চিন্তা করেন না। বললাম, যে সাপটা দেখলাম ওর নাম কী? একদম কালো রঙ এর সাপ ছিলো ওটা। বললো, কেউটে সাপ। মানে ব্ল্যাক কোবরা? সর্বনাশ! এটা কামড়ালে তো আর জীবন নিয়ে বাড়ি ফেরা যাবে না।
মামুন বললো, এই বাদাবনে সাপে কাটলে মানুষের আর মালে আসা হতো না। মানে এই সুন্দরবনে যদি সাপে কাটতো তাহলে আর এই জেলে-বাওয়ালীদের বনে আসা লাগতো না। সত্যি বলতে শুধু সাপ না, বাঘসহ বনের প্রাণিরা আক্রমণাত্মক হলে সুন্দরবনে ঢুকতেই পারতো না মানুষ। ওদের কেউ বিরক্ত করে না বলেই বেশ শান্ত তারা। মানুষ এড়িয়ে চলে। তারপরও মাঝে মাঝে অঘটন ঘটে।
একটু শান্ত হলো পরিবেশ। বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। এর মধ্যে মামুন বলে ওদের চুলা এখনও জ্বলছে ভাই। একটি চা জ্বালাই? ভালো প্রস্তাব। আপাতত এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করারও নাই। এগিয়ে গেলাম। চুলার ওপর রাখা পাতিলটি সরানো হলো। পাশে আরেকটি বড় পাতিল। ঢাকনা তুলে দেখি মাংসের তরকারি। মামুন বলে, এরা হরিণ শিকারী ভাই। এই দেখেন হরিণের মাংস। থ হয়ে গেলাম। এবার নিশ্চিত হলাম, দৌড়ে পালালো ওরা কারা!
পাতিলটি সরিয়ে মামুন আরেকটি ছোট কড়াই চুলায় তুললো। কড়াই তো না। মনে হলো ভাগাড় থেকে কুড়িয়ে নেওয়া কোনো ভাঙ্গা পাত্র। পাশেই টব এর মধ্যে পানি। তার পাশে আবার ডিটারজেন্ট পাউডার রাখা। পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিলাম কড়াইটি।
চুলার আগুন ভালো করে জ্বালিয়ে নিলো মামুন। তারপর ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দুই কাপ চা হবে সেই পরিমান পানি ঢেলে দিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে টগবগ করে পানি ফুটলো। তার মধ্যে চা পাতা ছেড়ে, চিনি আর দুধ একসাথে মিশিয়ে তৈরি হলো দুধ চা। প্লাস্টিকের একটা গ্লাস ছিলো সেখানে। তার মধ্যে চা ঢেলে নিলাম।
চুমুক দিতে দিতে ভাবছি, আমি এ কেমন জীবন বেছে নিলাম? আমার তো ঢাকায় থাকার কথা। ছিমছাম জীবন ছিলো। কিন্তু সেই জীবন থেকে বেরিয়ে এই ঝুঁকি আর ঝক্কির জীবনে কেন আসলাম? আরও নানা রকমের ভাবনা আসছে মাথায়।
ভাবছি, আমাদের এই কষ্টের ফসল নিশ্চয়ই একদিন ঘরে উঠবে। সফল হলে ব্যক্তিগত ভাবে আমি পাবো সম্মান আর ভালোবাসা। সফল হলে এই সুন্দরবনের মানুষেরা নিরাপদ জীবন পাবে। সেই সাথে স্বস্তি পাবে সুন্দরবন। মামুনকে সাথে নিয়ে সেখানেই বসে আছি। দুইজন দুই দিকে ফিরে বসেছি যাতে চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়।
কয়েক মিনিট পর কুঁই এর শব্দ পেলাম। আমাদের ডানপাশ থেকে আসছে সেই ইশারা। সম্ভবত বেলায়েত সরদাররা এদিকেই গেছে। মামুন বললো, এটা বেলায়েত ভাইয়ের গলা। উঠে দাঁড়ালাম। মামুন পাল্টা কুঁই দিলো। মিনিট দুই এর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হলো। তারপর সরদার এসে দাঁড়ালেন আমাদের সামনে। কুঁই দিয়ে বাকীদের ডাকা হলো। পাল্টা ইশারা আসলো। আরও কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই হাজির হলো।
বেলায়েত সরদার বলতে শুরু করলেন। ও ভাই। আপনি এবার ক্যামেরা আনলে বিরাট নিউজ করতে পারতেন। বললাম, কী আছে ওদিকে? কী দেখে আসলেন? বলেন তাড়াতাড়ি। সরদার যা বললেন, তাতে অবাক হওয়া ছাড়া কিছু করার নাই। বললাম, চলেন যাই। সবাই মিলে হাঁটা শুরু করলাম। জায়গা মতো পৌঁছাতে সময় লাগবে কুড়ি মিনিটের মতো।
সবার সামনে সরদার। তারপর সারিবদ্ধ ভাবে হেঁটে চললাম। পাশ দিয়ে হাঁটছে আমাদের সাথে থাকা সেই শিকারীদের একজন। বললো, আমরা কিন্তু ডোয়া তুলে নিয়ে গেছি ভাই। এখন যা দেখবেন তা শিকারীদের কাজ। আমরা জানতাম না যে এখানে হরিণ শিকারীরা আছে। ফাঁদ পাতার সময়ও খেয়াল করিনি। কিন্তু ডোয়া তুলে আনার সময় ওদের দেখছি। বললাম, সেকথা তো আর আমাকে বলেননি। সে বললো, ভয়ে বলিনি ভাই।
কয়েক মিনিটে পৌঁছে গেলাম জায়গা মতো। রীতিমতো খোয়াড় বানিয়ে ফেলেছে। ভিতরে ছয়টি হরিণ বাঁধা। সবগুলো শিঙওয়ালা মানে মর্দা হরিণ। মাঝারি ও বড় মিলিয়ে ছয়টি হরিণ একসাথে। আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। অন্যদের বললাম, এখনই দড়ি কেটে হরিণগুলো ছাড়েন। ইশ রে! সাথে ক্যামেরা থাকলে ছবি তুলতাম।
অভাবনীয় এই দৃশ্যের ছবি তোলা হলো না। আফসোস হচ্ছে। মোবাইল ফোনটিও ট্রলারে রেখে এসেছি। সাথে যাদের ফোন আছে কোনোটিই স্মার্ট ফোন না। দড়ি দিয়ে তৈরি ফাঁদ- ডোয়া দিয়ে হরিণগুলো ধরছে শিকারীরা। জীবিত রেখেছে সম্ভবত রাস মেলায় বেড়াতে আসা কাস্টোমারদের জন্য। মাথাটা আরও গরম হয়ে গেলো।
দা দিয়ে একটার পর একটা দড়ি কাটা হলো। ছাড়া পেয়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফ আর দৌড় দিয়ে হরিণগুলো হারিয়ে গেলো বনের ভিতর। এই অভিজ্ঞতা জীবনে কখনও হবে ভাবিনি। মনটা খারাপ লাগছে। আবার ওদের ছেড়ে দিতে পেরে ভালোও লাগছে। অনুভূতি অন্য রকম।
হরিণশূণ্য খোয়াড়টি গড়ান আর সুন্দরী গাছ কেটে বানানো। বাঘ বা বন্য শুকর ঠেকাতে এটি তৈরি করেছে। জেলেরা বললো, এতো বছর ধরে জঙ্গল করেও এই দৃশ্য কখনও দেখেনি তারা। দা দিয়ে কেটে ফেলা হলো সে খোয়াড়। তারপর আরেক দিকে হাঁটা দিলাম। সরদার বললেন, ডোয়া পাতা আছে আরও নিচের দিকে। বলেই হাঁটা দিলেন। পিছু নিলাম আমরা।
হাঁটতে পারছি না। কেটেকুটে গেছে পায়ের তালু। খালি পা। নিশ্চয়ই কাঁটাও ঢুকেছে। উত্তেজনায় এতোক্ষণ খেয়াল করিনি এসব। অন্যদিকে বাইড়ে পোকার কামড়ে পুরো শরীর ফুলে গেছে। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর। হয়রান হলেও কিছু করার নাই। সুন্দরবন এমনই। দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে না। সব কাজ সেরে পুরো জোয়ারের আগেই নৌকায় ফিরতে হবে।
প্রায় আধা ঘন্টা একটানা হাটলাম। পথে কয়েকটি জোলা খাল পড়লো। ভাটায় পানি নেমে গেলেও কাদায় একাকার সেই খালগুলো। ভুল করে সেখানে পা দিলে দেবে যাচ্ছে উরু পর্যন্ত। টেনেটুনে হেঁটে চলছি। থামার কথা এখন বলাও যাবে না। মনের সব শক্তি এক করে ছুটছি সুন্দরবনের মানুষদের সাথে।
বড় একটা কেওড়া গাছের সাথে বাঁধা দড়ি। এখান থেকে সোজা দক্ষিণে চলে গেছে হরিণ ধরার ফাঁদটি। ওরা ভেবেছিলো যে ডোয়াটি তুলে ফেলবে। তবে আমি বললাম, তোলার দরকার নাই। কেটে ফেলেন সব। এরপর যে কয়জনের হাতে দা আছে তারা শুরু করলো কাজ। উপর আর নিচের দড়িগুলো বেশ শক্ত।
একটু কষ্ট হলেও কাজ এগিয়ে নিলো সবাই মিলে। প্রায় এক ঘন্টা লাগলো পুরো ফাঁদটি কাটতে। কাটা দড়িগুলো তুলে একসাথে করলাম। তারপর মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলা হলো। এদিকে আরও ডোয়া থাকতে পারে। তবে আর ঝুঁকি নিবো না। আমরা বনের অনেক ভিতরে চলে এসেছি। পরে পথ খুঁজে ফিরতে পারবো না।
ফিরে আসলাম প্রথম জায়গায়। যেখান থেকে দৌড়ে পালিয়েছিলো শিকারীরা। সরদার বললেন, এখানেও অ্যাকশন চালাতে হবে ভাই। বললাম, শিকারীরা তো না খেয়ে মরবে ভাই। বলতে বলতে অন্যরা হাঁড়ি পাতিলসহ অন্য জিনিষগুলো একসাথে করলো।
তরকারির হাঁড়ি থেকে হরিণের মাংসের তরকারি মাটিতে ফেলে দিলো মামুন। ভাত, পানি, তেল-মসলা আর চালের বস্তাটি গুছিয়ে একপাশে রাখলাম। এরপর হাঁটা দিলাম খালের দিকে। সেখানে আমাদের নৌকাগুলো। পথ চিনে সে পর্যন্ত যেতে হবে। হাঁটতে পারছি না আর।
ছবি: সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ
ঘটনা : ২০১৬ সালের মধ্য নভেম্বর