রূপান্তরের গল্প ২৭৯ | Rupantorer Golpo 279

বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া | রূপান্তরের গল্প ২৭৯

বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া | রূপান্তরের গল্প ২৭৯ | Rupantorer Golpo 279 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৭৯ : দুবলার চরের রাসমেলায় আসার সময় জেলেদের স্বজনরা নিয়ে আসে শাক-সবজি আল ফল। নিয়ে যায় মেলা থেকে কেনা জিনিষপত্র আর নিউমার্কেটের গজা। এদিকে কাঁচা সবজি বেশি দিন ভালো থাকে না। তারপরও বেশি বেশি নিয়ে আসে স্বজনরা।

সুন্দরবনের শেষ প্রান্তের এই সাময়িক জনপদে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। কিন্তু শাক সবজি পাওয়া যায় না। চরে এসেই জেলেরা বীজ ফেলে। সেই সবজি হতে সময় লাগে। মৌসুমের মাঝামাঝি সময় শাক ওঠে। লাউ, মিষ্টি কুমড়া হয় মৌসুমের শেষের দিকে।

রাসমেলার এই কয়দিন চরের ঘরে ঘরে কাঁচা সবজিতে ভরা থাকে। মাছ আর সবজি দিয়ে রান্নাটা বেশ উপভোগ করে তারা। এর আগে আর পরে মাছ আর আলুই ভরসা। কাঁচা মরিচ তাদের খুব প্রিয়। কিন্তু এদিকে রান্নাবান্না চলে শুকনা মরিচ দিয়ে। গফুর কাকার ঘরে বসে এসব গল্প শুনছি। চলছে রাতের খাওয়া দাওয়া।

চিংড়ি ভুনার সাথে গরম ভাত। সাথে কাঁচা মরিচের ভর্তা। সরদার কয়েক ঘর থেকে অনেকগুলো কাঁচা মরিচ নগদ টাকায় কিনে এনেছেন। সরদারের নগদ টাকার বাজার মানে মানে বিনা পয়সার বাজার।

গরম ভাতের সাথে কয়েকটা কাঁচা মরিচ সেদ্ধ দেওয়া ছিলো। এরপর লবণ আর সরিষার তেল দিয়ে মরিচ ভর্তা হলো। সরদারের হাতের যেকোনো ভর্তার আলাদা স্বাদ হয়। খাবো না খাবো না করে অনেকগুলো ভাত খেয়ে ফেললাম। তারপর জেলেদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ালাম।

চরের বেশির ভাগ মানুষ সাগরে আছে। চরে আছে সাবাড় মালিকরা, শুঁটকির শ্রমিক আর বাবুর্চিরা। প্রতিটি শুঁটকির ঘরের সাথে আছে রান্নাঘর। সেখানে চুলা জ্বলে প্রায় চব্বিশ ঘন্টা। রান্না হয় দুই বেলা। তবে চা চলে দিন-রাত।

দুবলার চরের জেলেদের সাথে পরিচয় হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে শুঁটকির সাবাড় মালিক-শ্রমিকরা আসছে দেখা করতে। অনেক গল্প, অনেক কথা। বেশি কথা হলো সুন্দরবনের ডাকাতদের নিয়ে। তারা জানে মাস্টার বাহিনী, ইলিয়াস, মজনুসহ দস্যুদলগুলো যে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু কী ভাবে হলো এসব, এর মাঝখানে একজন সাংবাদিক কাজ করছে, এসব নিয়ে তাদের ধারণা নাই।

অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চললো। গভীর রাতে শ’খানেক মানুষকে বিদায় দিতে গিয়ে বুঝলাম এই মানুষগুলোর অনেক বিপদ। সেই বিপদ থেকে মুক্তির কোনো পথ নাই। সবচেয়ে কষ্টের কথা হলো যে এই কথাগুলো বলার কোনো জায়গা নাই তাদের। সকালে চিংড়ি মাছ কেড়ে নেওয়ার পর আমার ভূমিকার গল্প শুনেছে তারা। সেই ঘটনাটি ছড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।

রাতের বেলা আবারও সেই নৌকায় ফিরলাম। আলী আজমের নৌকা। আরামদায়ক বিছানাটি আমাকে ডাকছে। রাতে এখানেই থাকবো। বেলায়েত সরদারসহ উঠে পড়লাম। আজও আকাশে বিশাল চাঁদ। তবে গতকালকের মতো হই হল্লা নাই। তীর্থযাত্রী আর পর্যটকরা ফিরে গেছে। দুবলার চর ফিরেছে আগের চেহারায়।

ঘুম ভাঙ্গলো একটু বেলা করে। ভরা জোয়ার। সাগর থেকে আসা ট্রলারগুলো ভিড়েছে। কোনো ট্রলারের মাছ নামানো শেষ। সেগুলো ধুয়ে ভ্যান অথবা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে জেলেরা। অনেকগুলো ট্রলার এখনও মাছে ভর্তি। নামানো হচ্ছে মাছ। ব্যস্ততা চারপাশে। তরুণ নামের এক জেলে এসে বললেন, ওঠেন ভাই। সাগরে চলেন। মাছ ধরা দেখবেন।

লাফ দিয়ে উঠলাম। সাগরে মাছ ধরা সেভাবে দেখা হয়নি আমার। তরুন দা বললেন, সাগর থেকে ফিরেছে তার ট্রলার। এক ঘন্টার মধ্যে মাছ নামানো শেষ হবে। সামনের ভাটায় নেমে যাবে তারা। চাইলে এই ট্রলারে করেই সাগরে যেতে পারি। উঠে বসলাম। বেলায়েত সরদারকে ডেকে তুললাম। নামতে গিয়ে দেখি গতকালকের সেই প্রবীন মানুষটি বসা। হাসি বিনিময় হলো। জানতে চাইলেন ফিরবো কবে? বললাম, দু্ই-এক দিনের দিনের মধ্যে ফিরে যাবো। আপনি কিছু বলবেন? উনি বললেন, না কাকা, এমনি জিজ্ঞেস করলাম। বলেই উঠে হাঁটা দিলেন তিনি। মনে হয় উনি কিছু বলতে চান।

পেছন থেকে তাড়া দিলেন বেলায়েত সরদার। উঠে পড়লাম। গতকালকের সেই কিশোর পাশেই দাঁড়ানো ছিলো। নৌকা থেকে নামার সাথে সাথে বিছানা গুছিয়ে ফেললো সে। তারপর চা উঠালো। হাতমুখ ধুয়ে এসে চা নিলাম। বেলায়েত সরদার হাঁটলেন নিউমার্কেটের দিকে।

সাগরে যাবো। তাই চাল-ডালসহ কিছু বাজার করতে গেলেন। হাতে টাকা দিয়ে বললাম, আজকে আর আপনি আপনার নগদ টাকার বাজার করবেন না।

সাগরে গেলে অনেক জেলের সাথে দেখা হবে। তাদের জন্য কিছু শুকনা খাবার নিতে বললাম। চা, চিনি, গুঁড়া দুধ নিতে বললাম। তরুণ দা বললেন, কিছু নিতে হবে না দাদা। ট্রলারে সব কিছুই আছে। এছাড়া বেশি সময় থাকবো না। সামনের ভাটায় জাল তুলবো, মাছ নিয়ে ফেরত আসবো।

এক ঘন্টার মধ্যে আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। জোয়ার শেষ হয়ে এতোক্ষণে ভাটা লেগেছে। তরুণ দা বললেন, ট্রলার ছাড়বো। আর দেরি করা যাবে না। এর মধ্যে বেলায়েত সরদার বাজার সদা নিয়ে আসলেন। নৌকা বেয়ে সেই ট্রলারে নামিয়ে দিলো আলী আজম। বললো, আমি যেতে পারছি না ভাই। এদিকে কিছু মাছ কেনাকাটার কাজ আছে। বললাম, ব্যবসার ক্ষতি করে কিছু করতে হবে না ভাই। ফিরে দেখা হবে।

ট্রলার ছাড়লো। মাঝারি আকারের ট্রলার। ডুয়েস ইঞ্জিন। বোয়ালিয়ার খাল থেকে লগি দিয়ে বেয়ে বের হলাম আলোর কোলে। এখান থেকে আমরা মেহের আলীর খাল দিয়ে বের হবো সাগরে। তারপর ঘন্টা চারেকের পথ। একটু ভয় পাচ্ছি। বেশ দূরের পথ। উত্তাল সাগরে এই ট্রলার নিয়মিত চলাফেরা করে। তাই ভরসা করলাম।

কুয়াশা কেটে গেছে। রোদ বেশ কড়া। গোন চলছে বলে পানি একটু গরম। তবে সরদার আছে সাথে। অসুবিধা হবে না। সাগরে ছায়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। ট্রলারেও ছই নাই। তাই মাথার ওপর একটু ছায়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বললাম, ছায়ার দরকার নাই। সরদার বললেন, দরকার আছে না নাই সেটা সাগরে গেলে বুঝবেন।

বেলায়েত সরদার আর তরুণ দা মিলে চারপাশে খুঁটি দিয়ে একটি বিছানার চাদর টানিয়ে দিলেন। সামিয়ানার মতো করে বাঁধা হলো সেই চাদর।

ছুটছি আমরা। ডুয়েস ইঞ্জিন। পুরো গতিতে চলছে। আধা ঘন্টার মধ্যে খাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম সাগরে। মেহের আলীর চর পড়লো হাতের ডানে। সাগরের মুখের এই শুঁটকি পল্লীটি মেজর জিয়া সাহেবের। ওখানে বেশ বড় একটি পুকুর আছে। সাগরের জেলেরা এখান থেকে খাওয়ার পানি নেয়। এখনও দেখলাম অনেকগুলো ট্রলার ভিড়ানো সেখানে। যে যার মতো করে পানি বয়ে নিয়ে আসছে। পানি লোড দেওয়া হলেই রওনা দিবে তারা।

সাগরের পানি নাকী পুকুরের মতো ঠান্ডা! বললেন তরুন দা। সরদার বললেন, হাল্কা দুলবে ট্রলার। সমস্যা হবে না। ভাটার স্রোতে তীব্র বেগে ছুটলে আমাদের ট্রলার। বেশ ভালো লাগছে। ঢেউ আছে। তবে সেই ঢেউ কাটিয়ে ভালোই চলছে ট্রলার। গলুই-এ গিয়ে বসলাম। ভাবলাম পুরোটা পথ এখানে বসে কাটাবো। খুব ভালো লাগছে। পাশ দিয়ে, দূর দিয়ে ছুটছে আরও অনেকগুলো ট্রলার। সবাই যে যার জালের কাছে যাবে।

হঠাৎ করে ঢেউ শুরু হলো। কোনো আলামত ছিলো না। শীত মৌসুমে সাগর এমন উত্তালও হয় না। কিন্তু সাগর কখন কেমন আচরণ করবে সে কথা কেউ জানে না। এই মুহুর্তে বসতেও পারছি না। মনে হলো আকাশ বাতাস এক হয়ে যাচ্ছে। ধুপ করে বসে পড়লাম। সরদার এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন পেছনের দিকে। শক্ত করে একটি বাঁশ ধরে বসে থাকলাম। যতোটুকু বুঝলাম এই রোলিং আর থামবে না। দীর্ঘ সময় আমাদের এভাবেই চলতে হবে।

একটানা তিন ঘন্টা চললো ট্রলার। চারপাশে সাগর আর সাগর। এদিকে পানি বেশ স্বচ্ছ। ভাবছি এই কুল কিনারা বিহীন জায়গায় জেলেরা পথ চিনে চলে কী করে? চারদিকে কোনো নিশানা নাই। মাঝে মাঝে বয়া আছে। কুয়াশা থাকলে কিংবা রাতের বেলা কী করে তারা পথ চিনে চলে সেটা ভাবতে ভাবতে হয়রান আমি।

সবকিছু নিয়ে বেলায়েত সরদার বেশ মজা পাচ্ছেন। আমার অবস্থা দেখে একটু মজাও নিচ্ছেন। সুকানি হাতে দাঁড়ালেন তিনি। ট্রলার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আমাকে পাশে ডাকলেন। উঠবো উঠবো করছি। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। যদি উল্টে পড়ে যাই?

সাগরে বড় বড় ঢেউ আছে। কিন্তু ট্রলার আগের মতো দুলছে না। এটা সরদারের কেরামতি। ঢেউ কাটিয়ে কী করে ট্রলার চালাতে হয় তিনি জানেন। এর আগে যার হাতে সুকানি ছিলো সে বয়সে তরুণ। ঢেউ কাটিয়ে চলার অভ্যাস নাই। অবশ্য তার প্রয়োজনও হয় না। কারণ সাগরের যে ঢেউ আমরা দেখছি সেটি তাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয়। এর মধ্যেই তারা স্বাভাবিক সব কাজ সারতে পারে।

দুইট জাল ফেলা সাগরে। সেখানে একটি ট্রলার বাঁধা। ঢেউ-এ ১৫-২০ ফুট উঠছে আর নামছে। ভাবছি কী করে ভিড়বো সেখানে? ভাবতে ভাবতে পৌঁছে গেলাম সেই ট্রলারের কাছে। চারপাশে চক্কর দিয়ে ওই ট্রলারের গায়ে ভিড়লো আমাদের ট্রলার। ওরা জানে এখন কী করতে হবে।

দুই ট্রলারের চার জন তৈরি ছিলো। এপাশ থেকে দড়ি ছুঁড়ে মারা হলো। ওপাশের দুইজন ধরে বেঁধে ফেললো। উত্তাল সাগরের মধ্যে ট্রলার একসাথে বেঁধে ফেলা হলো। এবার এক সাথে দুলছে দুটি ট্রলার। ভাটা শেষ হতে আরও ঘন্টা খানেক সময় লাগবে। তখনই উঠানো হবে জাল। তার আগে চায়ের আয়োজন করলো জেলেরা।

রোলিং-এর মধ্যে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। সেই অবস্থায় চুলা জ্বালালো তারা। হাঁড়িতে পানি তুললো। পানি গরম হলো। চা পাতা দিলো। লিকার হলো। সবাই রঙ চা খাবে। শুধু আমার জন্য তৈরি হলো দুধ চা। সেই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ট্রলারের মাঝখানে বসলাম। চায়ে চুমুক দিচ্ছি। গল্প চলছে। পুরোটা সময় আমাকে ধরে রেখেছে একজন।

ভাটা শেষ হলো। পানি একটু ঠান্ডা হয়ে এসেছে। জেলেরা নেমে পড়লো কাজে। আমি অপেক্ষা করছি। মাছ দেখবো। এখানকার জালে নাকী রূপচাঁদার ঝাক ধরা পড়ে!

জাল টানছে জেলেরা। টলছে ট্রলার। চায়ের কাপ রেখে লাফ দিয়ে গেলাম জালের ট্রলারে। নিজেও সামিল হলাম। জাল টানছি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, হাতে হাত রেখে। এই জায়গার নাম ফেয়ারওয়ের বয়া। একটু দূরে বড় বড় জাহাজ নোঙ্গর করা। এখানে মাছ ধরা পড়ে বেশি। জেলেরাও বেশি আসে। অপহরণ করতে বনদস্যুরাও আসে এদিকে। মাঝে মাঝে পত্রিকায় খবর দেখি, বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকা থেকে …. জন জেলেকে অপহরণ করেছে ওমুক দস্যুবাহিনী….!!

ছবি: ফেয়ারওয়ে বয়া
ঘটনা: ২০১৬

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top