রূপান্তরের গল্প ২৮০ | Rupantorer Golpo 280

বেন্দী জাল উছোল ভরা মাছ | রূপান্তরের গল্প ২৮০

বেন্দী জাল উছোল ভরা মাছ | রূপান্তরের গল্প ২৮০ | Rupantorer Golpo 280 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৮০ : ছন্দে ছন্দে উঠছে জাল। সাগরের নিচে ফেলা বড় বড় জালগুলোকে টেনে তোলা অনেকটা পাহাড় টেনে গোলার মতো বিষয়। মানুষগুলো এতো শক্তি কোত্থেকে পায় জানি না। এটুকু বুঝি, এই কাজ করতে শারীরিক সক্ষমতার সাথে সাথে মনের জোরও লাগে। এছাড়া একসাথে হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যে পাহাড়ও সরানো সম্ভব তা এই মানুষগুলোকে দেখে শিখি।

শ্লোগান দিচ্ছে একজন। সাথে দড়ি ধরে হেঁইয়ো হেঁইয়ো করে টান দিচ্ছে জেলেরা। দড়ি বলতে সাধারণ কিছু না। মোটা তারের দড়ি। খালি হাতে সেই দড়ি ধরে চলছে টান। ধীরে ধীরে উঠে আসছে জাল। পাশের জেলে বললো, পুরোপুরি উঠতে আরও সময় লাগবে। কেবল তো শুরু!

মৌসুমের শুরুতে এই জেলেদের হাত থাকে মোলায়েম। তারপর শুরু হয় জাল-দড়ি টানাটানি। বিশাল বিশাল নোঙ্গর ফেলে সাগরে। তারের দড়ি দিয়ে বাঁধা সেই নোঙ্গর। লবণ পানিতে ভেজা দড়িতে লাগে হাত। এরপর হয় ক্ষতবিক্ষত। প্রথম গোনে সেই কাটা হাতের তালুতে লবণ পানি লাগলেও জ্বলে। ভাত খেতে কষ্ট হয়। পরের গোনে নরম হাতের তালুগুলো পাথরে পরিণত হয়। তখন মুঠ করতে পারে না তারা। ভাবি, হাত মুঠ না করে কী করে চলে তাদের দৈনন্দিন জীবন?

বেন্দী জালের ফাঁসে ফাঁসে আটকে আছে লইট্যা, ফাইস্যা মাছ। কখনও দেখছি ঘাগড়া টেংড়া। একটু পর পর জালের ফাঁস গলে বেরিয়ে আসছে জেলি ফিস। হাঙ্গরের বাচ্চাগুলোও লটকে আছে সেখানে। কিছুক্ষণ পর দুই জন জালের দুই পাশে চলে গেলো। একজন দড়িগুলো গুছিয়ে জালের ওপর লাঠি দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে। আরেকজন সাগরে নেমে জালের ফাঁসে আটনাকো ডাল-পালা পরিস্কার করছে। অদ্ভুত সে দৃশ্য।

অর্ধেক জাল উঠতে উঠতে অনেকগুলো মাছের দেখা পেলাম। বেশির ভাগই লইট্যা মাছ। আমিও এবার জালে হাত দিলাম। মাছ খুলতে গিয়ে দেখি জীবিত লইট্যাগুলো ছটফট করছে। ধরতেই কামড়ে ধরলো। লইট্যা মাছের ধারালো আর ছোট ছোট দাঁতগুলো প্রথম দেখলাম। কয়েকটি ছুরি মাছও ধরা পড়েছে জালে। কিন্তু তাতে হাত দেওয়ার সাহস হলো না। জেলেরাও ছুরির ধারালো দাঁতের বিষয়ে সতর্ক করলো।

বেশ মজা পাচ্ছি। জাল থেকে মাছ ছাড়াতে গিয়ে সাগরে চলা বিশাল বিশাল রোলিং এর কথা ভুলে গেছিলাম। যখন দুটি ট্রলারের নিচ দিয়ে বিশাল বড় একটা ঢেউ পার হলো তখন বুঝলাম, আমরা পুকুরে না, জাল তুলছি গভীর সাগরে। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আরেকটা ঢেউ এসে ধাক্কা দিলো। ভয়ঙ্কর অবস্থা!

দ্রুত ট্রলারটি না সরালে হয়তো দুটো ট্রলারই ভেঙ্গে যেতে পারে। জেলেদের একজন পাশের ট্রলারে গেলো। দড়ি খুলে ইঞ্জিন চালু করে দ্রুত সরে গেলো একটু দূরে। ততোক্ষণে বাতাস ছেড়েছে বেশ। সাগর আবার উত্তাল হলো। একটু দূর থেকে আমাদের ট্রলারটিকে দেখে মনে হচ্ছে ছোট্ট একটি খরকুটো ভাসছে। তাড়াতাড়ি সামিয়ানার মতো করে টানানো চাদরটি খুলে ফেললো ছেলেটি। তারপর ইঞ্জিনে পূর্ণ গতি দিয়ে সরে পড়লো আরেকটু দূরে।

উত্তাল সাগরের মধ্যে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতেই বেগ পেতে হচ্ছে। অথচ এর মধ্যেই জেলেরা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ জাল উঠানোর নির্দিষ্ট সময় পার করা যাবে না। তরুন দা বললেন, ভাটা শেষে জোয়ার আসলে আর জাল তোলা সম্ভব হবে না। জালে আটকানো মাছগুলো তখন পানির নিচে পড়ে থাকবে ১২ ঘন্টার জন্য। ততোক্ষণে নষ্ট হবে সেগুলো। পাশাপাশি ভরা উছোলে নতুন করে মাছও ঢুকবে না।

উছোল কী? সরদার তখন ব্যস্ত জাল তোলায়। বললেন, এতো বছর সাগরে আসেন উছোল চিনেন না ভাই? বললাম, না দেখালে চিনবো কী করে? আসলে সাগরের জালগুলো সম্পর্কে আমার ধারণা কম। এটুকু জানি এই জালগুলো বৈধ না। অথচ পুরো সাগর জুড়ে বেন্দী জাল ছাড়া অন্য কোনো জাল দেখছি না। এর মধ্যে একজন ঝাঁপ দিলো সাগরে। ডুব দিয়ে গেলো পানির নিচে। তারপর একটি দড়ি নিয়ে উঠে আসলো ট্রলারে। জালের গা বেয়ে তাদের পানিতে ওঠা নামা দেখতে দারুণ লাগছে। মনে হচ্ছে এই সাগরই তাদের ঘরবাড়ি।

দড়িটি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন সরদার। বললেন, টানেন! একটু টানার পর আর পারছি না। এবার আরেকজন এসে হাত লাগালো। দুইজন মিলে টেনে তুললাম। উছোল ভর্তি মাছ। জালের মুখ বেশ প্রশস্ত। তারপর সরু হতে হতে শেষ প্রান্তে গিয়ে ঠেকে মাছ। সেখানেই জালের সবচেয়ে সরু আর লম্বা অংশটি থাকে। এর নামই উছোল। জালে যতো মাছ ঢোকে সব গিয়ে ঢোকে সেখানে। উছোলের শেষ প্রান্ত শক্ত করে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। ট্রলারে তুলে সেই বাঁধন খুলে দেওয়া হয়। জালের মাছগুলো পড়ে ট্রলারে।

ঝরঝর করে উছোল থেকে বের হলো অনেকগুলো মাছ। সব মিলিয়ে দুই থেকে তিন মণ হবে। বারোমিশালী মাছ। বড় মাছ নাই। আছে চিংড়ি, লইট্যা, ছুরি, ফাইসা, খয়রা, টেংড়া আর রূপচাঁদা। অনেকগুলো কাঁকড়া আছে। আছে অনেকগুলো সাপ। এছাড়া নাম না জানা পোকা মাকড়ের অভাব নাই। মাঝ বাছতে গিয়ে সাপ দেখে ভীষণ ভয় পেলাম। সাপের ভয় আমার ছোটবেলা থেকেই। আমার অবস্থা দেখে হাসাহাসি করছে জেলেরা। বলছে, এই সাপ কামড়ায় না। এই সাপে বিষ নাই। বলতে বলতে লেজ ধরে একটা একটা করে সাপ সাগরে ফেললো তারা।

সাগরের সাপ সম্পর্কে খুব বেশি ধারণা নাই। এবিষয়ে যতোটুকু জানি, সাগরের সাপ বিষধর হয়। বিষ ঢাললে বাঁচার সুযোগ নাই বললেই চলে। খুব বিপদে না পড়লে বিষ ঢালে না এরা। জেলেরা বলে কেরেল সাপ। যতোটুকু মনে পড়ছে এর ইংরেজি সাম হুক নোজড সী স্নেক। এর অ্যান্টিভেনম আমাদের দেশে নাই। এর বিষ সম্পর্কে বলতেই উড়িয়ে দিলো তারা। একটি জীবিত সাপের লেজ ধরে নিয়ে মজার করছে। এক জেলে বললো, এই সাপ কামড়ালেও কিছু হয় না। বললাম, বিষ না ঢাললে কিছু হবে না। কিন্তু বিষ ঢাললে বাঁচবেন না। আপনারা ভালো মানের গ্লাভস পড়তে পারেন। আর লাঠি দিয়ে সাপ আর পোকামাকড় সরাবেন। এই সাগরে বিপদ হলে কিন্তু কেউ বাঁচাতে পারবে না।

আমরা যেখানে আছি সেখান থেকে সবচেয়ে কাছের উপজেলা হাসপাতালে যেতে অন্তত আট ঘন্টা লাগবে। চরে কোনো হাসপাতাল নাই, চিকিৎসকও নাই। জেলে তরুন দা বললেন, আলোর কোলে একটা হাসপাতাল ছিলো। মেলা বছর আগে সেটা সাগরে ভেঙ্গে গেছে।

অসুখ বিশুখ হলে হাতুড়ে ডাক্তার দেখানো হয়। তাতেও সুস্থ্য না হলে শহরে নেওয়া হয়। কিন্তু শহরে নিতে নিতে আর কিছু থাকে না, সময় লাগে অনেক। এখানে সাহেবদের স্পিডবোট আছে, বন বিভাগেরও আছে স্পিডবোট। কোস্টগার্ডেরও দ্রুতগামী নৌযান আছে। কিন্তু বিপদের সময় কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায় না। একটা স্পিডবোট যদি থাকতো তাহলে আমাদের খু্ব উপকার হতো ভাই।

বন বিভাগকে কর দিয়ে জেলেরা এখানে মাছ ধরতে আসে। এদের দিয়ে ব্যবসা করেন বড় বড় মহাজন। সাগর থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ ধরে এই জেলেরা। আমিষের চাহিদার একটি অংশের যোগান দেয় তারা। এদের ধরা মাছ রপ্তানী হয়। আসে বৈদেশিক মুদ্রা। অথচ এই মানুষগুলোর জীবনের যেন কোনো দামই নাই। এতো অবহেলা এই সাগরে আসলেই দেখি। দেখি সুন্দরবনের ভেতরে জীবন বাজি রাখা মানুষদের অধিকার বিহীন জীবন।

সূর্য না থাকলে এখানে দিক নির্ধারণের কোনো সুযোগ নাই। যদিও জেলেরা বাতাস আর পানির মতিগতি দেখে দিক নির্ধারণ করতে পারে। সেটিও দীর্থ অভিজ্ঞতার ব্যাপার। আমি বুঝতে পারছি কারণ দুপুর গড়িয়ে গেছে। সূর্য হেলেছে পশ্চিম দিকে। সন্ধ্যা নামার আগে ফিরতে পারলে দিক নির্ধারণে সমস্যা হবে না।

ফিরবো কখন জানতে চাইলাম। তরুন দা বললেন, রূপচাঁদা মাছ রান্না করে ভাত খেয়ে ফিরবো। বললাম, এই রোলিং-এর মধ্যে রান্না করবেন কী ভাবে? সরদার বললেন, ও কোনো ব্যাপার না ভাই। মাছ ছাড়িয়ে জাল আবার সাগরে ফেললো জেলেরা।

দা নিয়ে বসে পড়লো একজন। তাজা রূপচাঁদা মাছগুলো কাটতে সময় লাগলো না। এর মধ্যে আরেকজন গিয়ে চুলা জ্বালালো। টিনের চুলা। শুকনা লাকড়িতে আগুন জ্বললো। একজন ট্রলারের খোলের ভেতর থেকে চাল বের করলো। ড্রাম থেকে পানি নিয়ে ধুয়ে ভাত চড়ালো। এরপর মসলা পাতি নিয়ে সরদার বসলেন রান্নায়। ঢেউ আর রোলিং এ দাঁড়ানো যাচ্ছে না এখন। কিন্তু তাতে রান্নায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

ঢেউ বেড়েছে। তার তালে তালে ট্রলার উঠছে আর নামছে। এর মধ্যেই চুলা জ্বলছে। চরানো হয়েছে ভাতের হাঁড়ি। ঢাকনা লাগিয়ে তার ওপর কাপড় দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে একজন। এভাবে ভাত রান্না করতে দেখিনি আগে। এদিকে জোয়ার লেগেছে সাগরে। বেড়েছে ঢেউ। একটি বাঁশ ধরে বসে আছি আমি। আধা ঘন্টার মধ্যে ভাত নামলো। এরপর একটি কড়াই-এ উঠলো রূপচাঁদা মাছ। মিনিট কুড়ির মধ্যে রান্না হলো। ভাসতে ভাসতে খেলাম দুপুরের খাবার। এই অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না।

জোয়ারে উঠবো আমরা। তবে এখনই না। অপেক্ষা করতে হবে আরেকটি ট্রলারের জন্য। তরুণ দা’র আরও কয়েকটি জাল আছে সাগরে। আরেকটু নিচের দিকে ট্রলার আছে দুইটি। এছাড়া তার প্রতিবেশিদের জালের মাছও আমরা বয়ে নিয়ে যাবো। তাদের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে।

বিকাল গড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে ট্রলার আসলো। অন্য জালের মাছগুলো তুলে দিলো জেলেরা। আমাদের ট্রলার যাত্রা করলো। ততোক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। পূর্ণ গতিতে গেলে আমাদের সামনে অন্তত চার ঘন্টার পথ। কিন্তু সেই পথ কী করে চিনে ফিরবো বুঝতে পারছি না।

কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। আমরা এগুচ্ছি কূলের দিকে। একটানা উত্তরে যেতে হবে। মেহের আলীর খাল বরাবর উঠতে হবে। দিনের বেলা সেটি সহজ কাজ। কিন্তু কুয়াশা ভরা রাতে সেই কাজ অনেক কঠিন। ভিতরে ভিতরে দিশেহারা আমি। কিন্তু বলছি না। বুঝতে দিতে চাই না যে আমি একটু ভয় পাচ্ছি। এতোগুলো সাহসী মানুষদের সামনে ভয় পাওয়ার কথা বলা যায়?

(ঘটনা ২০১৬ সালের)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top