কী ভাবে দেখা দিতো জলদস্যুরা! | রূপান্তরের গল্প ১৩ | Rupantorer Golpo 13 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ১৩ : দস্যুদের আত্মসমর্পনের কাজে সুন্দরবনে যতবারই গেছি, RAB, কোস্টগার্ড, পুলিশ, বন বিভাগ, এমন কী সাধারণ জেলেদের চোখ এড়িয়ে চলাফেরা করেছি। দিনের আলোয় নয়, বড় ট্রলার কিংবা স্পিডবোটে নয়। কাঠের ট্রলার কিংবা ছোট্ট ডিঙ্গিতে রাতের পর রাত চলতে হয়েছে আমাদের। এক একটি দস্যু বাহিনীর সদস্যদের আস্থায় আনতে সময় লেগেছে অনেক; সময় লাগেও। কাজটি শুরুতে অসম্ভব ছিল। পরে বেশ কঠিন ছিল, তারপর যোগ হয়েছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। চলার পথে ঝুঁকির মুখোমুখি হয়েছি বার বার। নানান ধরণের ঝুঁকি পেরিয়েছিও সহকর্মীদের নিয়ে। এবার তেমনই একটি গল্প বলি…!!
তখন সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু দলের নাম মাস্টার বাহিনী। বাহিনী প্রধানের নাম মোস্তফা শেখ। সবাই ডাকে মাস্টার। কিন্তু এই মাস্টার কোনদিন স্কুলের বারান্দা দিয়েও হাঁটেননি। তাহলে সবাই কেন তাঁকে মাস্টার নামে ডাকে? সেই গল্প আরেকদিন হবে। মূল গল্পে আসি। নিজেদের গল্প। আমাদের নিজেদের জীবনে ফেরার গল্প…!!
২০১৫ সালের কথা। মাস্টার বাহিনী তখন মাত্র আত্মসমর্পনের চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। ফোনে ফোনে কথাবার্তা চলছিল। দেখা করার সময় যখন আসলো, তখন সুন্দরবনে আমাদের চলাফেরা বেশ কঠিন ছিলো। সবার চোখ এড়িয়ে চলতে হতো আমাকে।
আইন শৃংখলা বাহিনীর চোখ এড়াতে সেবার মংলা দিয়ে না গিয়ে সাতক্ষীরার গাবুরা থেকে রওনা দেই। পরিচয় গোপন রেখে রাসমেলার তীর্থযাত্রী হিসেবে যাই দুবলার চরে। সঙ্গী ছিলেন বায়েজিদ ইসলাম পলিন ও সাতক্ষীরার সহকর্মী আহাসান রাজীব। মাস্টারের সঙ্গে কথা ছিল, রাসমেলার পর সবাই চর ছেড়ে গেলে সুবিধা মতো সময়ে আমাকে ডেকে নেয়া হবে।
নভেম্বরের শেষ দিকের কথা। রাসমেলার পর তীর্থ যাত্রীরা ফিরে গেলো। অপেক্ষা করতে থাকলাম আমরা। খবর এলো পাঁচদিন পর। লোকালয়ে ফেরার নাম করে রাতের জোয়ারে রওনা দেই। আমাদের সব সময়ের পাইলট, বেলায়েত সরদারের ট্রলারে রওনা দেই। সঙ্গে সহযোগী ফারুক ভাই আর সুজন।
নির্দিষ্ট রুট ধরে চলতে থাকি রাতের অন্ধকারে। হংসরাজ নদীতে দেড় ঘন্টা চলার পর মাইটে খাল। নোঙ্গর করলাম সেখানে। আধা ঘন্টার মধ্যেই গুনগুন শব্দে এগিয়ে এলো একটি বিশাল এক ট্রলার। দূর থেকেই টর্চের আলোয় সংকেত বিনিময় হল। নিশ্চিত হতেই এগিয়ে আসলো তারা।
কাছে আসতেই আমাকে টেনে তাদের ট্রলারে উঠালেন মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ। দস্যুদের সেই ট্রলারটি দেখতে অনেকটা এপিসি’র মত। বাঙ্কারের মত তৈরী করা দুই পাশ। প্রতিটি বাঙ্কারে একজন/ দুজন করে সশস্ত্র দস্যু। ভেতরটা মোড়ানো মোটা স্টিলের পাত দিয়ে। তার ওপর কাঁথা দেয়া। গুলি থেকে বাঁচার জন্যই এই ব্যবস্থা।
সিক্স সিলিন্ডার ট্রলারে সাইলেন্সার লাগানো বলে সেটি চলতো নি:শব্দে। দ্রুত চলার সময় শুধু পানি সরার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। দ্রুত গতির প্রায় নি:শব্দে চলা এই ট্রলার ছিলো দস্যু দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। রওনা হলাম দস্যুদের গোপন আস্তানার দিকে। দিনের আলো ফোটার আগেই পৌছাতে হবে।
ছবিটি পশুর নদীতে তোলা, নভেম্বর ২০১৫ সালে।