রূপান্তরের গল্প ২৮৬ | Rupantorer Golpo 286

ওরা এসেছে ভয় দেখাতে | রূপান্তরের গল্প ২৮৬

ওরা এসেছে ভয় দেখাতে | রূপান্তরের গল্প ২৮৬ | Rupantorer Golpo 286 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৮৬ : হঠাৎ বন বিভাগের কর্মীদের চড়াও হওয়ার কারণ কী? মনে মনে ভাবছি সে কথা। একই সাথে দেখছি, জেলেদের চোখে ক্ষোভ। পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যেতে পারে। তবে চায়ের দোকানদার বেশ নির্লিপ্ত। বনরক্ষীদের এমন আচরণের পরও তিনি কেন নির্লিপ্ত বুঝতে পারছি না। এক কাপ চা বানিয়ে আমার হাতে দিলেন। বললেন, আপনি মাথা ঠান্ডা করে বসেন ভাই।

বন বিভাগের কর্মীরা বেশ উদ্ধত। দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন মধ্য বয়সী এক ভদ্রলোক। বললেন, অনুমতি ছাড়া সুন্দরবনে প্রবেশ অপরাধ, জানে না? বললাম, জানি তো ভাই। উনি নানা রকমের আইন কানুন জানালেন। আমি বললাম, জ্বি ভাই। তাহলে আইন অমান্য করেছি আমি, বড় অপরাধ করেছি। তিনি আরও রেগে গেলেন।

বললাম, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? মাথা ঠান্ডা করেন। পাশ থেকে বনরক্ষীদের একজন বললো, আপনি যা শুরু করছেন সেটা খুব খারাপ কাজ। বললাম, কেন ভাই? আমি কি দৌড়ে পালাচ্ছি? বললো, এখান থেকে পালাবেন কী করে? আপনি চরের সাহেবদের নিয়ে বেশি বেশি কথা বলছেন। ওই সাহেবরাই এই জেলেদের বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা আমাদেরও উপকার করে।

আপনাদেরও উপকার করে? জেলেদের উপকার করে? পাল্টা প্রশ্ন করলাম। উত্তর না দিয়ে এবার বললো, আপনার কাজ শহরে। এখানে এতো কাজ করা লাগবে না। বললাম, এই কথা তো সেদিন এক সাহেব বললেন। উনি আমাকে সুন্দরবন ছাড়তে বলেছেন। আজ আপনারাও একই কথা বলছেন! মিল আছে আপনাদের মধ্যে।

বন বিভাগ সুন্দরবনের অভিভাবক। আপনারা মাঠে ঘাটে অনেক পরিশ্রম করেন। এতো কঠিন কাজ। অথচ সুযোগ সুবিধা বলতে কিছুই নাই। আপনারা ভালো ইউনিফরম পড়তে পারেন না। ট্রলার, স্পিডবোট, জ্বালানী তেলের সংকটে থাকেন সারা বছর। খারাপ লাগে আপনাদের জন কিন্তু আপনারা কি দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করছেন? এখানে সবকিছু নিয়মে চলছে?

আমি একটানা বলছি। উনারা শুনছেন। বললাম, এখানে তো কোনো কিছুই নিয়মে চলছে না। পেছন থেকে একজন বললো, নিয়ম দেখার দায়িত্ব আমাদের। আপনাকে স্যার যা বলে শোনেন। বাড়তি কথা বলবেন না।

জেলেরা উসখুস করছে। চোখের ইশারায় তাদের মুখ বন্ধ রাখতে বললাম। বনরক্ষীদের বললাম, আপনারা আইনে যা হয় করেন। আমাকে গ্রেফতার করা লাগলে সেটাও করেন।

উনারা একটু অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, গ্রেফতার করলে তো করতেই পারি। কিন্তু আপনাকে একটা সুযোগ দিবো। এখনই ট্রলার নিয়ে রওনা দিবেন। পেছনে সাধারণ পোশাক পড়া একজন বললো, চরে এসে সে উল্টাপাল্টা কথা বলে বেড়াচ্ছে। সাহেবদের নিয়ে কথা বলে! সাহস কতো? পাশ থেকে একজন কানে কানে বললো, ওই লোকটি বন বিভাগের কর্মী না, কোন এক মহাজনের কর্মী।

বিষয়টি এড়িয়ে গেলাম। তবে মধ্য রাতে বন বিভাগের এই অভিযানের কারণ বুঝতে পেরেছি। বললাম, এখন তো আর রওনা দেওয়া সম্ভব না। আপনারা আমাকে অ্যারেস্ট করেন। আমার যা বলার আদালতে গিয়ে বলবো। একথা শুনে জেলেরা রেগে গেলো। আবারও তাদের অনুরোধ করে চুপ করালাম। বনরক্ষীদের বললাম, চলেন ভাই। কোথায় যেতে হবে নিয়ে চলেন। বনরক্ষীরা বললেন, আপনি চলে যান।

বিনয়ের সাথে উনাদের বললাম, আপনাদের দায়িত্ব পালন করতে দেখে খুব ভালো লাগলো। আশা করি সুন্দরবনের স্বার্থে আপনারা কঠোর থাকবেন। তবে কিছু বিষয়ে আমার কথা বলা প্রয়োজন। শুনবেন?

জানতে চাইলাম, এই চরে কচ্ছপ বিক্রি হয় কেমন করে? ওই যে দেখেন খালের পাশের ওই বনে এখনও কচ্ছপ বাঁধা আছো। এখানে সাগর তীর ধরে এতো এতো মৃত কচ্ছপ, ডলফিন এমন কী তিমি মাছও মরে পড়ে থাকে। বড় বড় শাপলা পাতা মাছ ধরা হয়, বিক্রি হয়। কয়েক মণ ওজনের করাত মাছ ওঠে চরে। বিক্রি হয়, পরিবহনও করা হয়। এগুলো তো নিষেধ! এবিষয়ে একটি মামলাও করেছেন?

জানতে চাইলাম, সুন্দরবনের ভেতরের এই সাময়িক পল্লীতে কিছু মানুষ সারা বছর থাকে। তখন নিয়ম কানুন কোথায় যায়? এখানকার সাইক্লোন শেল্টারগুলো সব দখল হয়ে আছে। এবিষয়ে আপনারা কী করছেন?

আমার প্রশ্ন শুনে পেছনে দাঁড়ানো দুইজন ফিরে গেছেন বন বিভাগের ট্রলারে। আমি জানতে চাইলাম, এখানে খেজুরতলায় সারা বছর কিছু ঘর করা থাকে। সেখানে মানুষ থাকে। জেলেরা থাকে। এখানে কয়েকশ’ ভেড়া ছাগল ঘুরতে দেখি। সেগুলো কোন নিয়মে আনা হয়, রাখা হয়? আমি তো জানি সুন্দরবনে গৃহপালিত প্রানি প্রবেশ একদম নিষেধ। এটি বন্যপ্রাণিদের জন্য মহা ঝুঁকির বিষয়। এই ছাগল-ভেড়া কেন সরান না আপনারা?

জানতে চাইলাম, বন বিভাগের কাছে জেলেরা কর দিয়ে সুন্দরবনে আসে। তাদের কাছ থেকে কতো টাকা নেন আর কাগজে লিখেন কতো টাকা? এখানে ডিউটির টাকা নামে জেলেদের কাছ থেকে টাকা ওঠে। এই টাকাটা কীসের? এখানে অবৈধ জাল থাকে কী করে? সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার চলে কী করে?

এখানে আসার আগে দেখে আসলাম শিকারীদের মহাযজ্ঞ। চরে এসে দেখলাম রাসমেলায় আসা ট্রলারে ট্রলারে হরিণের মাংস বিক্রি হচ্ছে, রান্না হচ্ছে তখন আপনারা কী করছিলেন? শেষে এসে বললাম, কয়েকদিন আগে ১৭ জন জেলেকে ডাকাতে ধরে নিয়ে গেছে, তাদের উদ্ধারে কোনো অভিযান কি করেছেন?

আমাকে একটানা এতো কথা বলতে দেখে দমে গেলেন বনরক্ষীরা। বললাম, আপনাদের সীমাবদ্ধতার কথা জানি। কিন্তু এতোগুলো অপরাধ চলছে এখানে। আপনাদের কোনো উদ্যোগ তো নিতে দেখলাম না। যেখানেই যাই, জেলেরা বলে আপনাদের বাড়তি টাকা দিতে হয়। উনারা বললেন, মিথ্যা কথা। সাথে সাথে জেলেরা একসাথে প্রতিবাদ করলো। দমে গেলেন উনারা।

বন বিভাগের এই কর্মীরা আমাকে চিনেন না। তার ওপর তাঁদের বিভ্রান্ত করেছেন এই চরের কিছু মানুষ। মাছের দাম নিয়ে, জেলেদের অধিকার নিয়ে কথাবার্তা বলায় বেশ অসন্তুষ্ট তাঁরা। সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের বিরোধীতাও করছে সেই চক্র। রাসমেলার আগের সন্ধ্যায় রীতিমতো ভয় দেখানোর চেষ্টাও করেছেন কেউ কেউ। আজ তাদের হয়ে বনরক্ষীরা এসেছেন আমাকে ভয় দেখাতে।

গত চারদিন এই চরের আনাচে কানাচে হাঁটছি। বুঝতে পারছি, মৌচাকে ঢিল মেরেছি আমি। এখন পাল্টা আক্রমণ হবে। দুবলা ছাড়ার আগেই তার আলামতও পেলাম।

এই রক্তচোষারা আগে নিজেদের লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে আতঙ্ক ছড়াতো। এখনও সেই লাঠিয়ালরা আছে। ধমক দিয়ে তারা জেলেদের নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আমাকে ধমক দেওয়ার সাহস হয়নি। তাই বনরক্ষীদের লেলিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

বনরক্ষীরা বিদায় নিলেন। একটু বিভ্রান্ত। ট্রলারে ওঠার আগে তাঁদের বললাম, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকেছি। আর যে বিষয়ে কাজ করছি সেই কাজে আপনাদের সহযোগিতাও লাগবে। পাশ থেকে জেলেরা বললো, এই লোককে আপনারা চিনেন না এখনও?

এসময় কিছু কটুকথা বলে ফেললো জেলেরা। পেছন থেকে সাহেবের লোকগুলো গলা চড়ালো। সাথে সাথে জেলেরা তাকে জেঁকে ধরলো। ভাবছি, এই তো শুরু হলো। প্রতিবাদ শুরু হলো এখান থেকেই। বছরের পর বছর নিপীড়নের শিকার এই মানুষেরা। কখনও সাহস করে প্রতিবাদ করেনি, করতে পারেনি ভয়ে।

ট্রলার ঠেলে খালে নামানো হলো। বিদায় নিলেন বনরক্ষীরা। ইঞ্জিন চালু হলো। ঘটঘট আওয়াজ তুলে মেহের আলীর খালে ঢুকে পড়লো তারা। তার মানে সাহেবদের ওখানে যাচ্ছে।

জেলেদের সবাইকে নিয়ে ফিরলাম আমাদের ট্রলারে কাছে। কেউ ওপরে বসলো, অন্যরা দাঁড়ালো নিচে। এক হাতে তরকারির গামলা, আরেক হাতে চামচ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বেলায়েত সরদার। গামলায় চামচের বাড়ি দিতে দিতে বললেন, আর কার কার তরকারি লাগবে? হাতে হাতে প্লেট ভর্তি ভাত। অবাক হয়ে দেখছি! এতোগুলো মানুষের রান্না, তাদের খাওয়ানো, সব মিলিয়ে দারুণ বিষয়!

বিচিত্র এই জীবন! কতো সৌহার্দ এদের মধ্যে। কে কোন জাতের, কে কোন ধর্মের তা নিয়ে কারও মাথা ব্যাথা নাই। সবাই সবার ধর্ম পালন করে। সবাই সবাইকে সহযোগিতা করে। অথচ তাদের সহযোগিতা করার মানুষের বড়ই অভাব।

খাওয়া শেষ করতে করতে জোয়ারে ভরে গেছে খাল। তলা পর্যন্ত পানি আসলেও ভাসলো না ট্রলার। জেলেরা সবাই মিলে হাত লাগালো। ধাক্কা দিয়ে ভাসিয়ে দিলো ট্রলার। ওদের বিদায় দিলাম। ইঞ্জিন রুমে মামুন। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে চালু করলো ট্রলার।

বিদায় নিলাম দুবলার চর থেকে। পশুর নদীতে উঠলাম যখন, তখনও সাগর থেকে ফিরছে ট্রলার। কেমন একটা টান অনুভব করছি। ভাবনার মধ্যে ঘুরছে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি। বন বিভাগ যদি ওই নিপীড়কদের কথায় চলে, তবে জেলেদের আর ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় থাকবে না।

নিজের সাথে কিছুক্ষণ বোঝাপড়া করলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, এই বন উপকূলের মানুষদের মাছের দাম পাওয়া নিয়ে কথা বলতে হবে। ওদিক থেকে বহুমুখি চাপ আসবে। আমার বদনাম হবে। অনেক রকমের ষড়যন্ত্র হবে। তবুও হাল ছাড়া যাবে না।

এজন্য দায়িত্বশীলদের বুঝাবো আমি। না বুঝলে প্রতিবাদ করবো। আর কিছু না হোক, জেলেদের অধিকার আর জীবনযাত্রা নিয়ে সংবাদ করবো। দস্যুমুক্ত সুন্দরবন এখন সময়ের ব্যাপার। কিন্তু মাছের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা মোটেই সহজ না। সামনে অনেক অনেক বাধা আসবে, বিপদও আসবে। কিন্তু কাজ থামানো যাবে না কিছুতেই।

(২০১৬ সালের নভেম্বর, দুবলার চর, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top