রূপান্তরের গল্প ২৮৭ | Rupantorer Golpo 287

শীতল কঠিন অন্ধকার এক রাত | রূপান্তরের গল্প ২৮৭

শীতল কঠিন অন্ধকার এক রাত | রূপান্তরের গল্প ২৮৭ | Rupantorer Golpo 287 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৮৭ : ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে ঘুম চলে আসছে। রাত বাজে তিনটার বেশি। ভাটা চলছে নদীতে। তীব্র স্রোতের চাপ সামলে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তবুও ইঞ্জিনের পুরো শক্তি ব্যবহার করে এগুনোর চেষ্টা করছি আমরা।

পশুর নদীকে এখন আপাত দৃষ্টিতে শান্ত দেখাচ্ছে। ভাটার স্রোত আর শীতের বাতাস, দুটোই নামছে দক্ষিণে। তাই বিশাল এই জলরাসিতে কোনো ঢেউ নাই, রোলিং নাই। তবে বিপরীত দিক থেকে আসা স্রোতের চাপ তীব্র। সেই চাপে হিমসিম খাচ্ছে বেলায়েত সরদারের ট্রলার।

সুকানি হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাপ্টেন সরদার। সামনে ডেক এর উপর আমার বিছানা। সেখানে বসে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসেছি আমি। রান্নাঘরে বসে চা বানাচ্ছে মামুন। ইঞ্জিন রুমে আছেন শহীদুল কাকু। ট্রলারের সামনে করা সাময়িক ছই। তার ভেতরে ঘুমে বিভোর সহযাত্রীরা।

পশুর নদীর পশ্চিম পাশ ধরে এগুবো আমরা। ট্রলার ছাড়ার আগে জেলেরা বললো, ভাটায় উঠতে হলে পশ্চিম পাশ ধরতে হবে। ওদিকে স্রোতের চাপ কম। চার গাঙ পার হয়ে আবার পূর্ব দিকে উঠতে হবে। নদী শান্ত থাকলে সে পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে অন্তত চার ঘন্টা। তারপর জোয়ার পাবো। সেই টানে আরও চার ঘন্টা চালালে মংলা।

বেলায়েত সরদার একটু উসখুস করছেন। অন্ধকারে বেশ বুঝতে পারছি। কারণ সরদার কখনও চুপচাপ থাকেন না। বললাম, কোনো সমস্যা? সরদার বললেন, ইঞ্জিনের শক্তিতে কুলাচ্ছে না ভাই। এছাড়া ট্রলারের তলার ফুঠোটা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে। মেরামত করছি। কিন্তু পানির এই চাপ মনে হয় নিতে পারবে না। বললাম, এই বিশাল নদীতে ট্রলার ডুবলে মরতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা হলো এখানে ডুবলে আমাদের লাশও কেউ খুঁজে পাবে না।

কী করবো তাহলে? এই প্রশ্নটি শোনার অপেক্ষায় ছিলেন সরদার। বললেন, কোনো খালে ঢুকতে হবে। জোয়ার হলে আবার ছাড়বো। সম্মতি দিলাম। জানতে চাইলাম, কোন খালে ঢুকবো? উনি বললেন, এদিকটা নীল কমলের এরিয়া, অভয়াশ্রম। বন বিভাগ তো আমাদের পছন্দ করছে না। ওদিকে ঢুকলে আবার ধরে না বসে।

বললাম, ডাকাতগুলো যে তাদের সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায় তাদের কিছু বলে তারা? বলে না। যারা অবৈধ ভাবে এদিকে মাছ ধরে, তারাও তো খোলামেলা থাকে। আজ না হয় চোর বা ডাকাত হয়ে যাই আমরা? দস্যুরা যেভাবে চলে সেভাবে চলবো। ডাকাতরা যেসব খাল ব্যবহার করে, সেরকম একটা খালে গিয়ে নোঙ্গর করেন।

কিছুক্ষণ চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে চাইলাম কোথায় আছি আমরা! কিন্তু ততোক্ষণে কুয়াশায় ঢেকে গেছে চারপাশ। দশ ফুট সামনের কিছু দেখা যায় না। সাধারণত নদীর মাঝখানের বয়াগুলোর লাইট দেখে জেলেরা পথ ঠিক করে। কিন্তু আজ কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

কী হবে এখন? কেমন করে দিক ঠিক করবো? কেমন করে নদীর পশ্চিমের কোনো খালে যাবো? উনি বললেন, বাতাসের দিক দেখে প্রথমে পশ্চিম পাড় ধরবো। তারপর সোজা উত্তরে উঠতে থাকবো। তীর ধরে গেলে একটা না একটা বয়া দেখা যাবে। তাও যদি না দেখা যায় তাহলে সামনে যে খাল পড়বে সেটাতেই ঢুকবো।

দুবলার চরের পশ্চিম পাশ বন বিভাগের নীল কমল ফরেস্ট অফিসের অন্তর্গত। নিল কমল একটি নদীর নাম। পশুর থেকে শুরু হয়ে বেরিয়ে গেছি আরও পশ্চিমে আড়পাঙ্গাসিয়া নদীতে। আমরা অবশ্য এই জায়গাটিকে হিরণ পয়েন্ট নামে চিনি। পয়েন্টগুলো বন্দরের নির্ধারণ করা জায়গা। বড় নদীর জাহাজ চলাচলের পথে এরকম কয়েকটি পয়েন্ট আছে। জেলেরা যে জায়গাকে চার গাঙ বলে, সেই জায়গার বন্দরের নাম আকরাম পয়েন্ট।

নীল কমল নদীতে ঢুকতেই নৌ বাহিনী ও মংলা সমুদ্র বন্দরের স্থাপনা। তারপর বন বিভাগের অফিস। আমরা ওদিকে যাবো না। আরেকটু উত্তরের কোনো খালে ঢুকবো। প্রথমে পড়বে কেওড়াশুঁটি খাল। তারপর কাগা, চেরাগখালী, মোরগখালী। আরেকটু উজানে ছোট কিছু খাল আছে, নাম জানি না। তারপর আছে বড় একটি নদী, হংসরাজ। এদিক দিয়ে বাম পাশের কিনার ধরে উঠলে পড়বে শিবসা নদী। এই পথে চলাফেরা করা নিষেধ। তবে চুরি করে অনেকেই যায়। দস্যুরা চলে সারা বছর।

আপাতত কেওড়াশুঁটি খালে ঢোকার চেষ্টা করেন ভাই। সাথে সাথে মামুনকে সামনে পাঠানো হলো। টর্চ হাতে গলুই-এ দাঁড়াবে সে। তার দেখানো দিকে চলবে ট্রলার।

টর্চের আলোর ইশারায় চলছি আমরা। উত্তরা বাতাসের কারণে তীব্র শীত লাগছে। তবে এই বাতাসই আমাদের পথ দেখাচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে ডান গালে বাতাস লাগিয়ে চলতে হবে। তাহলেই পৌঁছে যাবো পশ্চিমে। অন্ধকার রাতে নদী-সাগরে চলার এই কৌশল সম্পর্কে জেনেছি সেদিন সাগর থেকে ফেরার পথে।

রাত শেষ হয়ে ভোর হচ্ছে। ভেবেছিলাম ঘুম দিবো। কিন্তু নিরাপদ জায়গায় গিয়ে না থামা পর্যন্ত ঘুমাতে পারছি না। এসময় বনদস্যুরা চলাফেরা করে। এদিকে তাদের বসবাস। হুট করে কোনো ডাকাত দলের সামনে পড়ে গেলে সামাল দিতে হবে। এদিকের দস্যু বাহিনীর নাম নোয়া বাহিনী। বেশ খাতির আমার সাথে। কিন্তু অন্ধকারে হুট করে গোলাগুলি হয়ে যেতে পারে। এই সময়টা কৌশলে সামাল দিতে হয়।

বনদস্যুদের সাথে আমার অসংখ্য বার দেখা হয়েছে। প্রায় প্রতিবারই দেখা হয়েছে রাতের অন্ধকারে, বনের ভেতরের গহীন কোনো খালে। সেই অভিজ্ঞতা আছে বলেই সুন্দরবনের এদিকটাতে আসার সাহস করেছি। গোন চলছে বলে দস্যুদের চলাফেরার সম্ভাবনা আছে। দেখা হয়ে গেলে কোনো রকম ভুল আচরণ করা যাবে না। সরদার বললেন, ডাকাত সামনে পড়লে ওদের গুলির রেঞ্জের বাইরে চলে যাবো। সমস্যা হবে না।

এদিকের বনদস্যুরা ট্রলারে চলে। অস্ত্র বলতে তাদের হাতে থাকে একনলা ও দোনলা বন্দুক। এগুলোর রেঞ্জ খুব বেশি না। তবে নোয়া বাহিনীর কাছে একটি থ্রি নট থ্রি জাতীয় নতুন অস্ত্র আছে। ভারতীয় বন্দুক। এর রেঞ্জ ও শক্তি দুটোই বেশি। দূর থেকে গুলি করে ট্রলার ফুটো করার সক্ষমতা আছে সেই অস্ত্রের। তাই বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে।

দেখতে দেখতে পশ্চিমে চলে আসলাম। ততোক্ষণে পশ্চিম আকাশে অল্প অল্প আলো ফুটেছে। চারপাশে আলোর আভা ছড়িয়েছে। কিন্তু কুয়াশা এতো ঘন যে সামান্য দূরেও দেখা যাচ্ছে না।

একই ভাবে চলছে ট্রলার। বাম পাশে আবছা আবছা জঙ্গল দেখছি। বাম পাশে সুন্দরবন রেখে উত্তরে যাবো। সামনে যে খাল পড়বে সেখানেই ঢুকে পড়বো। আমরা সম্ভবত নীল কমল পার করে উজানে চলছি।

বিপরীত স্রোতে এগুতে সময় লাগছে। তবে আলো ফুটছে বলে দুশ্চিন্তা কমেছে। আর কিছু না হোক, এখন এখানে নোঙ্গর করলেও সমস্যা হবে না। সরদারকে বলললাম সে কথা। মামুনকে ডেকে তিনি নোঙ্গর ফেলতে বললেন।

ট্রলার এখন টবারে রাখা। মানে নিউট্রাল গিয়ারে। সামনে থেকে নোঙ্গর ফেলা হলো। নোঙ্গর নামছে, পুরো দড়ি শেষ হলো। কিন্তু মাটি পেলাম না। মানে এখানে পশুর নদীর গভীরতা অনেক বেশি। মামুনকে বললাম, নোঙ্গর তোলো। আমরা সামনে আগাবো।

একটু পর একটা খাল পেলামম। মাঝারি খাল। মুখটা ছোট বলে ঢুকতে রাজি না। ভাটার সময় আবার আটকা না পড়ি! সরদার বললেন, এইটা ছোট খাল না ভাই। মুখটা একটু ছোট। বলেই ট্রলার ঘুরালেন।

ডেক থেকে নেমে সামনে এগিয়ে গেলাম। সামনে মামুন দাঁড়ানো। ধীরে ধীরে ট্রলার ঢুকলো পশ্চিম সুন্দরবনের কেওড়াশুঁটি খালে।

খালে ঢুকতেই দেখি কয়েকটা জেলে নৌকা একসাথে বাঁধা। ডান পাশে কেওড়া বন। আমাদের দেখেই পড়িমরি করে ঝাঁপিয়ে পড়লো তারা। কিছু বলার আগেই হারিয়ে গেলো বনের ভেতর।

(নভেম্বর ২০১৬ | সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top