চরপাটার নৌকা বহর | রূপান্তরের গল্প ২৮৯ | Rupantorer Golpo 289 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ২৮৯ : রীতিমতো হৈ হৈ রৈ রৈ পরিস্থিতি। জাল ধরতে যাওয়ার আগে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। খাওয়া দাওয়া সেরে, গোছগাছ করে জেলেরা রওনা দেয়। শেষ ভাটায় চরপাটা বা খালপাটার জেলেরা যে যার জালের কাছে যাবে।
কয়েক ঘন্টা ওরা মাছ ধরবে। জাল গুছিয়ে ফিরে আসবে। এরপর ধরা মাছগুলো ধুয়ে পরিস্কার করে বরফে রাখবে অথবা ভরের ট্রলারের জন্য অপেক্ষা করবে। সাধারণত মহাজনের মাছ বহনের নৌকা বা ট্রলার আসে নির্দিষ্ট সময়। জেলেরা নৌকা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করে।
সকাল সাড়ে ছয়টা বাজে। আপাতত মাছ ধরতে যাবে জেলেরা। আমরাও সঙ্গী হবো। চা খেয়ে তৈরি হলাম। এর মধ্যে কয়েকটি নৌকা ছেড়ে গেছে। যাদের জাল এখান থেকে দূরে তারা রওনা হয়েছে আরও আগে। কেওড়াশুঁটি খালে কাছাকাছি দুটি জাল আছে। আমরা তার একটিতে যাবো।
একটু একটু করে কুয়াশা কাটছে। খালের উল্টো দিকটা দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে আরেকটি জেলে বহর আছে। ওরাও চরপাটা ও খালপাটার জেলে। কয়েকটি বড়শির নৌকাও দেখছি। এসময় পর পর কয়েকটা কাঁকড়া ধরার নৌকা পার হলো খালের মাঝখান দিয়ে। ওরা বড় নদীতে গিয়ে অন্য কোনো খালে যাবে। কাঁকড়া ধরার সময় প্রথম জোয়ার।
রাতে ঘুম হয়নি। গত কয়দিন দুবলার চরে একটানা হেঁটেছি। হাত পা ব্যাথা করছে। কিন্তু মাছ ধরার কথা শুনলে সব ক্লান্তি কেটে যায়। ছোট বেলা থেকে মাছ ধরার নেশা ছিলো না। কিন্তু এই জঙ্গলে এসে মাছের নেশা হচ্ছে নতুন করে। মাছ ধরার চেয়ে দেখার আনন্দ বেশি। আবার দেখার যতোটা আনন্দেন, মাছ ধরার কাজটি ততোটাই কঠিন।
চরপাটা জাল হলো বিশাল বড় জাল। দৈর্ঘে কয়েকশ’ মিটার হবে। সুন্দরবনের নদী বা সাগরের চর ধরে পাতা হয় এ জাল। এক একটি চরপাটা জালের সাথে থাকে ১০-১৫ জন জেলে। নৌকা থাকে তিনটি থেকে পাঁচটি।
প্রথমে চর নির্ধারণ করে জেলেরা। পুরো সপ্তাহ জুড়ে চর বদলে জাল ফেলা হয়। এক চরে পরের দিন জাল ফেললে মাছ হয় না। মাঝে কয়েকদিন বিরতি দিতে হয়। এই জাল ফেলার চর বা এলাকা দখলে রাখাটা সুন্দরবনে সহজ কাজ না। শুধু লোকালয়ের ক্ষমতা দিয়ে এখানে কাজ হয় না। বনদস্যুদের সাথে সুসম্পর্ক ও লেনদেন করতে হয়, বন বিভাগের সাথেও লেনদেনের বিষয় আছে। তবে এখানে যে কোথায় জাল ফেলবে, মাছ ধরবে তা নির্ধারণ করে দস্যুরা। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
পরের দিন যেই চরে জাল দেওয়া হবে সেটি আগের দিন নির্ধারণ করা হয়। ভাটার সময় নদীর পার ধরে খুঁটি পুঁতে ফেলে জেলেরা। তার সাথে বাঁধা হয় জাল। লম্বা জাল। এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত খুঁটিতে খুঁটিতে বেঁধে মাটির সাথে মিশিয়ে রাখা হয়।
ধীরে ধীরে জোয়ার আসে। খাল ভরে যায় পানিতে। ভরা জোয়ারের সময় জাল টেনে দেয় জেলেরা। শক্ত করে বেঁধে আবার ফিরে যায় তারা। চরের ওপর পাতা জালের ভেতরে আটকা পড়ে যায় মাছ। মানে ঘেরাও এর মধ্যে যতোগুলো মাছ আসে সেগুলো আর বের হতে পারে না।
ভাটা শুরু হয়। জেলেরা চলে যায় নিরাপদ কোনো জায়গায়। আমরা যখন এই খালে ঢুকি তখন সেই সময়টি কাটাচ্ছিলো জেলেরা। এসময় রান্না-বান্না সেরে খাওয়া দাওয়া দাওয়া করে তারা। একটু বিশ্রাম নিয়ে শেষ ভাটার অপেক্ষা করে।
ভাটা শেষ হওয়ার ঘন্টা খানেক আগে জালের কাছে পৌঁছে তারা। আজ আমরাও একই সময় রওনা দিলাম, চরপাটার জেলেদের সাথে। নৌকার মাঝখানে বসেছি আমি, পাশে আছেন বেলায়েত সরদার। মামুন আর শহীদুল কাকু থেকে গেলেন ট্রলারে। সবার জন্য ভাত রান্না হবে ট্রলারে। ভাতের সাথে থাকবে আলু ভর্তা আর পাতলা ডাল। মাছ ধরে ফিরে আমরা একসাথে খাবো। অন্য সহযাত্রীরা এখনও ঘুম।
ভাটার স্রোত কমেছে। নৌকা চলছে উজান ঠেলে। সামনে পেছনে বৈঠা বাইছে জেলেরা। নৌকার চুলায় আগুন জ্বলছে। পানিতে নামার আগে এক কাপ চা খেয়ে নামবে তারা। সাগর পাড়ে, বালির চরে চরপাটা জালের মাছ ধরা খুব সহজ। কিন্তু এই বনের ভেতরের চরগুলোতে কখনও কোমড় সমান কাদা, কোনো জায়গা গভীর জঙ্গল। এক পাশে নৌকা বেঁধে রেখে নিচে নেমে মাছ ধরতে হয়। মাছ ধরা বলতে এখন শুধু কাজ মাছগুলো মাটি কাদা থেকে ওঠানো।
আমি নামতে চাই। জেলে ভাইদের সাথে সাথে মাছ তুলবো। কিন্তু সরদার তাতে রাজি না। বললেন, এমনিতে খুব মজা মনে হয় ভাই। বাহির চরে হলে সমস্যা ছিলো না। কিন্তু এখানে নামলে হাঁটতে পারবেন না। মাছ ধরতে গিয়ে সাপ থরে ফেলবেন। হাত পায়ে কাঁটা ফুটাবে কাউইন মাগুর, টেংড়া। তখন করবো কী? ব্যাথায় মরে যাবেন।
জেলেরা বললো, আপনার নামার দরকার নাই। এদিকে বাঘের চাপও বেশি। মাঝে মাঝে চরপাটার মাছ খেতে আসে বুনো শুয়োর। ওরাও খুব হিংশ্র হয়। বিশেষ করে মাছ তোলার সময় বাঘে বেশি টার্গেট করে। এসময় সবাই থাকে ডাঙ্গায়। নজর থাকে নিচের দিকে। সেই সুযোগে একজনকে টান দিয়ে নিয়ে যায়।
নামবো কী নামবো না? ভাবছি। বেলায়েত সরদার নামবেন। বললাম, তাহলে আমিও নামবো। যা হয় হবে। গল্প করতে করতে চা হলো। কাপে কাপে লাল চা নিয়ে চুমুক দিচ্ছে জেলেরা। আমার জন্য তৈরি হলো দুধ চা। চুলার ধারে বসা ছেলেটি বললো, রওনা দেওয়ার আগে মামুন তাকে দুধগুঁড়া দিয়েছে। এই শীতের সকালে গহীন সুন্দরবনের অতি সুন্দর এই খালে চলতে চলতে দুধ চা! ভালো লাগার শেষ নাই।
জালের কাছে চলে এসেছি। একটু দূর থেকে দেখে হাত তালি দিয়ে বসলো জেলেরা। বললো, ভালো মাছ পড়ছে জালে। বড় মাছও পড়েছে, চিংড়ি মাছও পড়ছে। বেশি মাছ পড়লে খুব খুশি হয় জেলেরা। সেই খুশি দেখলে আমারও খুশি লাগে। কিন্তু সমস্যা হলো, খুশি শুধু মাছেই সীমাবদ্ধ থাকে। মাছ থেকে যখন টাকায় গড়ায়, মানে মাছের দামে গড়ায় তখন আর ভালো লাগে না। ওদেরও মন খারাপ হয়, আমারও কষ্ট লাগে। কারণ আমি দুই প্রান্তের খবরই জানি।
এই তাজা মাছগুলো শহরে আমরা কয় টাকায় কিনি, আর জেলেরা কয় টাকায় বিক্রি করে, তফাৎটা দেখে বিস্মিত হই। দামের বিশাল পার্থক্য সম্মন্ধে ওরা জানে। কিন্তু পার্থক্যটা কতো তা জানে না।
নৌকা থামলো। যেখান থেকে জাল শুরু সেখানে একটা কেওড়া গাছ আছে। প্রথম খুঁটির সাথে নৌকা বাঁধা হলো। পরের তিনটি নৌকা এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। ওরাও থামবে জায়গায় জায়গায়। খালের মাঝখান দিয়ে আরও কয়েকটি নৌকা যাচ্ছে। খালপাটার জেলে তারা। এই ভাটায় চরপাটার মাছ দেখবো। এখানে একদিন থাকলে সামনের ভাটায় খালপাটা জালের মাছ ধরা দেখবো।
নিচে নামার আগে কিছু প্রস্তুতি নেয় জেলেরা। যেখানে কাদা ও জঙ্গল বেশি সেখানে নামার আগে পুরো শরীরে কেরোসিন তেল মাখতে হয়। বাইড়ে পোকার কামড় থেকে রক্ষা পেতে কেরোসিন মাখে তারা। দেরি করলাম না। দুই হাতে তেল নিয়ে হাতে পায়ে মাখলাম। এখানে নামি আর না নামি, পোকা কামড়াবেই। আমার অবস্থা দেখে হাসিতে ফেটে পড়লেন সরদার। বললেন, ও ভাই, আপনার কাদায় নামা হবে না।
পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে বসে বকবক করছেন সরদার। এর মধ্যে নৌকা থেকে নেমে পড়লো জেলেরা। তাদের পিছে পিছে আমিও দিলাম লাফ।
(নভেম্বর ২০১৬ | সুন্দরবন)