রূপান্তরের গল্প ২৯১ | Rupantorer Golpo 291

এক জালে ২৫ মণ মাছ! | রূপান্তরের গল্প ২৯১

এক জালে ২৫ মণ মাছ! | রূপান্তরের গল্প ২৯১ | Rupantorer Golpo 291 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯১ : এমনিতে বাঘের গল্প শুনতে ভালো লাগে। বনের ভেতরে শুনতে আরও ভালো লাগে। কিন্তু বনের মধ্যে নেমে বাঘ মামার গল্প শুনলে ভয় লাগে। জীবনে নানা রকমের ভয় পেয়েছি। কিন্তু এই মুহুর্তের ভয়ের সাথে সেগুলোর তুলনা হয় না।

এমনিতে সারা শরীরে বেড়ে পোকার কামড়। ফুলে গেছে শরীরের জায়গায় জায়গায়। চুলকাচ্ছে। পা আর হাতের ফোলা অংশের ওপর বসে আছে আরও কয়েকশ’ পোকা। মনের সুখে কামড় দিচ্ছে, রক্ত খাচ্ছে। সুন্দরবনের এই পোকাদের সম্ভবত আমার রক্ত বেশি প্রিয়।

কী করি এখন? এমনিতে দাঁড়িয়ে থাকতেই হিমসিম খাচ্ছি। কোনো মতে পা টেনে টেনে হাঁটছি। বেলায়েত সরদার এক হাত ধরে আছেন। অন্য হাত দিয়ে জাল, খুঁটি অথবা জালের কোনো অংশ ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। শীতের ভোরে পানিতে নেমেছি, শীত লাগছে। কিন্তু এতো বিপদের মধ্যে শীতের কথা ভুলেই গেছি।

এক কাপ চা খাবেন ভাই? জিজ্ঞেস করলেন সরদার। বললাম, এর মধ্যে চা বানাবেন কী করে? কথার উত্তর না দিয়ে ঝুপ করে লাফ দিয়ে খালে নামলেন সরদার। সাঁতার কেটে নৌকায় গেলেন। টুপ করে উঠেই শুকনা কাপড় দিয়ে মাথা মুছলেন।

বৈঠা হাতে বসে পড়লেন। নৌকা বেয়ে এগিয়ে আসলেন এদিকে। নৌকা বাঁধলেন জালের সাথে, খালের দিকে। ওদিকে একটু পানি আছে। ভাটা এখনও হচ্ছে বলে জাল পর্যন্ত আনা গেলো না।

চুলা জ্বালিয়ে চায়ের পানি তুললেন সরদার। দাউ দাউ করে জ্বলছে জ্বালানী। কয়েক মিনিটের মধ্যে চা রেডি। কৌটা থেকে টোস্ট বিস্কিট বের করে দিলেন। শীতের সকালে আরেক কাপ চা শরীর মন চাঙ্গা করে দিলো।

এবার কেরোসিনের বোতলটা এগিয়ে দিলেন। আবার ভালো করে হাত আর পায়ে কেরোসিন মাখলাম। জেলেরা আমার কাজ কারবার দেখছে আর হাসছে। তবে এখন হাতে সময় নাই। এক মনে কাদা থেকে মাছ ধরছে, তুলে ড্রামের ভেতরে রাখছে।

ড্রামের পর ড্রাম ভরছে মাছে। চিংড়ি, পারশে, রুছো, খড়ুল, ভাঙ্গন, পায়রা, দাতিনা, জাবা, ভেটকী, ইশলে তাইড়েল, কাউইন মাছ পড়েছে জালে। এর মধ্যে চিংড়ি আছে কয়েক জাতের। বড় বড় কাউইন মাছ পড়েছে কয়েকটা। ভাঙ্গন মাছগুলো দেখলে মন জুড়িয়ে যায়। ভেটকি আর ইলশে তাইড়েল মাছের সাইজ বেশি বড় না। কিন্তু সংখ্যায় অনেক বেশি। আরেকটু এগিয়ে একটা পাঙ্গাস মাছ দেখলাম। ওজন কুড়ি কেজিরও বেশি।

এগুচ্ছি আমরা। এদিকে কাদা একটু কম। তীরের দিকে জঙ্গলও একটু হাল্কা। মাঝে মাঝে হরিণের ডাক শুনছি। ভেতর থেকে বানরের পালের ঝগড়া-ঝাঁটির শব্দ শুনছি। মাঝে মাঝে কক কক শব্দে ডেকে উঠছে বন মোরগ।

নানা রঙ এর পাখি ছুটে বেড়াচ্ছে, আকাশে উড়ছে চিল, বড় বড় বকগুলো এসে জালের পাশের মরা মাছগুলো ধরছে, খাচ্ছে। এখানে জেলেরা যেমন আপন মনে মাছ তুলে যাচ্ছে, চারপাশ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নাই। একই ভাবে পাখিগুলোও তাদের মতো করে আসছে, মাছ ধরছে আবার চলেও যাচ্ছে। আকাশ এখনও পরিস্কার হয়নি। তবে দেখতে পাচ্ছি তিনটি মদনটাক পাখি উড়ছে আমাদের মাথার ওপরে।

জেলেরা বললো, এদিকে চুরি করে আসি মাছ ধরতে। প্রতি গোনে ঠিকঠাক তিন পাটা দিতে পারলেই হয়। তিন পাটায় যে মাছ ওঠে সেই মাছ নিয়ে ফেরা যায় না। অনেক মাছ নষ্টও হয় বড়ফের অভাবে। বললাম, আপনারা তো সর্বনাশ করে ফেলছেন। অভয়াশ্রম করাই হয়েছে যাতে এখানকার মাছসহ সবকিছু সুরক্ষিত রাখতে। কিন্তু এদিকে আপনারা সুন্দরবনের সর্বনাশ করে ফেলছেন। জেলেরা বললো, আমরা যদি সর্বনাশ করি তাহলে বিষ পার্টি কী করছে?

এদিকে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের পার্টি আসে? জেলেরা বললো, এতো দূর আসে না। এদিকে তো মাছ আর মাছ। বিষ দেওয়ার দরকার পড়ে না। আর আসলেও এদিকে ঢোকার সাহস পায় না। মাঝে মাঝে চুরি করে আসে। রাতে আসে। খালে বিষ মারে। মাছ নিয়ে আবার পরের রাতে চলে যায়। এদিকে শিকারীরাও আসে। জেলেরাও মাঝে মাঝে হরিণ মারে। এমন সময় দূর থেকে একটা গুলির শব্দ এলো। বন্দুকের গুলি।

বুকটা ধক করে উঠলো। জেলেরা নির্বিকার। বললো, ওই হংসরাজের ওই দিকে কোথাও গুলি হইছে। এরা কি ফরেস্ট? জেলেরা বললো, এখন দুইটা ডাকাত দল আছে এই পাশে। ওরা প্রতিদিনই হরিণ মারে। মনে হয় শিকার করলো। নোয়া বাহিনী আর জাহাঙ্গীর বাহিনী প্রতিদিনই শিকার করে।

নীল কমলের উত্তরের খালে আছি আমরা। নিশ্চিত ভাবে ওখানেও গেছে গুলির শব্দ। কিন্তু বিশাল এই বনে গুলির শব্দকে অনুসরণ করে গেলে কাউকে ধরতে পারবে না। এছাড়া ডাকাত দলে অনেক মানুষ থাকে। সকলেই অস্ত্রধারী। ওরা বনরক্ষীদের পাত্তাও দেয় না। বলে, ফরেস্টের সাথে তাদের এক রকমের বোঝাপড়া আছে। সেটি লেনদেনেরও হতে পারে, আবার ভয়ের কারণেও হতে পারে।

জেলেরা বললো, আমরা নোয়া বাহিনীকে চাঁদা দেই। জাহাঙ্গীরও টাকা নেয়। তা না হলে এই অঞ্চলে কেউ মাছ মারতে আসতে পারে? জানতে চাইলাম, কতো টাকা দেন? সরাসরি দেন?

জেলেরা বললো, ডাকাতরা টাকা নেয কোম্পানির মাধ্যমে। কোম্পানি হলো মহাজন। এদিকে মহাজন বলে না। দুবলার চরে বলে সাহেব। ডাকাতদের সাথে যোগাযোগ করে কোম্পানি বা সাহেবরা, অর্থাৎ মহাজনেরা। আমরা টাকা দেই জাল নৌকা হিসাব করে। ওরা ওরা লেনদেন করে।

আপনাদের কাছে কোনো প্রমাণ থাকে টাকা দেওয়ার? জেলেরা বললো, থাকে তো। টিকেট দিয়ে দেয়। আগে মহাজনের দেওয়া স্লিপ দেখালেই হতো। এখন টাকার নোট দিয়ে দেয়। দশ টাকার নোট মানে দশ হাজার, বিশ টাকার নোট বিশ হাজার, পঞ্চাশ টাকার নোট মানে পঞ্চাশ হাজার টাকার স্লিপ।

গত বছর টাকা ছিঁড়ে অর্ধেক আমাদের কাছে রাখতো, অর্ধেক থাকতো দস্যুদের কাছে। দেখা হলে দুই ভাগ মিলায়ে নিতো। কিন্তু ছেঁড়া টাকা দেখলে প্রশাসন বুঝে যায় যে এটা ডাকাতের চাঁদার স্লিপ। এরপর থেকে শুধু টাকার নোট নিয়ে নামি। টাকার নাম্বার লেখা থাকে দস্যুদের খাতায়। দেখা হলে সেই নোট দেখালেই ছেড়ে দেয়।

নোয়া বাহিনীর সাথে এর মধ্যে দেখা হয়নি? এক জেলে বললো, ওই শিবসার বাওনে একবার দেখা হলো। আমরা পুরনো জেলে। লম্বা সময়ের পরিচয়। রাজু যখন ডাকাতি করতো তখন থেকেই নোয়া মিয়ার সাথে খাতির। এছাড়া এই দলের সদস্য কিবরিয়া, রাঙ্গা, মনিরসহ অনেকের সাথেই চেনাজানা আছে। তাই ওই দিন কিছু বলেনি।

পাশ থেকে আরেক জেলে বললো, আমাদের সাথে জাহাঙ্গীরের দেখা হলো ওই বাটলো নদীর ভেতর। নতুন নতুন বন্দুক, পোসেস ভর্তি গুলি। আমাদের আটকায়ে দেখলো কোম্পানি চাঁদা দিয়ে দিছে। তারপর নৌকার সব মাছ তুলে নিলো। বললো, শহরের সাহেবদের মাছ পাঠাতে হবে।

দাম কি দিলো পরে? প্রশ্নের উত্তরে বললো, এরা তো বলে মাছের দাম দিছে। কিন্তু কোম্পানি বলে দেয়নি। ওই চালানের দাম আর পাবো না ভাই। আমাদের শুধু লোকসানের ভাগ পুরোটা নিতে হয়। লাভের ভাগ সব ওদের। জেলেরা বললো, নৌকায় এক পাটার মাছ ছিলো। দশ মণের বেশি মাছ। চিংড়িই ছিলো প্রায় ছয় মণ। মেলা টাকার মাছ ছিলো ভাই।

মাছ খুঁটতে খুঁটতে প্রায় খালের মাঝামাঝি জায়গায় চলে এসেছি। এসময় খালের উল্টো পাশের চরে এক ধরনের লতানো গাছ দেখতে পেলাম। সুন্দরবনে মাঝে মাঝে এই গাছ দেখি। দূর থেকে দেখতে অনেকটা কলমি শাকের মতো লাগে। সরদার বললেন, এই শাক খাওয়া যায় ভাই। মাছ ধরে ফেরার পথে তুলে নিয়ে যাবো। সাথে বাউলা ফল পেলে মাছের সাথে রান্না করে দিবো।

কেবল মাছ ধরা হচ্ছে। এরপর ফিরবো। ফেরার পথে চরের শাক নিবো, বাউলা ফল পাড়বো, তারপর যাবো ট্রলারে। এরপর মাছ কুটে, পরিস্কার করে রান্না উঠাবেন সরদার। বললাম, তাহলে সকালের ভাত কয়টায় খাবো আমরা? সরদার বললেন, যখন রান্না হবে তখন খাবেন! জানতে চাইলাম, কী মাছ রান্না করবেন? বললেন, জঙ্গলের শাক দিয়ে করবো চিংড়ি মাছ। আর বাউলা ফল দিয়ে হবে ভাঙ্গন মাছের ভুনা।

ড্রাম থেকে দুই কেজির ভাঙ্গন মাছটি দেখালো জেলে ভাই। কয়েকটি ড্রাম ভর্তি চিংড়ি মাছ। ওরা বললো, এবার যাওয়ার সময় মাছ দিবো। বাড়িতে নিয়ে যাবেন। বললাম, আমি তো জঙ্গল থেকে মাছ নেই না ভাই। ওরা বললো, সে আমরা জানি। কিন্তু আপনার নামে তো বিভিন্ন জায়গা থেকে মাছ ওঠে।

মহাজনেরা বলে, মোহসীন ভাইকে মাছ পাঠাতে হবে। মহাজনে বলে, ফরেস্টারের ওমুক স্যারকে মাছ দিতে হবে। পুলিশের ওমুককে মাছ দিতে হবে। মাঝে মাঝে বলে, বড় মাছগুলো ঢাকার ওমুক স্যারকে দিতে হবে। এভাবে আমাদের দামি সাছগুলো সব নেয় তারা। বাকী মাছের দাম দেয় কোনো রকম। ডাকাতে আর কী অত্যাচার করে! মহাজনদের অত্যাচারের কথা শুনলে মনে হয় ডাকাতই ভালো।
বললাম, আজকে কেমন মাছ হবে সব মিলিয়ে? ওদের ধারণা ১২ থেকে ১৫ ড্রাম মাছ হবে। শুধু বড় মাছগুলো তুলেছে তারা। সব মিলিয়ে ওজন হবে ২০ থেকে ২৫ মণ। তার মধ্যে বিভিন্ন বাতের চিংড়ি মাছ হবে অর্ধেকের বেশি। গলদা চিংড়িও আছে মণ খানেক।

চোখ কপালে উঠবে যে কারও। কুড়ি মণ সামুদ্রিক মাছের দাম কতো! আর মহাজনে দিবে কতো? উপহারের নামে কতোগুলো মাছ নিবে তারা এ দফায় কেউ জানে না। ডাকাতের সাথে দেখা হলে বড় মাছগুলো নিয়ে যাবে। ফরেস্টের লোকজন আসবে একটু পরে। ওরাও খাওয়ার মাছ নেয়। মাঝে মাঝেই তাদের বড় স্যাররা আসে। তখনও বড় মাছগুলো চলে যায়। আমাদের শুধু দিয়েই যেতে হয়।

(কেওড়াশুঁটি খাল, সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top