রূপান্তরের গল্প ২৯৫ | Rupantorer Golpo 295

প্রতিবাদ করলেই জঙ্গল ছাড়তে হয়! | রূপান্তরের গল্প ২৯৫

প্রতিবাদ করলেই জঙ্গল ছাড়তে হয়! | রূপান্তরের গল্প ২৯৫ | Rupantorer Golpo 295 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯৫ : আমরা এগিয়ে চলছি ডান দিকের খাল ধরে। জায়গাটি খুব সরু, কোনো রকমে একটি নৌকা নিয়ে চলা যায়। জোয়ার হয়েছে ঘন্টা দুই হলো। বড় খালে পানি বাড়লেও এখনও ছোট খালগুলোতে পানি আসেনি। একটু আগে যে দোঢালা পার হলাম, সেখান থেকে বাম দিকে আরেকটি খাল চলে গেছে। জেলেরা বললো বাম পাশের ওই খালটি ভাড়ানী খাল। মানে এদিক দিয়ে অন্য কোনো বড় খাল বা নদীতে যাওয়া যায়।

ওই ভাড়ানীর নাম কী? জানতে চাইলাম জেলেদের কাছে। বললো, সঠিক নাম জানি না। তবে আমরা বলি কাগার ভাড়ানী। খালের এদিকটা সরু হলেও উত্তর দিকটা বেশ চওড়া। তবে ট্রলার নিয়ে এদিক দিয়ে যাওয়া আসা করা সম্ভব না।

ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে কাগা খালে ওঠা যায়। তবে জায়গায় জায়গায় খাল আরও এতো ছোট যে ভরা জোয়ার ছাড়া নৌকা বাওয়া যায় না। এই পথে কাগা থেকে আসাও যায়। কিন্তু খাল ঠিকঠাক না চিনলে এদিক দিয়ে চলাফেরা করলে পথ হারানোর শংকা থাকে। এখানে একবার হারিয়ে গেলে পথ চিনে বের হতে পুরো এক দিন লাগবে।

এখন আমরা যে খালে যাচ্ছি সেটি বন্ধ মাথার খাল। মানে এদিক দিয়ে বের হয়ে অন্য কোনো খালে যাওয়া যাবে না। একই ভাবে এদিক দিয়ে কেউ হুট করে আসতেও পারবে না। এজন্যই জায়গাটি নির্ধারণ করেছে জেলেরা।

জেলেরা বললো, রাতে মহাজনের ভরের ট্রলার নাকী এখানেই আসবে। বললাম, এখানে তো ট্রলার ঢুকবে না। ওরা বললো, ছোট একটা ট্রলার আছে। মুহুরি সাহেব ঘুরে ঘুরে ওই ট্রলার নিয়ে আমাদের কাছ থেকে মাছ নিয়ে যায়। বড় ট্রলার থাকবে বড় খালের মুখে।

সুন্দরবনের সত্যিকারের সৌন্দর্য দেখতে এ রকম ছোট খালে ঢুকতে হয়। চারপাশে গাছপালা। গভীর আর জমাট বাঁধা বন। মাঝে মাঝেই বাইন আর ধুন্দল গাছ। ধুন্দল ফলগুলো দেখলে মনে হবে বেল ধরে আছে। আমার মতো অর্ধেক সুন্দরবন জানা মানুষেরা মনে করে বাউলা ফল। মনে মনে জঙ্গলের ওল বাউলা খুঁজছি।

এদিকে প্রচুর ধুন্দল দেখছি। কিন্তু বাউল ফলের কোনো আলামত নাই। সামনে ও পেছনে নৌকা বাইছে দুইজন। আমরা মাঝখানে বসে একবার এদিক, একবার ওদিক সরে নিজেদের গাছের ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচাচ্ছি। পৌঁছে গেছি জেলেদের বহরে।

নৌকাগুলো একটার সাথে আরেকটা বাঁধা। জেলেরা সবাই মাটিতে। এখানে জঙ্গল একটু পাতলা। একটু নিচু হয়ে দেখলে দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখানে কোনো ঝোপ নাই। বাঘের ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকার জায়গাও নাই। আক্রমণের শংকা কম বলে এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে জেলেরা।

মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে স্তুপ করে রাখা হয়েছে মাছ। নানা জাতের মাছ। বড় মাছগুলো নৌকার খোলে রেখে বারোমিশালী মাছগুলো রাখা হয়েছে এখানে। গোল হয়ে বসে সবাই মিলে কাজ করছে। জাত অনুযায়ী মাছগুলো আলাদা করছে কয়েকজন। তারপর সেগুলো ধুয়ে পরিস্কার করছে দুই জন। তারপর আবার সাইজ অনুযায়ী মাছ বাছাই করা হবে। পানি ঝরিয়ে তোলা হবে নৌকায়।

মাছগুলো ড্রামের ভেতরে রাখা থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। তারপর বরফসহ মহাজনের ট্রলার আসবে। মাছগুলো তুলে দিয়ে ওরা আবারও জাল নিয়ে নেমে পড়বে খালে খালে। এর মধ্যে পরের চরপাটা দেওয়ার সময় হবে। মানে এই জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা হয়ে যখন পানি একদম নিচে নেমে যাবে তখন ফেলা হবে জাল।

সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে আরেক চরে গিয়ে জাল টানানোর কাজ করবে ওরা। একই সময়ে খালপাটার জেলেরাও কাজে নামবে।

মাছ নেওয়ার সময় ওজন করা হবে। মহাজন নিজে বা তার মুহুরি বা ম্যানেজার সেই হিসাব খাতায় টুকে রাখবে। চিংড়িগুলো ততোক্ষণে একটু নরম হয়ে যাবে। মেপে নেওয়ার সময় মুহুরি বলবে, এই মাছ আর টিকানো যাবে না রে! বরফে রাখলেও আড়তে নিতে নিতে পচে যাবে। দাম পাওয়া যাবে না। তার মানে এই যে কয়েক মণ চিংড়ি মাছ ধরেছে এরা, এগুলো নরম হয়ে গেলে দাম দিবে না কোম্পানি।

জেলেরা বললো, যদি দয়া করে কিছু দেয় তো দিবে। না দিলে করার কিছু নাই। বললাম, মাছগুলো নরম হতে দিচ্ছেন কেন? বরফ রাখতে পারেন না? ওরা বললো, আমাদের কাছে বরফ রাখার নিয়ম নাই। মহাজন সন্দেহ করে। যদি মাছ সরিয়ে রাখি? যদি বরফে মাছ রেখে অন্য কারও কাছে বিক্রি করি! এজন্যই বরফ দেয় না।

এই জঙ্গলের ভেতর যতো ঢুকছি ততোই অবাক হচ্ছি! আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে মাছগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও বরফ রাখার নিয়ম নাই। জেলেদের জন্য যে আরও কতো শত নিয়ম আছে! অবশ্য দাদনে চুক্তিবদ্ধ হয়েও অন্যের কাছে মাছ বিক্রি করার অভ্যাসও আছে জেলেদের। তারও যুক্তি আছে।

পাশের নৌকা থেকে আরেক জেলে বললো, দাদনের মহাজন যদি মাছের দাম কম দেয় তাহলে আমরা করবো কী? নানা ছুতায় মাছের দাম কাটতেই থাকে, কাটতেই থাকে। একদিন বলে আড়তে দাম পড়ে গেছে, কখনও বলে আমদানী বেশি বলে মাছ বিক্রি হয়নি। আমাদের তো সংসারই চলে না। এর বাইরে ঋণের কিস্তি টানতে হয় কয়েকটা। মহাজন যা দেয় তাতে তো বাজার খরচই ঠিকমতো ওঠে না! অনেক বেশি মাছ ধরতে না পারলে সংসার চলে না।

এখানে যে মাছগুলো দেখছি সবগুলোই দামি মাছ। শহরে এগুলোর কোনোটির কেজি ৫০০ টাকার নিচে না। চাকা, বাগদা, গলদা, হরিনা, টাইগার চিংড়ি মাছের দাম আরও বেশি। জেলেরা বললো, আমরা মোটে দাম পাই না ভাই। শহরে এর দাম আছে ঠিক। জঙ্গলে তো আর দাম নাই। আমরা নিজেরা শহরে গিয়ে বেচতে পারলে আরও কিছু টাকা পেতাম।

গল্প অনেক হলো। ভেবেছিলাম নৌকাতেই বসে থাকবো। কিন্তু পারলাম না। নেমে পড়লাম জঙ্গলে। জেলেদের পাশে গিয়ে মাছ নিয়ে ছবি তুললাম। দেখলাম বেশ কয়েকটি বড় বড় ভেটকী মাছও পেয়েছে তারা। ট্রলার থেকে ভাত তরকারি এনেছি। হাঁড়িগুলো তুলে দিলাম জেলে ভাইদের হাতে। নামিয়ে নিয়ে তারা বললো, পরে খাবে।

এক কাপ চা নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। জেলেদের ছেড়ে একটু ভেতরেও গেলাম। জায়গাটি পরিস্কার, কাদা কম, বাইড়ে পোকার চাপও কম। ভেতরের দিক থেকে পাখির ডাক শুনছি। ভেতরে ঢুকতেই কয়েকটি বন মোরগ আর মুরগি দেখলাম। একটি মাঝারি আকৃতির বন্যশুকর দেখলাম। আর দেখলাম এক পাল হরিণ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তারা। সরদার বললেন, এরা আছে মানে আশেপাশে মামা নাই। একটু নিশ্চিন্ত হলাম।

সরদারকে জিজ্ঞেস করলাম, এখনও কি শরীর ভার ভার লাগছে? সরদার বললেন, একদম হাল্কা লাগছে ভাই। মানে বিপদ আশেপাশে নাই। বললাম, এটা কি নিশ্চিত যে সকালে মামা আশেপাশে ছিলো?

সরদার বললেন, আমাদের কথা আপনারা শহরের মানুষ বিশ্বাস করেন না। কিন্তু বিপদে পড়লে পরে ঠিকই মেনে নেন। হেসে দিলাম। বললাম, তারপরও কথাটা বিশ্বাস হয় না। কোনো কিছু না দেখে, না শুনে কী করে বিপদের আলামত টের পায় মানুষ? এটা অসম্ভব। সরদার বললেন, যেদিন সামনে বিপদ পড়বে সেদিন বুঝবেন। বললাম, বিপদে পড়ার দরকার নাই ভাই।

ফিরে এলাম জেলেদের কাছে। ধারণা করছি এখানে প্রায় ২৫ মণ মাছ আছে। খালের পাড়ে গিয়ে দেখি আরও বেশ কয়েকটি নৌকা আসছে এদিকে। ওরা খালপাটার জেলে। কাছে আসার পর দেখি তাদের নৌকাও মাছে ভরা। বড় বড় দাতিনা, পায়রা, চিংড়িতে ভরা নৌকার খোল। আরও কাছে আসার পর দেখি বিশাল বিশাল ভেটকী মাছ। যা বুঝলাম, চরপাটার চেয়ে খালপাটা জালে মাছ বেশি হয়েছে।

খালপাটার জেলেরা আমাকে দেখে একটু ভয় পেয়েছে। ভেবেছে প্রশাসনের লোক আমরা। মানে বন বিভাগ হয়তো অভিযান চালাচ্ছে। আসলে সুন্দরবনে খালপাটা জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ। ওরা বাড়তি ঘুষ দিয়েছে এই জালের জন্য। বললো, খালপাটায় মাছ ধরতে দেখলে ফরেস্টাররা মাইন্ড করবে। এমনিতে অভয়াশ্রম, এখানে প্রবেশ করাই নিষেধ।

জেলে বহরের প্রধান একজন মুরুব্বি। উনি বললেন, আপনি সাংবাদিক মানুষ। আপনাকে সম্মান করি। কিন্তু এই নিয়ে কোনো সংবাদ করেবেন না দয়া করে। এতোগুলো মানুষের পেট চলে এই করে। বললাম, আপাতত আমি ডাকাতদের সারেন্ডার নিয়ে কাজ করছি। এখন আপনাদের এই অকাজ নিয়ে কোনো কাজ করার সময়ও নাই। তবে আপনারা ধীরে ধীরে এসব ছেড়ে দেন। বৈধ জায়গায় বৈধ পদ্ধতিতে মাছ ধরেন।

প্রবীন ওই জেলে বললেন, বৈধ জায়গাগুলো সব তো বড় সাহেবরা দখল করে রেখেছে। আমরা গেলে পিটায়ে তাড়াবে। ডাকাত দিয়ে শায়েস্তা করবে। ফরেস্ট দিয়ে মামলা দিবে। তাতেও না হলে দুই পোঁটলা গাঁজা দিয়ে প্রশাসনের কাছে তুলে দিবে। এদিকে ওরা যা বলে সেটাই আইন। ওদের কথায় সবাই ওঠে বসে। আমরা সামান্য জেলে। একটু কথা বললেই জঙ্গল ছাড়তে হবে। আবারও বললেন, আমি যেন তাদের নিয়ে কোনো সংবাদ না করি। বললাম, এখন করবো না। কিন্তু সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ার পর কিন্তু ছাড় দিবো না!

ওরা বললো, ডাকাত উঠে যাবে এতো সহজে? জেলে বহরের প্রধান বললেন, এই সুন্দরবনে যতোদিন গাছের পাতা থাকবে, ততোদিন ডাকাতও থাকবে। আমি বললাম, এই জঙ্গলে শুধু গাছের পাতাই থাকবে। দেখবেন ডাকাতেরা সব উঠে গেছে। একটা হাসি দিলেন তিনি। তারপর সবাইকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন।

(নভেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top