রূপান্তরের গল্প ২৯৯ | Rupantorer Golpo 299

যতো ভয়, ততো লাভ | রূপান্তরের গল্প ২৯৯

যতো ভয়, ততো লাভ | রূপান্তরের গল্প ২৯৯ | Rupantorer Golpo 299 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ২৯৯ : এমনিতে দেখা যায় জঙ্গল আর পানি। কিন্তু এর ভেতরে আছে টাকা আর টাকা। আছে বনদস্যুদের অস্ত্রের ঝনঝনানি। আর আছে কাঁচা টাকা। যার কাছে পরাজিত এক শ্রেণির বনরক্ষী, কর্মকর্তা। এখানে নিপীড়ন আর দুর্নীতি চলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, নিরাপদে। অনিরাপদ শুধু জেলেরা, অনিরাপদ সুন্দরবন।

ভাবছি, সুন্দরবনের এই বিপন্নতা তো আজকের না। কিন্তু এসব নিয়ে কেন কেউ কাজ করেনি? বছরের পর বছর ধরে বড় বড় পত্রিকার বড় বড় সাংবাদিককে কাজ করতে দেখেছি। তারা এই সমস্যা নিয়ে কোনোদিন সংবাদ করেননি। কিছু দৈনন্দিন খবর পাই। কিন্তু নিবিড় ভাবে কাজ এখানে কখনোই হয়নি।

চা খেতে খেতে গল্প চলছে। খালের পাশ বরাবর পানি উঠে এসেছে। পুরো জোয়ার হবে হবে। এদিকে জেলেদের মাছ গোছানো শেষ। সকলেই বেশ ক্লান্ত। হাতমুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছে জেলেরা।

কোম্পানি থেকে ওদের বেশ বকাঝকা করা হচ্ছে। আমাকে নিয়েই সমস্যা। কারণ অভয়াশ্রমে এসব অপকর্ম চলছে তারা তা দেখাতে চায় না। আমার মতো বাইরের মানুষ এসব দেখে ফেললে ওদের সমস্যা হতে পারে।

এবিষয়ে মহাজনের চাপাচাপিতে জেলেরা বেশ অপ্রস্তুত। আমাকে কেন সাথে রেখেছে? এ নিয়ে মহাজন আর মুহুরি তাদের থ্রেট দিচ্ছে। জেলেরা বললো, আপনি মন খারাপ করবেন না ভাই। বললাম, মন খারাপ করিনি। কিন্তু ওদের এই কাহিনী দেথে বেশ মজা পাচ্ছি।

জানতে চাইলাম, মুহুরি মাছ নিতে কখন আসবে? জানতে চাইলাম জেলেদের কাছে। ওরা বললো, আসবে না ভাই। আপনার ট্রলার দেখলে ওরা আসবে না। বললাম, কোথায় আসার কথা তাদের? ওরা বললো, এখানেই আসবে।

জেলে বহরের নেতা বললেন। বড় ট্রলার থাকবে কাগা খালের ভেতর। কালেকশনের ট্রলার নিয়ে মুহুরি বের হবে। ঘুরে ঘুরে এই খালেই আসবে। ভরা জোয়ারের সময় ঢুকবে ওরা।

এখন চলছে শেষ মুহুর্তের ব্যস্ততা। ড্রামে ড্রামে বাড়ি খাচ্ছে, মাছে মাছে বাড়ি খাচ্ছে। অনেক কাজ। এর মধ্যে দুধ চা বানিয়ে আনলো একজন। নৌকা বহরের অন্যরাও ফাঁকে ফাঁকে চুমুক দিচ্ছে চায়ে।

শীত কমেছে। রোদ উঠেছে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে একজন দুইজন করে ভাত খেয়ে নিচ্ছে। জেলেরা বললো, এসময় ভাত খাওয়ার অভ্যাস নাই। অন্য দিন এসময় তারা কড়া লিকারের চা খেয়ে কাটায়। ভাগ্যিস ওদের জন্য ভাত নিয়ে এসেছিলাম!

জোয়ারের পানি এখন জঙ্গলের ওপর উঠে গেছে। মানে যেখানে মাছ গোছানো হলো সেখানে এখন পানি। জেলেদের গায়ে-পায়ে বাইড়ে পোকা কামড়াচ্ছে।

এ সময় জঙ্গলে বাইড়ে পোকার চাপ বাড়ে। তবে এবার আর সেভাবে গায়ে বসছে না। তার মানে শ্যাম্পু কাজ করছে। জেলেরা বলে, শীতকালে এটা কাজ করে। কিন্তু বর্ষায় শ্যাম্পু ধুয়ে যায় বৃষ্টিতে। তাই সে সময় কেরোসিন বা সরিষার তেল মাখতে হয়। আমি অবশ্য এখন ফুলহাতা গেঞ্জি আর ফুলপ্যান্ট পড়েছি। খোলা অংশটুকুতে শ্যাম্পু মেখেছি। বাইড়ে পোকার কামড় আর নিতে পারবো না।

খালের ভেতরে জেলেদের এই সমাবেশ দেখতে ভালোই লাগে। কতো গল্প শুনি! কতো কিছু দেখায় তারা! ওরা বলে, কীসের অভয়াশ্রম! পায়ের ছাপ নাই এই বাদা বনে এমন কোনো জায়গা দেখি না। অথচ আনুষ্ঠানিক ভাবে সুন্দরবনের এই অংশে মানুষের প্রবেশ একদম নিষেধ।

বন বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়। অভয়াশ্রম নিশ্ছিদ্র করার বিষয়ে আন্তরিকতা আছে। কিন্তু কয়েকটি কারণে উপায় নাই। প্রথমত বনদস্যুদের শক্ত অবস্থানে যেতে পারছে না বন বিভাগ। খাল-নদীতে মাছ শিকারের বিষয়টি দস্যুরাই নিয়ন্ত্রণ করে।

আরেকটি কারণ, বৈধ এলাকা কিছু বড় ব্যবসায়ীর দখলে। সেখানে সাধারণ জেলেরা জাল ফেলতে পারে না। আবার মাছের দাম না পাওয়াও একটি কারণ। পেট চালাতে হলে অনেক বেশি মাছ ধরতে হয় জেলেদের। বেশি মাছের জন্য তারা অভয়াশ্রমে আসে, নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকার করে। নিষিদ্ধ সময়ে নিষিদ্ধ জায়গায় বিষ দিয়ে মাছ শিকার করে। সব মিলিয়ে যে অত্যাচার এই বনের ওপর হচ্ছে তা বর্ণনাতীত।

আমি যখন অনিয়মের কথা বলি, লিখি কিংবা সংবাদ করি, তখন অনেকেই রাগ করেন। বনকর্তা ও বনকর্মীরা অনেকে অপকর্মটিকে নেতিবাচক ভাবে নেওয়ার চেয়ে আমার কথা বলাকেই বেশি নেতিবাচক মনে করেন।

অনেকেই বলেন, সুন্দরবনে আমাকে প্রবেশ করতে দেওয়া যাবে না। সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা কিছু সাংবাদিক বলেন, সুন্দরবনে নানা রকমের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে মোহসীন উল হাকিম। কী সেই অপকর্ম? বেশির ভাগের অভিযোগ, সাংবাদিক মোহসীন বনদস্যুদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়।

সুন্দরবনের গহীনের অপকর্ম নিয়ে আমার দেওয়া তথ্যগুলোকে কেউই গ্রহণ করতে চান না। বলেন, বানিয়ে বানিয়ে এসব লিখি আমি। শুধু তাই না, সুন্দরবনে বিষ দেওয়া, অবৈধ হরিণ শিকার, অভয়াশ্রমে মাছ শিকারের বিষয়ে তারা আমার সংযোগ খুঁজে পান। বনদস্যুদের নিয়ে আমার কাজকেও নেতিবাচক ভাবেই দেখেন তাঁরা।

অনেকগুলো দস্যুদল এরই মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে। তার মধ্যে বড় কয়েকটি দল ছিলো। যাদের দাপটে সুন্দরবনের খালে ঢুকতেই ভয় পেতো বন বিভাগসহ প্রশাসনের অনেকে। সেই দাপট এক বছরে কমেছে।

এক বছর আগেও দস্যুরা ঘুরে বেড়াতো ইচ্ছা মতো, মন চাইলেই বন বিভাগের অফিসে গিয়ে উঠতো, বনরক্ষীদের বের করে তাদের অফিসে দিনের পর দিন থাকতো।

বন টহল ফাঁড়ীতে বসেই বনদস্যুরা গুলি করে বন্যপ্রাণি শিকার করে। অফিসের রান্নাঘরে হরিণের মাংস রান্না হতো। তাদের বিশ্বস্ত জেলেদের কিছু বললে অফিস ঘেরাও দিতো, চদাও হতো বনরক্ষীদের ওপন।

বড় দলগুলো সারেন্ডার করায় এই এক বছরের মাথায় এসে দস্যুদের দাপট একটু কমেছে। কিন্তু বন বিভাগের কাউকে একবার ধন্যবাদ জানাতে দেখলাম না। দুই-তিনজন বনকর্তা অনানুষ্ঠানিক ভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কিন্তু এর বাইরে প্রায় সকলেই আমাকে ভিলেইন মনে করছেন।

সুন্দরবনের বড় বড় মাছ ব্যবসায়ীদের দিক থেকেই এক লাইনের ধন্যবাদ পাইনি এখন পর্যন্ত। বরং সুন্দরবনে আমার উপস্থিতির কারণে অনেকেই বেশ অস্বস্তিতে থাকেন।

এদিকে কিছু মহাজন আমাকে সুন্দরবন থেকে তাড়াতে চায়। তারা বড় করে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন। জেলেদের উস্কানী দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।

না পেরে বন বিভাগসহ বিভিন্ন দফতরে তারা আমার বিষয়ে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছেন। ভুয়া স্বাক্ষর দিয়ে জেলেদের নামে বেলায়েত সরদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তাঁরা। সেগুলো দিচ্ছেন বন বিভাগ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায়। আসলে সুন্দরবন থেকে আমাকে তাড়াতে চলছে নানামুখি ষড়যন্ত্র।

ঢাকায় বসে নিয়মিত এই খবরগুলো পাই। কিন্তু ওদিকে সময় দেওয়ার সময় আমাদের হাতে নাই। কারণ দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। এখন শুধু লেগে থাকতে হবে। পাশাপাশি জেলেদের বঞ্চনার কথাগুলোও তুলে ধরতে হবে।

জানি বনদস্যুতার বিলুপ্তি ও জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে বড় সাহেবদের বিশাল বড় লাভের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়বে। জেলেদের ভয় কাটবে। জেলেরা প্রতিবাদ করবে, প্রতিরোধও করবে। তখন এতো বছরের তাদের চালানো ভয়ের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে।

শুনেছি গোপনে পাঠানো তথ্যের ওপর নানা রকম প্রতিবেদন তৈরির অপচেষ্টা চলছে। স্থানীয় সাংবাদিকদের নানা ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সাংবাদিকরা আমাকে পছন্দ না করলেও সত্যাটা জানেন। তাই কাজ হচ্ছে না।

বনদস্যুদের অপকর্ম থামাতে আমাদের যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তাতে হাত মিলিয়েছেন অনেকেই। আবার দস্যুতার সুবিধাভোগীদের তৎপরতাও বেড়েছে। এই যুদ্ধ চলবে জানি। তবে শেষ পর্যন্ত দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়তে আমাদের চেষ্টাও চলবে।

প্রতিবন্ধকতা আসবে জানি। কিন্তু কাজটি শেষ করতে পারলে শুধু সুন্দরবন না, পুরো উপকূলের জেলেদের জীবন নিরাপদ হবে। সুন্দরবন থেকে ফিরেই দস্যুদলগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করবো। এরপরের টার্গেট- বনদস্যু নোয়া বাহিনী।

(সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top