রূপান্তরের গল্প ৩০১ : রামপালের এক জেলে বিদ্রোহ করে বসলো। মোটামুটি অবস্থাসম্পন্ন। পুঁজি প্রায় ত্রিশ লাখ টাকা। এরকম পুঁজি অনেক জেলেরই আছে। তারপরও সকলেই দাদনের জালে জিম্মি।
২০০৭-২০০৮ সালের কথা। সাহস করে রামপালের সেই জেলে প্রতিবাদ করে। ঘোষণা দেয়, নিজের মতো করে মাছ ধরবে, বিক্রি করবে নিজের ইচ্ছা, যেকোনো আড়তে। বিষয়টি কেউ সহজ ভাবে নিচ্ছে না। মহাজন বেশ ক্ষিপ্ত। কিন্তু অবস্থাসম্পন্ন জেলে হওয়ায় সরাসরি কিছু করতে পারলো না। তখন সুন্দরবনের এমাথা থেকে ওমাথা বড় বড় দস্যুদলের দখলে। পুরো বন-উপকূলে ডাকাতের আতঙ্ক।
মৌসুম শুরু হলো। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে বহর নিয়ে নামলো সেই জেলে। প্রথম গোনে জাল ভরে মাছ উঠলো। রূপচাঁদার ঝাঁক পড়লো এক জালে। আরেক জালে পড়লো বড় বড় মেধ মাছের ঝাঁক। সব মিলিয়ে দশ লাখ টাকার বেশি দাম হবে। মাছগুলো কাঁচা অবস্থায় বিক্রি করবে খুলনায় মাছের আড়তে। এদিকে প্রথম জালে মাছ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। সাথে ছড়িয়ে পড়লো ওই জেলের নাম।
বরফের কেবিনে মাছ ভরে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ট্রলার। রাতের পথ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই মাছবাহী ট্রলার রওনা দিলো দিনের বেলা। জোয়ারে ছুটলো তারা।
পশুর নদী ধরে যাওয়ার পথে ডান পাশ থেকে ডাকাত দল সিগন্যাল দিলো। নদীর পূর্ব পাশ তখন জুলফু বাহিনী নামে বেশ ডাকসাইটে এক দস্যুদলের দখলে। প্রথম ইশারা আসলো চারগাঙ পার হওয়ার পর ইন্দুরকানি খাল থেকে। না দেখার ভান করে এগিয়ে গেলো ট্রলার।
নদীর কূল ছেড়ে এবার মাঝ নদী ধরে চললো তারা। এরপর ঘসিয়াঙ্গাড়ী খালের ভেতর থেকে একটি নৌকা থেকে আবারও ইশারা দিলো দস্যুরা। থামতে বললো। কথা না শুনে আরেকটু নদীর মাঝখানে নিয়ে এগিয়ে চললো ট্রলার। বন্দুকের গুলির রেঞ্জ-এর বাইরে দিয়ে ছুটছে ট্রলার।কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
আরেকটু সামনে এগিয়ে চাইলেবগীর ঠোঁটার কাছে যেতেই ট্রলার নিয়ে এগিয়ে আসলো জুলফু বাহিনী। গুলি করতে করতে আক্রমণ করলো। মাঝিদের জিম্মি করলো। ট্রলারসহ ধরে নিয়ে গেলো বনের ভেতর।
মাছের ট্রলারের মাঝির বুকে বন্দুক ধরলো দস্যুরা। মারপিট করতে করতে তাদের টেনে নিয়ে গেলো গহীন বনে। চরাপূঁটিয়া আর ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মাঝামাঝি কোনো এক সরু খালে থামলো তারা। এরপর দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো সবাইকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে আসলো আরেকটি মাছ পরিবহনের ট্রলার। অপহৃত ট্রলারের মাছগুলো তোলা হলো সেই ট্রলারে। সাথে সাথে সেটি রওনা দিলো খুলনার পথে। জোয়ারের স্রোতের সাথে মাছগুলো চলে গেলো খুলনার আড়তে। সবকিছু ঠিকঠাক। শুধু মাছের মালিক বদল হলো।
অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো জেলেদের ওপর। অপহরণ করা ট্রলার ও মাঝি বাবদ দস্যুরা মুক্তিপণ চাইলো দশ লাখ টাকা। দিশেহারা সেই জেলে এদিক ওদিক ছুটলো। কিন্তু সুরাহা করতে পারলো না।
একদিকে দস্যুদের কাছে জিম্মি তার লোকজন আর সম্পদ, অন্যদিকে চোখের সামনে তার মাছ বিক্রি করলো আরেকজন। প্রশাসনে দৌড়ঝাঁপ করেও কোনো ফল আসলো না, পরাস্ত হলো। কেউ কোনো আশ্বাস দিলো না। দশ লাখ টাকার মাছ গেলো, আরও দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে। তাহলে আর থাকে কী?
এখন পথ একটাই খোলা। আগের মহাজনের কাছে গিয়ে হাত পা ধরে কান্নাকাটি করলো। দর কষাকষি করে মুক্তিপণ দশ লাখ থেকে কমিয়ে দুই লাখ ঠিক করে দিলেন সেই ব্যবসায়ী। নগদ পরিশোধ করে ফিরে আসলো জেলে।
মাঝিরা ফিরলো তিন দিন পর। কিন্তু ট্রলার আর ফেরত দেয়নি বনদস্যুরা। আবারও দেন দরবারের চেষ্টা করলো। কিন্তু এই মাছ ধরার মৌসুমে এতো সময় কোথায়? উপায় না পেয়ে আবার মহাজনের দাদনে ফিরে আসলো সেই জেলে।
কয়েক বছর পর দুবলার চরে পরিচয় হয়েছিলো রামপালের সেই জেলের সাথে। তাঁর মুখেই শুনেছি ঘটনাগুলো। সরাসরি না বললেও তার বক্তব্যের সারমর্ম ছিলো- মহাজনেই ডাকাত দিয়ে তার ট্রলার ধরিয়ে দেয়।
সুন্দরবনে ভয় আর আতঙ্কের যে পরিবেশ আছে তারা তা ধরে রাখছে বনদস্যুদের ব্যবহার করে। এই ভয় কেটে গেলে ইচ্ছা মতো ব্যবসা করার সুযোগ থাকবে না। জেলেদের সাহস বেড়ে যাবে। দর কষাকষি করবে।
সাহস করে দাদন থেকে বের হওয়া এই জেলেকে দেখে অন্যরাও উৎসাহিত হয়েছিলো। অনেকে নিজেই মাছের কারবার করার কথা ভাবছিলো। কিন্তু পরের ঘটনাগুলো আবারও তাদের আগের চিন্তায় ফিরিয়ে নেয়। তীব্র ভয় তৈরি হয় সেই ঘটনায়। চলমান থাকে মহাজনের রমরমা ভয়ের বাণিজ্য।
দীর্ঘদিন সুন্দরবনের সশস্ত্র দস্যুদের নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে অর্ধ শতাধিক বার ওদের আস্তানায় গেছি। গল্পে গল্পে ভেতরের অনেক কিছুই জেনেছি যা কখনও বাইরে আসে না।
সুন্দরবনের ডাকাতদের গডফাদার কারা? শুনি অনেক কিছু। বড় বড় রাজনৈতিক নেতার নামও চলে আসে। কিন্তু আসলেই কি বিষয়টি তেমন? অনেক ভাবে খোঁজ খবর নিয়েছি। গল্পে গল্পে জানার চেষ্টা করেছি। কোনো ভাবেই এই চক্রের সাথে বড় কোনো রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি কোনো সংযোগ পাইনি। পেয়েছি কিছু মাছ ব্যবসায়ীর তালিকা।
বিভিন্ন পর্যায়ের মাছ ব্যবসায়ীদের নিবিড় সম্পর্ক জলদস্যুদের সাথে। উনারা বলেন, চাঁদা না দিলে ব্যবসা করতে পারি না। এসব বলে অনুকম্পা নেওয়ার চেষ্টা করে, নিজেদের অসহায়ত্ব দেখায়। কিন্তু ভেতরের খবর অন্য রকম। যা পর্যায়ক্রমে জানতে পেরেছি।
আমরা আছি কেওড়াশুঁটি খালে। দুই দিন হলো এই খালের আশেপাশের ছোট খালগুলোতে ঘুরছি। দেখছি চরপাটা, খালপাটা আর কাঁকড়ার জেলেদের বিচিত্র জীবন। এখানে আমার উপস্থিতি নিয়ে মহাজনের অস্থিরতার খবর পাচ্ছি।
অস্বস্তিতে আছি বনদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনীকে নিয়ে। সে এদিকেই থাকে। যদি সামনে পড়ে তবে ঝামেলা হতে পারে। আরেক দস্যু দল নোয়া বাহিনীও জেলেদের অপহরণ করে এদিকেই কোথাও আছে। নোয়া বাহিনীর সাথে সম্পর্ক ভালো। তাদের সাথে দেখা হলেও সমস্যা নাই।
নৌকা বেয়ে আমরা চলে এসেছি আগের খালে। সেখানে চরপাটা ও খালপাটার জেলেদের কাছ থেকে মাছ নিচ্ছে মহাজনের লোকজন। মুহুরি সাহেব আমার পুরনো পরিচিত। দেখেই সালাম দিলেন। উত্তর দিয়ে বললাম, আপনাদের সমস্যা কী? আমাকে নিয়ে এতো দুশ্চিন্ত কেন আপনাদের? উত্তর না দিয়ে উনি বললেন, ও ভাই, তেমন কিছু না। আপনি তো আমাদেরই লোক।
নৌকায় বসে ওদের কাজ দেখছি। মান্ধাত্যার আমলের দাড়ি-পাল্লা দিয়ে চলছে মাপ। বাটখারাগুলো দেখলে মনে হয় দুই যুগ আগের। দুই কেজি, এক কেজি, আধা কেজির বাটখারা তোলা এক পাল্লায়। আছে কয়েকটি ইটের টুকরোও।
মহাসমারোহে মাছ মাপছে মহাজনের কর্মচারিরা। ওজন করছে ইচ্ছামতো। জেলেরা শুধু তাকিয়ে দেখছে। প্রতি পাল্লায় তাদের ঠকানো হচ্ছে। আর তার মধ্যে মাছের মান নিয়ে কথা বলছেন মুহুরি সাহেব। জেলেরা তারপরও চুপ।
নৌকা থেকে উঠে পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। সবগুলো বাটখারা মিলিয়ে এক পাশে পাঁচ কেজি করা হয়েছে। চিংড়ি মাছগুলো মাপার সময় মনে হলো প্রতি পাল্লায় অন্তত এক-দেড় কেজি মাছ বেশি নিচ্ছে। বললাম, বাটখারার কী অবস্থা বলেন তো? সারাদেশে ডিজিটাল পাল্লা ব্যবহার করা হয়। আপনারা কেন করেন না?
মুহুরি সাহেব বললেন, লবণ পানি তো ভাই। ওই পাল্লা টিকে না। বললাম, বাটখারা তো টিকে। এভাবে জোড়া তালি দিয়ে মাছ মাপছেন কেন? মহাজনের আরেক কর্মচারি বললো, এবার গিয়ে নতুন বাটখারা কিনে নিবানে ভাই। আমি জানি নতুন পাল্লা বা বাটখারা কিনবে না তারা। কারণ জেলেদের সঠিক মাপ দেওয়ার অভ্যাস নাই এদের। জেলেদেরও আপত্তি করার সুযোগ নাই। কারণ সেই ভয়। মহাজনকে চ্যালেঞ্জ করে কেউ বিপদে পড়তে চায় না।
পাল্লা আর বাটখারা দিয়ে চলছে ওজনের কারসাজি। মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে কমানো হচ্ছে মাছের দাম। অথচ আজ সকালেই মাছগুলো তোলা। বললাম, আপনারা তো জেলেদের মেরে ফেলছেন ভাই। মুহুরি বলেন, আমাদের মতো মাছের দাম আর কেউ দেয় না ভাই। এছাড়া আমাদের দাদনে না থাকলে কি এরা অভয়াশ্রমে মাছ ধরতে পারবে? হয় ফরেস্ট আটকাবে, না হয় ডাকাতে ধরবে। বললাম, তার মানে এই দুই জায়গা আপনারা ম্যানেজ করে মাছ ধরেন? মুহুরি বলেন, সব জায়গা ম্যানেজ করি ভাই। নৌকা প্রতি ডাকাতের চাঁদা দেই, ফরেস্ট অফিসও ম্যানেজ করি। জেলেদের আনা নেওয়া, বাজার খরচ সব কোম্পানি বহন করে।
এই মাছের দাম কতো করে দিবেন? জানতে চাইলাম। মুহুরি বললেন, মাছ তো নরম হয়ে গেছে ভাই। এছাড়া আড়তে নিতে নিতে কোনো মাছই আর নেওয়ার মতো থাকবে না। সুন্দরবনের মাছের দাম পাওয়া যায় না ভাই। বললাম, ডাকাত দলকে শুধু টাকা দিলেই হয়? ওদের বিশ্বস্ত হতে হয় না? মুহুরি বললেন, মহাজনের সাথে ডাকাত দলের খুব ভালো যোগাযোগ। উনিই সবকিছু ম্যানেজ করেন।
এতো সময় ধরে জেলেদের বঞ্চনা নিয়ে কথা হচ্ছে। মাছের মাপ আর দাম নিয়ে এতো কথা হলো। কিন্তু জেলেরা কোনো কথা বলছেন না। বুঝতে পারলাম, তীব্র চাপের মধ্যেই থাকতে হয় তাদের। চাপের মধ্যে রাখা হয়। তাই মনে যতো কষ্টই থাকুক, কোম্পানির লোকজনদের সামনে কোনো কথা বলে না তারা। কারণ এরাই সুন্দরবনের সবকিছুই মহাজনের নিয়ন্ত্রণে।
কথা না শুনলে তাদের সুন্দরবনে নামা বন্ধ হয়ে যায়, কিছুদিন পর পর দস্যুদল পরিবর্তন হয়, কিন্তু মহাজন পরিবর্তন হয় না। ওদের দাপটও কমে না। অভাবে জেলে মরে, বন্দুক যুদ্ধে ডাকাত মরে, কিন্তু মহাজনেরা থেকে যায় আগের জায়গায়।
জেলেদের চোখগুলো জ্বলজ্বল করছে। কষ্ট, ক্ষোভ, অসহায়ত্ব মিলিয়ে অদ্ভুত এক চেহারা। মুহুরির সাথে আমার কথোপকথন তাদের আলোড়িত করছে। কারও কারও চোখের কোণে পানি জমছে। এই জঙ্গলে চোখ আর নদীর নোনা পানি মিশে যায়। লবণ জলের জীবনগুলো বয়ে যায় এভাবেই।
(সুন্দরবন ২০১৬)