রূপান্তরের গল্প ৩০৪ | Rupantorer Golpo 304

কেওড়া-আলুর খাটা, সাথে চিংড়ি খিচুরি | রূপান্তরের গল্প ৩০৪

কেওড়া-আলুর খাটা, সাথে চিংড়ি খিচুরি | রূপান্তরের গল্প ৩০৪ | Rupantorer Golpo 304 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৪ : ঘটঘট শব্দ তুলে আবার থেমে যাচ্ছে। ইঞ্জিন রুমে ঢুকে ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করার চেষ্টা করছে মামুন। বার বার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ইঞ্জিন আর চালু হচ্ছে না। ডেক এর ওপর থেকে সরদার বললেন, তেলের পাইপে বাতাস ঢুকলো কী করে?

ট্রলার আর এর ইঞ্জিন নিয়ে বেশ জানাশোনা সরদারের। শব্দ শুনেই বলে দিতে পারেন কোন কোম্পানির ট্রলার, এর শক্তি কেমন, ইঞ্জিনের কন্ডিশন কেমন! শহীদুল কাকাকে ধমক দিয়ে ইঞ্জিন রুমে পাঠালেন।

বড়শি গুটিয়ে উঠে পড়লাম। জোয়ার হচ্ছে। সরদার বলে, বালির গাঙ এ গেলে এখন স্রোতের সাথে যাওয়া যাবে ভাই। বললাম, চলেন যাই। রাতের রান্নাবান্না ওখানে গিয়ে করবোনে। এছাড়া নৌকা নিয়ে ওরা কারা আসছিলো সেটাও বুঝা দরকার। বনদস্যু হলে ওরা ওদিকে থাকার কখা।

তেলের লাইন খুলে পরিস্কার করা হলো। তারপর সুকানিতে গিয়ে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন সরদার। কুয়াশা পড়েছে বলে দেখতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে বড় খাল বলে পথ চলতে সমস্যা হবে না।

সামনে বেশ কয়েকটি বাঁক পার হয়ে নীল কমল নদী। তবে তার আগে এই কেওড়াশুঁটি খাল সরু হয়ে এসেছে। মুখের দিকে খালটি গভীরতা কম। গভীরতাও কম। অবশ্য জোয়ার হচ্ছে। পানি আরেকটু বাড়লে পার হয়ে যেতে পারবো।

শীত পড়েছে বেশ। ভারী জ্যাকেটেও শীত মানছে না। কানটুপি, মাফলার জড়িয়ে সরদারের পাশে দাঁড়ালাম। সামনে গলুইয়ে দাঁড়ানো শহীদুল কাকু। টর্চ হাতে দাঁড়ানো তিনি।

সামনে খাল বেশ সরু। একটু পর পর চর্টের আলো ফেলে দুই পাশ দেখিয়ে দিচ্ছে। ট্রলার চলছে মাঝখান দিয়ে।

দুই পাশে মাঝারি আর ছোট খাল। তার ভেতরে লোকজন আছে। ট্রলারের শব্দ শুনে তড়িঘড়ি করে ওরা নিজেদের আড়াল করার চেষ্টা করছে। মাঝে কয়েকটি নৌকা দেখলাম মূল খালে। সম্ভবত গভীর ঘুমে আছে জেলেরা। ছইয়ের দুই পাশ কাঁথা দিয়ে ঢাকা।

সরদার বেশ সতর্ক। চলার পথ এখানে ঝামেলার না। রাতের বেলা বনদস্যুদের মুখোমুখি হওয়াটা ঝুঁকির। সরদার বললেন, সন্দেহ ভাজন নৌকা দুটি এদিকেই আসছে। কোনো লুকিয়ে আছে। ওদের ভয় দেখানো যাবে না। ভয়ে পেলে হুটহাট গুলি করে বসতে পারে।

শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো ঝামেলা হলো না। ট্রলার উঠলো নীল কমল নদীতে। এদিকটা নিরাপদ। এই নদীতে দস্যুরা আসে না। চুরি করে মাছ ধরে জেলেরা। তবে ফরেস্ট অফিস কাছে থাকায় একটু আড়াল করে চলে সব অপকর্ম।

নীল কমল নদীতে উঠে বাম দিকে গেলে ফরেস্ট অফিস। আমরা পশ্চিমের পথ ধরলাম। এদিকে কুয়াশা বাড়ছে। চারপাশ ভারী হয়ে এসেছে। ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকারে চারপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এই পরিবেশে সুন্দরবনের খাল নদীতে চলতে গেলে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। গাছের সঙ্গে ধাক্বা খেয়ে কতো ট্রলার ভেঙ্গেছে, তার নাই ঠিক। তাই আমরা চলছি ঢিমে তালে।

প্রায় ধন্টা দেড়েক চললাম। তখন ভরা জোয়ার। উত্তরা বাতাসের সাথে দখিণা স্রোতের সংঘর্ষে ঢেউ বেড়েছে বড় নদীতে। তার রেশ এসে পড়ছে খালে। আড়পাঙ্গাসিয়া নদীর মুখের খাল বালির গাঙ এ আমরা।

ট্রলারের গতি কমানো হলো। অন্ধকার এখন আরও গভীর। কুয়াশায় দশ ফুট দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না। আমাদের দেখলে খালপাটার জেলেদের ইশারা দেওয়ার কথা। সরদার বললেন, ইশারা হয়তো দিছে ভাই। এই কুয়াশায় তা দেখবো কী করে?

খালের মাঝ বরাবর নোঙ্গর করলাম। ইঞ্জিন বন্ধ হলো। চারপাশে বাতাস, পানি আর ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। কোলাহল নাই। সাগর কূলের এই জায়গাটি অদ্ভুত সুন্দর। পানি এতো বেশি যে নোঙ্গর করতে অতিরিক্ত দড়ি লাগানো লাগলো।

ভাটা শুরু হয়েছে। রাত বাজে সাড়ে বারোটা। তার মানে ভাটা শেষ হতে হতে আরও প্রায় ছয় ঘন্টা। খালপাটার জেলেদের মাছ ধরার সময়টা তখনই। মাঝের সময়টুকু কাটাতে হবে। আমরা রান্নাবান্না আর খাওয়া দাওয়া করে সময় টুকু কাটিয়ে দিবো।

এই মামুন, কেওড়াগুলো বের কর। শীতের মধ্যে কেওড়ার টক জমবে ভালো। মামুনকে ডাক দিয়ে আরও কিছু নির্দেশনা দিলেন বেলায়েত সরদার। শহীদুল কাকুকে বিশ্রামে যেতে বললাম। সকালে অনেক কাজ।

সরদাররের একটা সমস্যা আছে। সাধারণত যে রান্নার কথা বলেন পরের বেলায় সেটা আর করতে পারেন না। আসলে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে সেটা সম্ভবও না। তাই এই গভীর রাতে চিংড়ি খিচুরি হবে কী না সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু সরদার আজ খিচুরি করবেনই। বরফের বাক্স থেকে চাকা চিংড়ি বের করা হলো। চাল-ডাল ধুয়ে নিলো মামুন। সবকিছু জোগাড় করতে সময় লাগবে। এর মাঝে কেওড়ার খাটা রান্না হবে। সরদার বললেন, আচার নাই। তাই একটু ঝাল দিয়ে কেওড়ার টক বানাবো।

সরদারের রান্নাঘরের পাশেই বসেছি। ঠান্ডা বাতাসে ঠকঠক করে কাঁপছি। মামুন এসে দুই পাশের খোলা অংশে চাদর বেঁধে দিলো। গল্প আর রান্নায় কেটে গেলো প্রায় দুই ঘন্টা। ততোক্ষণে অর্ধেক ভাটা হলো। আশেপাশে জেলেদের কোনো খোঁজ খবর নাই।

তীব্র ক্ষুধা। তার মধ্যে আগুন গরম চিংড়ি খিচুরির সেই স্বাদ বলে বা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। তার সাথে পাকা কেওড়ার খাটা। বেলায়েত সরদারের ওই রান্নার কথা কখনও ভুলবো না।

ভোর হতে হতে ভাটার স্রোত নরম হয়ে আসলো। খাওয়া সেরে ট্রলার ছাড়বো আমরা। খালপাটার জেলেরা বলেছিলো এদিকেই থাকবে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। সকাল সকাল তাদের সাথে নেসে পড়বো সরু কোনো খালে। গহীন বনের সরু খালে শেষ ভাটার কাদায় নামবো। নতুন এক অভিজ্ঞতা হবে আজ।

(সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top