রূপান্তরের গল্প ৩০৭ | Rupantorer Golpo 307

অ্যাম্বুশ করছিলো বাঘ | রূপান্তরের গল্প ৩০৭

অ্যাম্বুশ করছিলো বাঘ | রূপান্তরের গল্প ৩০৭ | Rupantorer Golpo 307 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩০৭ : আমাদের কাছাকাছি বাঘ ঘুরছে। কিন্তু জানি না। শুধু চারপাশের নিরবতা আর থমথমে পরিবেশ ছাড়া মামার কোনো আলামত নাই। মনের ভেতরে খচখচ করছে। নিচু স্বরে কথা চলছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। শুধু সরদারের চোখ আর কান খাড়া। মহা সতর্ক তিনি।

খালপাটার জেলেরা মাছ ধরছে। যেদিকে তাকাই মাছ আর মাছ। কাদায় মাছ। পানিতে মাছ। গাছের গোঁড়ায় মাছ। জঙ্গলের ভেতরেও লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে মাছ। কতো জাতের মাছ! সবগুলোর নামও জানি না। খালপাটা জেলেদের কাছে জানতে চাইলাম, বড় মাছগুলো কোথায় গেলো?

জেলে বহরের প্রধান সফিকুল ভাই বললেন, বড় মাছ একটাও বের হতে পারবে না। আরেকটু এগিয়ে গেলাম। একটি পাশ খালের দিকে হাঁটলো সবাই। কাদার ভেতরে হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে আমার। তবে দমে যাইনি। পেছনে পেছনে গেলাম।

পাশ খালটি খুবই ছোট। দেখি, তার ভেতরে একটি ভেটকী মাছ কাদার সাথে মিশে আছে। সরদার বললেন, ওই দেখেন ভাই। চোরের মতো ঘাপটি মেরে আছে। এগিয়ে গেলাম। যা দেখলাম তা অবিশ্বাস্য।

কাছাকাছি যেতেই লেজ দিয়ে কাদার ওপর ঝাপটা মারলো সে। প্রথমে ভয় পেয়েছি। কুমির না তো? শুনে জেলেরা হেসে দিলো। বললো, বড় মাছ ভাই। বলেই একটি বস্তা নিয়ে মাছটির মুখের দিকে ধরলো একজন। আরও দুইজন মিলে লেজের দিকটা ধরে ঠেলা দিলো। বস্তায় ঢুকে পড়লো মাছের মাথা। তারপর বিশাল লাফঝাঁপ চললো কিছুক্ষণ। কিন্তু দুইজন মিলে আটকে ফেললো।

বিশাল আনন্দের ব্যাপার। এতো বড় ভেটকী মাছ সেভাবে দেখিনি আগে। জেলেরা বললো, ওজন প্রায় এক মণ হবে। মাছটি নিয়ে কাঁধে করে এগুলো ওরা। রাখলো ড্রামের মধ্যে।

এরপর আরও কয়েকটি ভেটকী মাছ ধরা হলো। একটি কই ভোল ধরা পড়লো। যার ওজন আধা মণের ওপর। বড় বড় কালো দাতিনা ধরলো জেলেরা। কালো আর সাদা দাতিনা, গলদা চিংড়িগুলো ধরে রাখছে প্লাস্টিকের ক্রেট এর ভেতর। বড় মাছগুলো রাখা হচ্ছে ড্রামে।

ঘন্টা খানেক মাছ ধরে ফিরছি আমরা। মাছ ভর্তি ড্রামগুলো কাদার উপর দিয়ে ঠেলে আনছে জেলেরা। কিছু দূর আসার পর মাছের ভারে ক্লান্ত সবাই। ড্রামগুলো সেখানে রেখে খালের গোঁড়ার দিকে আসলাম। সেখানে মাছ বোঝাই হয়ে আছে। চিংড়িগুলো দ্রুত তুলে নৌকার খোলে রাখছে তারা।

কাদা ছেড়ে উঠে পড়লাম। খালের মুখে রাখা নৌকায় পা ঝুলিয়ে বসলাম। ভীষণ ক্লান্ত। কুয়াশা কাটেনি এখনও। খালে আসতেই উত্তরা বাতাসের ঝাপটা লাগলো। পানিতে নেমে অনেক ক্ষণ ছিলাম। ঠান্ডায় রীতিমতো ঠান্ডায় কাঁপছি।

বেড়ে পোকা কামড়াচ্ছে শরীরের খোলা জায়গাগুলোতে। এবার নামার সময় গায়ে কেরোসিন বা শ্যাম্পু মাখা হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম। এর মধ্যে দেখি দ্রুত নৌকা বেয়ে আসছে পাশের খালের জেলেরা। ছটফট করছে তারা, হাঁফাচ্ছে।

নৌকা বেয়ে তারা ভিড়লো আমাদের পাশে। সামনের জন নৌকা বাঁধলো। পেছনের জন ঢকঢক করে পানি খাচ্ছে। মাঝের জনের বয়স কম। সে বসে বসে কাঁপছে ঠকঠক করে। শীত আর ভয় মিলিয়ে এই অবস্থা।

কী হইছে ভাই? এমন অস্থির কেন? জেলেরা বললো, ওই খালের ভেতরে বাঘ। আমাদের তাড়া করেছে। শিড়দাঁড়া বেয়ে শিরশির করে কিছু একটা নেমে গেলো।

আমরা যে খালের ভেতর ছিলাম সেখান থেকে ওই খালের দূরত্ব বড়জোর দুইশ’ মিটার। তার মানে বাঘ মামা আমাদের কাছেই। সে টার্গেট করেছিলো ওই খালের জেলেদের। ওরা বনের মানুষ। এসবে অভ্যস্ত। তাই বাঘের পরিকল্পনা টের পেয়েছে। আমাদের টার্গেট করলে কী যে হতো!

জীবন বাঁচিয়ে কোনো রকমে ফিরেছে ওরা। আবারও জানতে চাইলাম, কেমন করে কী ঘটলো বলেন তো! নৌকায় বসে বিড়ি ধরালো তারা। তারপর একজন বলতে শুরু করলো।

খালের আগা থেকে মাছ তুলতে তুলতে আসছি। তিনজন এক সারিতে চলছিলাম। সামনে পেছনে তখন তাকানোর সময় নাই। মাছ বেশি বলে দ্রুত হাত চালাচ্ছিলাম। খালে ঢোকার সময় পরিবেশটা ভালো লাগেনি। তাই ওদের বলছি কাজ করতে। আর আমি চারপাশে নজর রাখছিলাম। এর মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে মট করে একটা আওয়াজ আসলো। তাকায়ে দেখি কিছু একটা সরে গেলো।

জানতে চাইলাম, খালের কোন পাশে ছিলেন? ওরা বললো, ডান পাশে। মানে আমাদের দিকটার জঙ্গলেই বাঘ? সামনের খালের জেলেরা তখনও খালের মুখে। মাছ তুলছে, একজন আবার মাছ আনতে খালের ভেতর গেছে। চিৎকার করে উঠলাম, একা কেন গেলো? তাড়াতাড়ি ভেতরে যান। ওকে নিয়ে আসেন!

জেলে বহরের একজন প্রবীন আছেন, বিষ্ণু কাকা। উনি বললেন, কিছু হবেনানে কাকা। এর মধ্যেই তো আমরা কাজ করি। কপালে যদি মরণ থাকে তাহলে মরবো। তা না হলে বেঁচে বাড়ি ফিরবো। সারা জীবন তো এভাবেই কাটায়ে দিলাম।

সরদার আমার মনের অবস্থা বুঝেছেন। একজনকে নিয়ে তিনি হাঁটা দিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ভেতরে থাকা ছেলেটিকে ডেকে আনলেন। দুই নৌকার সবাই এখন একসাথে। এই বহরের আরেকটি নৌকা আছে আরেকটি খালে। কালাবগীর ওই জেলে বহরের লোকজনও আশেপাশের খালেই আছে।

জেলেরা বললো, এদিকে একটা বাঘ সারা বছরই থাকে। মেয়ে বাঘ। বয়স হইছে, কানেও কম শোনে। বললাম, সে কানে কম শোনে আপনারা বুঝলেন কী করে? বললো, সাগর কূলের জেলেরা কানে কম শোনে। সাগরের ঢেউয়ের শব্দ শুনতে শুনতে ওরা বয়রা হয়ে যায়। জেলেদের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারি না।

বাঘের তাড়ার কথা এতোক্ষণে ভুলে গেছে জেলেরা। জোয়ার হয়ে গেছে। আধা ঘন্টার মধ্যে পানি উঠবে খালে। তখন আর মাছগুলো তোলা যাবে না। সারা রাতের পরিশ্রম মার যাবে। বললাম, যাই করেন জীবন বাঁচিয়ে করবেন। বাঘে খেয়ে ফেললে সব মাটি হয়ে যাবে।

প্রবীন জেলে বিষ্ণু কাকা বললেন, আপনি কাকা বসেন এখানে। নৌকাটা খালের মাঝখানে নিয়ে নোঙ্গর করেন। আমরা মাছগুলো কুড়িয়ে আনি। বললাম, আমিও যাবো। একা একা থাকতে পারবো না।

দলবল নিয়ে সবাই মিলে রওনা দিলাম। সামনের খালে ঢুকলো সবাই। মাছের ড্রাম আর ক্রেটগুলো টেনে আনা হলো। খালের মুখ থেকে জাল তুলে নৌকায় তুলে রওনা হলাম পাশের খালের দিকে।

বুক ধকধক করছে। তবুও খালের ভেতর ঢুকলাম। যাওয়ার সময় সবার হাতে গড়ানের লাঠি ধরিয়ে দিলো সরদার। চারপাশে নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হলো। সবাই চিৎকার করে কথা বলবে। হৈ হুল্লোড় শুনলে মামা কাছে আসার সাহস পাবে না।

আমরা মোট আটজন। দুই নৌকার ছয় জেলে, সরদার আর আমি। চিৎকার করে কথা বলতে বলতে কাদার ভেতর দিয়ে হাঁটা দিলাম। মাঝখানে আমি। ঠিক পেছনে বেলায়েত সরদার। আধা ঘন্টার মধ্যে কাজগুলো সারতে হবে। জোয়ারের পানি খালে ঢুকে পড়লে আর মাছগুলো ধরা যাবে না। সবাই মিলে দ্রুত হাত চালাচ্ছে। বড় মাছ, গলদা চিংড়ি আর চাকা চিংড়িগুলো ড্রামে ভরা হলো।

বাঘ মামাকে যে জায়গায় সরে যেতে দেখেছে ওরা সেখানে দাঁড়ালাম। খালের পাশে ঘন টাইগার ফার্ন এর ঝোপ। হরগজাও আছে। এপাশ ওপাশ হেঁতাল আর গড়ানের ঝোপও আছে। তার মাঝখানে কাদার ওপর বাঘের পায়ের ছাপ। এ পর্যন্ত আসার পদচিহ্ন আছে। কিন্তু এখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো চিহ্ন নাই। আরেকটু উঠে দেখলাম ১৫-২০ হাত দূরে আবার পায়ের ছাপ। তার মানে খালের পাশ থেকে এক লাফে সে এতো দূর এসেছে?

জেলেরা বললো, ওর গায়ে মেলা শক্তি। দেখেন কোনো আওয়াজ ছাড়া কতো দূরে লাফ দিছে! পায়ের ছাপ ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলাম। তাজা পায়ের ছাপটি ঘুরে আবার খালের দিকে গেছে। আবারও অনুসরণ করলাম। খালের যেখানে জেলেরা ছিলো তার পেছন দিকে গেছে সে। তারপর এক লাফে খাল পেরিয়ে গেছে। বিপরীত দিকে কাদার ওপর পেছনের পায়ের চিহ্ন রেখে গেছে। জেলেরা নিশ্চিত করলো সেটি একটি মাদী বাঘ। শিকার ধরার জন্য বাঘ অ্যাম্বুশ করে অপেক্ষা করছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। ভাগ্যবান ওই জেলেরা।

ড্রামগুলো কাদার উপর দিয়ে ঠেলে আনা হলো খালের মুখে। দ্রুত নৌকায় তুলে দ্রুত ভেসে পড়লাম। জোয়ারের পানি ততোক্ষণে বেড়েছে খানিকটা। খালের মাঝখানে নোঙ্গর করলাম। এই শীতের মধ্যেও দরদর করে ঘামছি আমি।

(সুন্দরবন | নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top