রূপান্তরের গল্প ৩১১ | Rupantorer Golpo 311

হঠাৎ ঝড়! বাঘের গর্জন! | রূপান্তরের গল্প ৩১১

হঠাৎ ঝড়! বাঘের গর্জন! | রূপান্তরের গল্প ৩১১ | Rupantorer Golpo 311 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১১ : কুক কুক কুক কুক কুক….!! পাখি ডাকছে। কুকু পাখির এই ডাক চলে ঘড়ির কাঁটার মতো নির্দিষ্ট সময় পর পর। প্রতি দেড় ঘন্টা পর পর ডাক দেয় এই পাখি। এই মুহুর্তের ডাকটির অর্থ- ভাটা শুরু হলো। এখন চারপাশের জঙ্গল খালে উঠে পড়া পানিগুলো নামতে শুরু করবে।

এসময় পুরো জঙ্গল থমথম করে। মনে হয় যেন সবকিছু থেমে গেছে। ভাটার শুরুতে ধীর গতিতে পানি চক্কর খায়। জঙ্গল আর ছোট ছোট খাল থেকে পানি নামতে শুরু করে। তারপর ঘন্টা খানেকের মধ্যে তীব্র স্রোত ছুটে চলবে নিচের দিকে। এসময় বনের ভেতরের ভাঙ্গা গাছ-পালা, পাতা-ফল, শেকড়-বাকড় নিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে সব। সবকিছুর গন্তব্য যেন বড় নদী আর সাগর।

সূর্য হেলে গেছে পশ্চিম আকাশে। সন্ধ্যা নামতে দেরি আছে। এই সময়টা কেন জানি খুব দ্রুত কেটে যায়। আমাদের ট্রলারের সবাই ঘুমাচ্ছে। শুধু শহীদুল কাকু পেছনে বসে কিছু একটা করছেন।

বেলায়েত সরদারের ট্রলারটি এই অঞ্চলের অন্য ট্রলারের মতো না। সরদার এটি নিজের মতো করে বানিয়েছেন। বেশ মজবুত। সাগরের বড় বড় রোলিং-এর মধ্যে চলার উপযোগি করে বানানো। এতে ডুয়েস ইঞ্জিন লাগানো। গিয়ার আর প্রোপেলার চট্টগ্রাম থেকে কিনে আনা। সামনে অস্থায়ী ছই। আমরা গেলে সেটি বসানো হয়। অন্য সময় ওখানে মাছের বাক্স থাকে। দেখতে বেশ ভালো লাগলেও এই ট্রলারে হাঁটা চলা খুব সহজ না। বিশেষ করে চলমান অবস্থায় একটু বেশি সতর্ক থাকতে হয়।

সামনে থেকে পেছনে যাওয়া আসার জন্য ট্রলারের পাশ দিয়ে হাঁটতে হয়। একপাশে সাইলেন্সার পাইপ থাকায় মাঝে মাঝেই তাতে পা লেগে পুড়ে যায়। তারপরও এই ট্রলারই ভরসা। সুরক্ষার বিষয় ছাড়াও আমাদের ট্রলারটি দূর থেকে দেখে সবাই বিভ্রান্তিতে পড়ে। ফরেস্ট, ডাকাত কিংবা জেলে, হুট করে কেউ বুঝতে পানে না যে কারা আমরা। আবার দস্যুদের সাথে দেখা করতে গেলে ট্রলারের বর্ণনা দিয়ে রাখি। দূর থেকেই তারা বুঝতে পারে। এরই মধ্যে অনেক দস্যুদল চিনেও ফেলেছে এটিকে।

পাশ দিয়ে হেঁটে পেছনে গেলাম। দেখি রান্নাঘরের সামনে বসে পেঁয়াজ-মরিচ কাটছেন শহীদুল কাকু। পাশে নানা রকমের মসলা রাখা। সেগুলোও বেটে ফেলতে হবে। সন্ধ্যার পর সরদার এসব দিয়ে মাছের বার-বি-কিউ করবেন। কাকুর সাথে নিরিবিলি কথা বলা হয় না। এখন ঘন্টা খানেক সময় আছে হাতে। উনি একটি ছোট তেলের ড্রাম এগিয়ে দিলেন। বললেন বসেন, এক কাপ চা বানিয়ে দেই।

চায়ের পাতিল চুলায় উঠলো। বললাম, কেটলী ব্যবহার করলেই পারেন। কাকু বললেন, সাগরে কেটলী চলে না ভাই। যাই হোক, আমাকে আলাদা করে পেয়ে শহীদুল কাকু গল্প জুড়ে দিলেন। বললেন, এই যে আজকে এত্র অপমান করলো আপনাকে, কিছুই বললেন না ওদের! আপনি কি চুরি করতে জঙ্গলে আসছেন? ফরেস্টারদের ওপর ভীষণ রাগ তার!

আমি হাসতে হাসতে শেষ! বললাম, এত্র রাগ করলে চলবে? উনি বললেন, শহরের আরামের জীবন বাদ দিয়ে এই জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কি আপনার জন্য? এরা বুঝবে না এসব। আপনি কাকু সম্মানী মানুষ। এরা আপনাকে আরও অনেক অপমান করবে। বললাম, অপমান করলে করুক। জঙ্গল ছেড়ে উঠবো না।

চা নামিয়ে তাতে দুধ মিশিয়ে আবার চুলায় দিলেন কাকু। টগবগ করে জ্বলছে চা। তার ওপর আবার একটু কাঁচা পাতি দিলেন। গরম গরম চা ছেঁকে বড় মগে ভরলেন। মগ ভর্তি চা নিয়ে চুমুক দিতে গেছি। এসময় কোত্থেকে দমকা বাতাস এসে ট্রলার দুলিয়ে দিলো। গরম চায়ে তখন আস্তে ধীরে চুমুক দিচ্ছিলাম। ঢেউয়ের ধাক্কা সামলাতে পারলাম না। জিহ্বা পুড়ে গেলো।

শহীদুল কাকু উঠে চারপাশটা দেখে নিলেন। বললেন, বাতাস ছাড়লো হঠাৎ করে। ট্রলার খালের কিনারে নিলে ভালো হতো। বললাম, কিছুক্ষণ এভাবে থাকি। তারপর সময় হলে একবারে নোঙ্গর তুলবো। আমরা বড় নদী পাড়ি দিবো।

দুজনের গল্প বেশ জমেছে। কতো কিছু জানতে পারছি এই অঞ্চল সম্পর্কে। শহীদুল কাকুর মতো প্রান্তিক মানুষেরা উপায় না পেয়ে সুন্দরবনে আসেন। পেট চালাতে এমন বহুমুখী জীবনের ঝুঁকি মনে হয় আর কোনো জায়গায় নেওয়া লাগে না। শহীদুল কাকু হুট করে জানতে চাইলেন, আপনি কেন এই কঠিন কাজ বেছে নিলেন কাকু? বললাম, সে অনেক কথা! বলবো এক সময়।

শনশন শব্দে বাতাস হচ্ছে। বনের ভেতর থেকে বনমোরগ ডাকছে। দূর থেকে মাঝে মাঝে হরিণের ডাক ভেসে আসছে। কাছের বনে কোনো বন্যপ্রাণির সাড়া শব্দ নাই। শহীদুল কাকু বললেন, এই বাদায় বাঘের চাপ বেশি। আর এখন ওদের প্রজনন মৌসুম। ছেলে বাঘগুলো ছুটোছুটি করে, হাঁকাহাঁকি করে। দেখবেন সন্ধ্যা হলে ডাকবেনে।

বাতাসে দুলছে ট্রলার। ভাটার স্রোতের চাপ বেড়েছে। ট্রলার ঘুরে গেছে উল্টো দিকে। কখন যে নোঙ্গরটা ছুটে গেছে খেয়াল করিনি। ভেতর থেকে মামুন ধড়ফড় করে উঠে আসলো। আমরা ভেসে যাচ্ছি বড় নদীর দিকে। এখানে অসতর্ক হলে ট্রলার ভেসে যেতে পারে, কোনো চরে উঠে যেতে পারে আবার ধাক্কা লাগতে পারে কোনো গাছের সাথে।

দ্রুত ইঞ্জিন রুমে গেলো মামুন। শহীদুল কাকু গেলেন সামনে। লম্বা দড়িতে বাঁধা লোহার নোঙ্গর তুলে ফিরে আসবেন তিনি। এর মধ্যে আমি গিয়ে দাঁড়ালাম সুকানিতে। মামুন ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করলো। ওদিকে নোঙ্গর তোলা হলো। আমি গিয়ার দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নিলাম। ইঞ্জিনের শব্দে সহযাত্রীরা জেগে গেলো। বেলায়েত সরদার নিচ থেকে গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হলো? বললাম, ইঞ্জিন চালায়ে দিছি ভাই। উঠে আসেন।

ট্রলারের মুখ ঘুরিয়ে পশ্বিমের পথ ধরলাম। মানে বড় নদীর দিকে। ভাবছি এখনই বেরিয়ে যাবো বালির গাঙ থেকে। চোখে মুখে পানি দিয়ে সরদার বললেন, এই তুফানের মধ্যে বড় নদী পাড়ি দিবেন? আপনার মাথা নষ্ট হইছে ভাই? বললাম, তুফান কই? ওদিকে বড় বড় ঢেউ ভাঙ্গছে খেয়াল করিনি। দূর থেকে ভালো বুঝাও যায় না। খালের মুখে যেতেই টের পেলাম, এই রোলিং-এর মধ্যে আড়পাঙ্গাসিয়ায় নামা বোকামী হবে।

মুখ ঘুরিয়ে ফিরে আসলাম আগের জায়গায়। যে ভাবে বাতাস বাড়লো তাতে এখানে থাকাও নিরাপদ না। বাকাস আসছে পশ্চিম থেকে। তাই নদীর পানি উত্তাল!

সুকানিতে এসে দাঁড়ালেন সরদার। দক্ষ হাতে ট্রলার নিয়ে ঢোকালেন সরু এক খালে। বললেন, শক্ত পানির বাড়ি খেলে ট্রলানের তলার ফাটা জায়গা আবার ফেটে যাবে। তাই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আমরা না হয় নদী পাড়ের মানুষ। সাঁতরে কূল ধরতে পারবো। আপনারা তো দুই মিনিটও ভেসে থাকতে পারবেন না।

বললাম, ওই যে ড্রাম ধরে ভেসে থাকবো! সরদার বললেন, এখন ভাটা। এক টানে সাগরে চলে যাবেন। তারপর কামোটে নিয়ে যাবে আপনাকে। কামোট মানে হাঙ্গর। এদিকে এক সময় হাঙ্গরের আনাগোণা ছিলো। এখন কিছুটা কম। তারপরও ধারালো দাঁত দিয়ে পা কেটে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে মাঝে মাঝে।

আবার বাতাসে বাড়ি মারলো। মনে হয় ঝড় উঠছে। কিন্তু এই সরু খালে বেশিক্ষণ থাকতে পারবো না। ভাটায় পানি কমলে আটকা পড়বো আমরা। একবার আটকা পড়লে আবার প্রায় বারো ঘন্টার জন্য আটকে যাবো। সরদার বললেন, বাতাস না কমলে বড় খালে বের হওয়া যাবে না। তাকিয়ে দেখেন। সত্যি, বিশাল বিশাল ঢেউ উঠছে। পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছে বাতাস। আর পানি নামছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। স্রোত আর বাতাস বিপরীতমুখী। তাই উথাল পাথাল অবস্থা।

শহীদুল কাকু আর মামুন ট্রলারটি বেঁধে ফেললো। তারপর রান্নাঘরের সামনে বসে পড়লো সবাই। সরদার বললেন, ক্ষুধা লাগেনি ভাই? বললাম, একটু তো লাগছেই। কী খাওয়াবেন? সরদার বললেন, আজ চাল ভাজা করি? বললাম, ঝাল আর রসুন বাড়িয়ে দিবেন আজ।

বার-বি-কিউ এর পরিকল্পনা বাতিল হলো। আজ রাতে কাঁকড়া ভুনা হবে। এই পরিবেশে মাছ পুড়িয়ে খাওয়ার পরিবেশ পাবো না। ভাতের সাথে কাঁকড়া ভুনা আমার খুব ভালো লাগে না। তবে আজ মনে হয় এই দিয়েই রাতটা পার করতে হবে।

সূর্য ডুবলো। সন্ধ্যা নামলো। অন্ধকার হতে আরও মিনিট দশ লাগবে। ট্রলার কি এখানেই রাখবো? নাকী বড় খালে নিবো? সরদারের কাছে জানতে চাইলাম। কিছুক্ষণ আকাশ আর বাতাস পরখ করে বললেন, রাতটা এখানেই থাকি ভাই। কালকের জোয়ারে বের হবো।

বাতাস একটু কমলো। চারপাশে ভয়ঙ্কর নিরবতা। এর মধ্যে জঙ্গলের ভেতর থেকে বিকট শব্দে ডেকে উঠলো বাঘ। সুন্দরবনের বাঘের এই ডাক শুনলে চমকে উঠবে না এমন মানুষ কম। বলতে বলতে আবারও ডেকে উঠলো বাঘ! পর পর তিন বার ডাক। তারপর সব আগের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো।

বেলায়েত ভাই বললেন, ঝড় থাকুক আর যাই আসুক, এই খালে থাকা যাবে না ভাই।

(২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top