রূপান্তরের গল্প ৩১৪ | Rupantorer Golpo 314

জঙ্গলের কেওড়ানামা | রূপান্তরের গল্প ৩১৪

জঙ্গলের কেওড়ানামা | রূপান্তরের গল্প ৩১৪ | Rupantorer Golpo 314 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১৪ : কেওড়া নিয়ে এক সময় অনেক আগ্রহ ছিলো। শুনতাম সুন্দরবনে হয় এই গাছ। প্রথম বার সুন্দরবনে এসে কেওড়া ফল খুঁজেছি। কিন্তু তখন মৌসুম ছিলো না। তাই শুধু গাছ দেখেই ফিরেছিলাম। সে অনেক আগের কথা।

এরপর দীর্ঘ বিরতি গেছে। পেশাগত জীবনে এসে আবার সুযোগ হয়েছে সুন্দরবনে আসার। সেই সফর যখন শুরু হয় তখন বনের গাছ-গাছালীর খবর নেওয়ার কথা মাথায় ছিলো না। কারণ বনদস্যুতে ভরা সুন্দরবন তখন আমার সামনে সাক্ষাত মানুষ নির্যাতনের জলাভূমি, বনভূমি।

কিছুদিন যেতেই বনের সৌন্দর্য, প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে ভাবনা এলো। এরপর জানতে শুরু করলাম। ছোটবেলার সেই কেওড়ার সাথে পরিচয় হয় এক বনদস্যুর ডেরায় গিয়ে। পশ্চিম বাদার কেওড়া গাছগুলো ছোট আকৃতির।

হাতের কাছে পুষ্ট কেওড়া সেবারই প্রথম হাতে নেই। কামড় দিতেই টকে পুরো মুখ টক হয়ে গেলো। কেওড়া নিয়ে আমার আগ্রহের সেখানেই শেষ। অবশ্য পরে জানতে পেরেছি, এই ফলটি হরিণের প্রিয় খাবার। আরও পরে জেনেছি, পাঙ্গাস মাছেরও প্রিয় খাবার সুন্দরবনের এই ফল।

সুন্দরবনের কেওড়া পরিপক্ক হয় বর্ষার শেষ দিকে। তারপর প্রায় অঞ্চল ভেদে দুই মাস গাছে থাকে এই ফল। ভীষণ টক জাতীয় ফলটি দেখতে অনেকটা বড়ইয়ের মতো।

পাকা কেওড়া লবণ দিয়ে খেতে খারাপ লাগে না। তবে মাছ কিংবা ডালের রান্নায় কেওড়ার স্বাদ আলাদা মাত্রা যোগ করে। বন উপকূলের বাসিন্দাদের কাছে ফলটি বেশ জনপ্রিয়। টক বা খাটা রান্না করে এই টক সংরক্ষণ করা যায়। অনেকে আচারও করেন। শহরের রান্নায় কেওড়া জলের ব্যবহার ছোটবেলা থেকেই দেখছি।

সুন্দরবনের বিশাল নদী আড়পাঙ্গাসিয়ায় ভাসছে আমাদের ট্রলার। শীতকালে উত্তরের বাতাস কাঁপন ধরাচ্ছে। ভাটা শেষ হয়ে জোয়ার হচ্ছে। টলমল করছে পানি। চারপাশ অন্ধকার। ভেসে থাকতে বেশ লাগছে।

পুতনীর দ্বীপে অপ্রত্যাসিত ভাবে দেখা হলো তিন জেলের সাথে। তাদের ঝুড়িতে অনেকগুলো কেওড়া রাখা। জানতে চাইলাম, কেওড়া কি এখনও আছে? জেলেরা বললো, পাকা ধরেছে মাস খানেক আগে। বেশির ভাগ গাছের কেওড়া শেষ। কিছু গাছে এখনও আছে। পাশ থেকে বেলায়েত সর্দার বললেন দ্বীপচর, বঙ্গবন্ধুর চর আর দুবলার চরের কিছু গাছে পৌষ মাস পর্যন্ত কেওড়া থাকে।

তাহলে পাঙ্গাস ধরার সময় আছে এখনও? অনেকে ভাবতে পারেন কেওড়ার সাথে পাঙ্গাস মাছের কী সম্পর্ক? আমিও আগে বুঝতাম না। তবে এখন জানি পাকা কেওড়া পাঙ্গাস মাছের খুব প্রিয় খাবার। ফল যখন পাকে তখন সেটি খাওয়ার জন্য জঙ্গলের কিনারে চলে আসে মাছের ঝাঁক। ভরা জোয়ারে তারা আসে। আবার ভাটায় পানি যখন নেমে যায় তখন হরিণের পাল আসে গাছ তলায়।

বেলায়েত সর্দার বললেন, পশ্চিমের কয়েকটা চরে যারা চরপাটা জাল দেয় তারা টনকে টন পাঙ্গাস মাছ পায়। আটকা পড়ে লাখ লাখ মাছ। বললাম, লাখ লাখ মাছ মানে? সর্দার বললেন, কম হবে না ভাই। বিশ-ত্রিশ কেজি থেকে শুরু করে আঙ্গুলের সমান পোণাগুলোও আটকা পড়ে। জেলেরা শুধু বড় মাছগুলো নেয়। বাকীগুলো নষ্ট হয়ে যায়। কখনও জাল থেকে মাছ ছাড়ানোর সময় থাকে না। তখন জালশুদ্ধো চরের বালিতে পুঁতে ফেলে জেলেরা।

কোন কোন চরে এমন মাছ পড়ে? জানতে চাইলাম। পাশ থেকে এক জেলে বললো, পশ্চিম সুন্দরবনের এই নদীতে যতোগুলো চর আছে, সবগুলোতেই মাছ ধরা পড়ে। এছাড়া মালঞ্চ আর মামদো নদীর দুই পাশের চরেও পাঙ্গাস আসে। পশুর নদীর দুই দিকের বনের ভেতরও বড় বড় পাঙ্গাস পাওয়া যায়।

আরেক জেলে বললো, আরও পূর্বদিকে গেলে কবরখালী, ছাপড়াখালী, সেলা নদীর দুই পাশ থেকে বলেশ্বর পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় মাছের ঝাঁক আসে। সর্দার বললেন, বড় মাছগুলো বর্ষায় জঙ্গলের নদী খালে আসে। তারপর ডিম দেয়, বাচ্চা হয়। কেওড়ার মৌসুম পর্যন্ত ওরা থাকে। তারপর আবার সাগরে চলে যায়।

আমি অবশ্য এই বনের নদী-খালে সারা বছরই পাঙ্গাস মাছ দেখি। বিশেষ করে হাড়বাড়িয়া, চরাপূঁটিয়া, জোংড়া, ঝাপসী খালে দেখেছি অনেক। জালের চেয়ে বড়শিতে বেশি ধরা পড়ে। ঝাপসীর দোয়ায় বড়শি ফেললেই মাছ হয়। শেষ ভাটায় ওদের ঝাপটা ঝাপটির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়।

সর্দার বললেন, ওই যে বেহালা খাল দেখছেন? বললাম, অন্ধকারে কেমন করে দেখবো? সর্দার হেসে বললেন, ওই দিত তো আপনি আমার চেয়ে ভালো চিনেন! বললাম, খুব ভালো চিনি। কয়লা খালটা বেশি সুন্দর লাগে। সর্দার বললেন, কয়লা খালের মুখে যে চর আছে সেখানে বিশাল বড় কেওড়ার বন দেখেছেন? ফল পুষ্ট হলে ঝাঁক ধরে পাঙ্গাস মাছেরা আসে। ভাটার সময় চর ঘেরাও দিয়ে রাখে জেলেরা। জোয়ারে টেনে দিলে আর কিছু করা লাগে না। বললাম, ওই পাড়ে গেলে কি এসব দেখতে পাবো?

জেলেরা বললো, আমাদের মতো চুরি করে জাল ধরে ওরা। পরিচিত না হলে কিছুতেই সামনে আসবে না। এছাড়া বনদস্যুরা ঘোরাফেরা করে। গেলেই ঝামেলায় পড়বেন। বললাম, ওদিকে নোয়া বাহিনী আর আলিফ বাহিনী আছে। দেখা হলেও সমস্যা হবে না। সর্দারকে বললাম, কাল আমরা পশ্চিম দিকে যাবো। কয়রা আর শ্যামনগরের মহাজনদের জেলেরা মাছ ধরে ওদিকে। জেলেদের অনেকেই পরিচিত।

এখান থেকে বরাবর পশ্চিমে গেলে যে বড় খাল পড়বে তার নাম বেহালা। ওই খালের মুখ থেকে উত্তর-পশ্চিমে চলে গেছে কয়লা। সেই খাল ধরে সোজা চলে গেলে পড়বে মাটিয়ার খাল। তার পাশের খালের নাম তালতলা। আরেকটু উজানে গেলে মামদো নদীর সাথে একটি বড় চর আছে। তার নাম পাগড়াতলীর চর। মাছে মাছে ভরা ওই অঞ্চল।

মাছ বেশি থাকে বলে পাগড়াতলীর চর দখলের লড়াই চলে সারা বছর। খালপাটা, চরপাটা জালে এখানে মাছ ধরা পড়ে। এটি সব সময় পশ্চিমের বড় কোনো দস্যুদলের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বনদস্যুরা নিজেরাই সেখানে মাছ ধরায়। যে মহাজন বা কোম্পানির সাথে তাদের বুঝাপড়া ভালো, তারাই এখানে জাল ফেলে। অভয়াশ্রম হলেও বন বিভাগ এসব নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দস্যুদের প্রভাব এদিকে খুব বেশি।

নদীতে বড়শি ফেলে বসে আছি। গল্পে গল্পে আবারও মাছের টান পড়লো। সময় দিচ্ছে না একদম। একটার পর একটা পাঙ্গাস না হয় টেংড়া মাছ উঠছে। পাঙ্গাসের সাইজ কখনও দেড়-দুই কেজি, কখনও আবার দুইশ গ্রামের পোণা। এদিকের টেংড়াগুলো বেশ বড় হয়।

কাঁকড়ার জেলেরা বললো, জ্যান্ত মাছ টোপ হিসাবে দিতে পারলে এখানে ভেটকী মাছও পাবেন। এছাড়া জাবা, কইভোল, ইলশে তাইড়েল, লাক্ষা মাছও পেতে পারেন। বড় পাঙ্গাস ধরতে হলে কেওড়ার টোপ দিলে ভালো হয়।

আধার হিসাবে চিংড়ি মাছ ব্যবহার করি আমি। বড়শির জেলেরা অবশ্য আধার দেয় পারশে মাছ। যারা ভেটকী জাতীয় মাছ ধরে তারা জীবীত চিংড়ি বা পারশে মাছ আধার হিসাবে দেয়। কাউইন মাছ শিকারীরা ব্যবহার করে এক প্রজাতির কাঁকড়া।

কাঁকড়া শিকারীরা দাওনের আধার হিসাবে ব্যবহার করে কুঁচিয়া। সুন্দরবনে যে কুঁচিয়া পাওয়া যায় সেটি কাজ করে না। ময়মনসিংহ থেকে আসে মিঠা পানির কুঁচিয়ার শুঁটকি। আড়াইশ টাকা কেজিতে কিনতে হয় সেই আধার।

যারা এই খরচ করতে চায় না তারা জঙ্গলে এসে গুইসাপ মেরে আধার হিসাবে দেয়। শুনেছি কেউ কেউ হরিণ মেরে তার নাড়ী ভুড়ি দিয়ে কাঁকড়া ধরে। একথা বলতেই দেখি জেলেরা মুখ টিপে হাসছে।

কী হলো? হাসছো কেন? ওরা বললো, আপনি এতো খবর কোত্থেকে পান? বললাম, এই আকাম তো তোমরাও করো। বললো, আগে করতাম ভাই। এখন ভালো হয়ে গেছি। আমি বললাম, কতো ভালো হইছো দেখবোনে।

হঠাৎ করে জানতে চাইলাম, ডোয়ার বস্তা কই রাখছো? হঠাৎ প্রশ্নের হঠাৎ উত্তর। একজন বলে বসলো, পূব দিকের কেওড়া বনের ভিতর। মাটিতে পোঁতা আছে। বললাম, খুব ভালো। ছেলেটি মনের ভুলে বলে ফেললো, হরিণ খাবেন ভাই?

হঠাৎ করে সত্যটা বলে ফেলেছে! পাশের জন তো রেগে আগুন!। বললো, আন্দাজে কথা বলিস কেন? আমি বললাম, লুকিয়ে কী হবে? আমি তো জানি সবকিছু। জোয়ার হলে চরে নামবো। তখন ডোয়ার বস্তাটা দিয়ে দিও। পেছন থেকে সর্দার বললেন, ডোয়া তো ওদের পাতাই আছে। হরিণ আটকাইছে কী না জিজ্ঞেস করেন!

আধা ঘন্টা আগে যে ছেলেটি নেমেছিলো, ফিরলো সে। বললাম, সবকিছু সরায়ে রাখছো? বললো, জ্বি ভাই। মনে হচ্ছে ডোয়া চেক করে এসেছে সে। এমনিতেই মনে হলো। হুট করে জিজ্ঞেস করলাম, মাল বাধছে একটাও? ছেলেটি সরল মনে উত্তর দিলো, না ভাই। জোয়ারের পানি উঠলেই বাধবেনে। ওর সঙ্গী দুইজন এবার মহা বেকায়দায়। রীতিমতো অপ্রস্তুত। তার মানে শিকারও চলছে পুতনীর দ্বীপে?

কথা ঘোরানোর জন্য ঝুড়ি থেকে কেওড়াগুলো একজন ঢেলে দিলো থালার ওপর। বললো, রাতে মাছ রান্না হচ্ছে না ভাই? কয়টা কেওড়া ছেড়ে দিয়ে দেখেন কেমন স্বাদ লাগে! বললাম, সে আমরা খাবো। কিন্তু জোয়ার হলে আমাকে নিয়ে যাবেন ওই কেওড়া বনে!

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top