রূপান্তরের গল্প ৩১৯ | Rupantorer Golpo 319

শিকারীদের ট্রলার! | রূপান্তরের গল্প ৩১৯

শিকারীদের ট্রলার! | রূপান্তরের গল্প ৩১৯ | Rupantorer Golpo 319 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩১৯ : পা দুটো ভারী হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। মনে হচ্ছে পুরো শরীরের ওজন বেড়ে গেছে কয়েক গুন। আমার হাতে একটা লাঠি তুলে দিলেন সর্দার। বললাম, লাঠি দিয়ে কী হবে? উনি বললেন, যখন ঝামেলা হবে তখন বুঝবেন।

এই চরে আর ঝামেলা কী হবে? এছাড়া রাত তো প্রায় শেষ। সর্দার বললেন, হঠাৎ বন্যশুকরের পাল সামনে আসলে কাজে দিবে। সর্দার বললেন, ঝামেলা কি শুধু শুকরে করে ভাই? হরিণের ঝাঁক সামনে পড়লে বুঝবেন। ওরা ডখন দৌড় দেয় তখন সামনে কী আছে দেখে না। এছাড়া সাপ সামনে পড়লেও কাজে দিবে এই লাঠি।

এক রাতে কতো কিছু দেখলাম! গত কয়দিনে পশুর নদীর দুই পাশের সুন্দরবনে কতো কিছু দেখলাম। সর্দার বললেন, রাত তো শেষ হয়নি ভাই। আরও কতো কিছু দেখবেন!

প্রায় এক সপ্তাহ হলো সুন্দরবনে নেমেছি। একটু ঘুরেফিরে চলে যাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু ঘটনার সাথে সাথে পরিকল্পনা বদলে গেছে। মনে হয় যেন পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবনের গহীন থেকে গহীনে।

আসবো না আসবো না করে নীল কমল থেকে পুতনীর দ্বীপে আসলাম। তারপর নামবো-নামবো না করছিলাম। না নামলে এতো কিছু দেখা হতো? সর্দার বললেন, এসব দেখে কী হবে ভাই? বললাম, দেখার কোনো শেষ নাই। জানার কোনো বিকল্প নাই। সাংবাদিকতা করতে গেলে জানতে হবে, দেখতে হবে।

এই বনটাকে সবাই মিলে একটা গোপন জায়গা বানিয়ে রাখছে। ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না এমন একটা ভাব। খোঁজ খবর নিতে গেলেই বাধা দেয়। সংবাদ করতে গেলে বলে এটি সংরক্ষিত বন, প্রবেশ করা যাবে না। অথচ ভিতরের খবর ভয়াবহ। অবৈধ সব ধরণের কাজ কারবার চলছে। জঙ্গলে না আসলে, এভাবে না নামলে এসব নিজের চোখে দেখতে পারতাম?

একটু সহজ পথ ধরে এগুচ্ছি আমরা। সেজন্য ঘুরতে হবে বেশ খানিকটা। দ্বীপের পূর্ব দিকের কেওড়া বনের বাইরে দিয়ে বালির চর ধরে সোজা চলে যাবো দক্ষিণে। চর ধরে হেঁটে আবার আসবো উত্তরে, মানে আমাদের ট্রলার যেখানে আছে সেখানে। জেলেরা বললো, ওদিক দিয়ে গেলে একটা ছোট খাল পড়বে। হাঁটু পানি ডিঙ্গিয়ে ট্রলারে ফিরতে পারবো আমরা।

দক্ষিণে পৌঁছাতেই দেখি একটি বন্যশুকরের পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। একটাই পথ। তাই একটু কেওড়া বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে আবার চরে বের হলাম। জেলেরা বলে, বাঘের সাথেও বুঝাপড়া করা যায়। কিন্তু বন্য শুকরের মতিগতি বুঝা মুশকিল। হঠাৎ করে আক্রমণ করে বসে। বিশেষ করে দাঁতওয়ালা বড় সাইজের মর্দা শুকরগুলো মহা খারাপ ভাই। কথা বার্তা ছাড়াই অ্যাটাক করে বসে।

হাঁটা পথ লম্বা হলেও এই পথটি ভালো। ভেজা বালির উপর দিয়ে অনেক পথ হাঁটা যায়। কুয়াশার কারণে আকাশের তারা দেখা যাচ্ছে না। তবে আবছা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মাঝ আকাশ পেরিয়ে সেটি ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। ঘড়িতে এখন বাজে ভোর পাঁচটা। আরেকটু পরেই আকাশ পরিস্কার হবে। সূর্য না ওঠা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি। হঠাৎ করে ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো। থামলাম আমিও।

টর্চ না জ্বালালে রাতের সুন্দরবনে দেখার কিছু নাই। কানের উপর নির্ভর করে পথ চলতে হয়। সর্দার বললেন, মনে হয় সাগর থেকে জেলেরা আসছে ভাই। ভাবছি, এরা কি জেলে? নাকী বনদস্যু?

জেলেরা বলছিলো আমরা এখানে আসার আগের রাতে আরেকটি ট্রলার এসেছে এখানে। এমনও হতে পারে তারাই ওরা! সর্দার বললেন, ওরা মনে হয় শিকারী। সাবধান থাকতে হবে। সুন্দরবনের শিকারীদের বন্দুক ব্যবহারের চল আছে। অন্ধকারে একটু ভুল বুঝাবুঝি হলে ঝামেলা বাড়বে।

দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা। ওদিকের কথাবার্তাও থেমে গেলো। আমরা যেমন ওদের অনুসরণ করছি। তেমনি তারাও করছে। এই মুহুর্তে কী করা উচিৎ বুঝতে পারছি না। শিকারী হলে তাদের সাথে বুঝাপড়া আছে। কিন্তু তারা যদি সশস্ত্র হয়?

চারপাশে শুনশান নিরবতা। বাতাস মোটেই নাই। ভারী কুয়াশায় পরিবেশ একদম ঘোলাটে। ভাটার নামছে সাগরের দিকে। এখনও স্রোত সেভাবে শুরু হয়নি। ওদিকে পূর্ব দিকের আকাশ একটু একটু করে আলো ফুটছে।

কুয়াশার কারণে রোদ উঠতে একটি দেরি হবে। তবে চারপাশ পরিস্কার হতে সময় লাগবে না। আমরা দাঁড়িয়ে আছি। সাথে তিনজন কাঁকড়ার জেলে, মামুন আর বেলায়েত সরদার। দুটি বস্তা ভর্তি হরিণ ধরার ফাঁদ।

ফিসফিস করেও কথা বলছি না আমরা। ওরাও বলছে না। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না বলে ঠিক বুঝতেও পারছি না যে কারা তারা। আমার কাঁধে হাত রেখে বসতে বললেন সর্দার। বাকীদেরও ইশারায় বসার কথা বললাম। হাতে একটা দা নিয়ে হাঁটা দিলেন সর্দার। কেওড়া বনের ভিতর দিয়ে নি:শব্দে এগিয়ে গেলেন। ওরা কারা না দেখে আগানো যাবে না।

ভেজা বালির উপর বসতে বেশ লাগে। সামনে ঢেউ হাল্কা করে ধাক্বা খাচ্ছে। ভাটার স্রোত আর উত্তরা বাতাসে নদী একদম ঠান্ডা। এর মধ্যে জেলেদের একজন বিড়ি ধরিয়ে বসলো। আলোর ঝলকানি দেখে ফেললো ওদিক থেকে। তারপর ধুপধাপ করে দিলো দৌড়।

মিনিট খানেকের মধ্যে বেরিয়ে আসলেন সর্দার। তারপর বিড়ি ধরানো ছেলেটাকে একটানা গালি দিলেন। বললেন, এই সময় কেউ বিড়ি ধরায়?

ডাকাত বা বন্দুকওয়ালা শিকারী হলে ওই বিড়ির আগুন বরাবর গুলি করে ফেলতো। সাথে সাথে বিড়ি নিভিয়ে দিলো সে। আবার বকা দিলেন সর্দার। বললেন, এখন আর নিভায়ে কী হবে? দাও আমাকে একটা দাও। বলেই হা হা করে হেসে দিলেন।

সুন্দরবন শুধু না, যেখানে বন্দুকের ব্যবহার আছে সেখানেই রাতের বেলা কেউ হুট করে আলো জ্বালে না। সুন্দরবনে একদমই না। টর্চ জ্বালালেও হাত শরীর থেকে দূরে সরিয়ে জ্বালানোর নিয়। যারা সিগারেট খায় তাদের লক্ষ করে গুলি করা বেশি সহজ। আলো লক্ষ করে গুলি করলেই শত্রু ঘায়েল।

ওপাশের লোকজনের দৌড়ে পালানো দেখে আমরা হাসছি। সর্দার বলছেন, ওরা চোর ভাই। মনে হয় এই ডোয়া তারাই পেতে রাখছিলো। হরিণ আটকানোর শব্দ ওরা পাইছিলো। পরে এসে দেখে আমরা সেখানে।

দূরে সরে ওরা বুঝার চেষ্টা করছিলো। পরে আমরা যখন সনে যাই তখন গিয়ে দেখে ফাঁস-দড়ি বা হরিণ কোনোটাই নাই। এই নিয়েই তারা পাগল হয়ে গেছে। কে নিলো ডোয়া, কিছুতেই বুঝতে পারছে না!

ওরা গেলো কোন দিকে? সর্দারের কাছে জানতে চাইলাম। উনি বললেন, ওই সামনের দিকে গেছে ভাই। আমাদের ট্রলার যেখানে রাখা সেদিকেই গেছে। বললাম, তাহলে চলেন আগাই। বলেই উঠে পড়লাম। নদীর পাড় ধরে হাঁটা দিলাম। এখান থেকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই ট্রলার।

ভাটায় পানি নেমে গেছে খানিকটা। ধীরে ধীরে আলো ফুটছে। পূব আকাশে মনে হয় যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। কুয়াশার ভিতর দিয়ে সূর্যের আলো বের হওয়ার চেষ্টা করছে। এখন একটু বাতাস দিলেই হলো। সর্দার বললেন, বাতাস শুরু হইছে ভাই। একটু উল্টাপাল্টা বাতাস হচ্ছে। কুয়াশা কেটে যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে পুতনীর দ্বীপের যেখানে নেমেছিলাম সেখানে ফিরলাম। পা দুটো টনটন করে ব্যাথা করছে। আর যেন টেনে নিতে পারছি না। হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম বালির উপর।

জেলেরা বললো, ঘাড়ে করে নিয়ে যাবো ভাই? বললাম, কাকে ঘাড়ে তুলবেন? ওরা বললো, আপনাকে। বললাম, আমার ওজন জানো তোমরা? ওরা বললো, ও কুনো বিপার না ভাই। আপনি খালি সোজা হয়ে বসেন। দেখেন এক টানে ট্রলারে নিয়ে যাবোনে। বললাম, লাগবে না রে ভাই। আমি যেতে পারবো। পথে খালি সাপ না থাকলেই হয়।

এখানে বিরতি নেওয়ার উদ্দেশ্য আছে। সর্দার সেটা ঠিক বুঝেছেন। আমাদের ট্রলার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওই লোকগুলোর গতিবিধি দেখবো আগে। তারপর যাবো।

সুন্দরবনের শিকারীরা হিংস্র হয়। সাথে অস্ত্র থাকলে থাকতেও পারে। খামোখা ভয় পেয়ে একটা অঘটন ঘটাতে কতোক্ষণ? আবার এরা জলদস্যুদের লোকজন না একথাও এখন বলে দেওয়া যায় না।

আধা ঘন্টার মধ্যে আলো ফুটলো। চারপাশটা এখন বেশ পরিস্কার। উঠে দাঁড়ালাম। খালের পাশের বালির উপর দিয়ে হাঁটা দিলাম। মিনিট দুই এর মধ্যে আমাদের ট্রলারটি নজরে এলো। ছোট খালটির পানি নেমে গেছে।

বেলায়েত সর্দারের ট্রলারটি এখন দাঁড়িয়ে আছে শুকনার উপর। আরেকটু এগুতেই দেখি আমাদের ট্রলারের পিছনে আরেকটি ট্রলার দেখা যাচ্ছে। সেটিও শুকনার উপর দাঁড়ানো। সর্বনাশ! কাদের ট্রলার ওটা?

(পুতনীর দ্বীপ ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top