রূপান্তরের গল্প ৩২০ | Rupantorer Golpo 320

পালাবে কোথায় শিকারীরা? | রূপান্তরের গল্প ৩২০

পালাবে কোথায় শিকারীরা? | রূপান্তরের গল্প ৩২০ | Rupantorer Golpo 320 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩২০ : এখানে ট্রলার আসলো কী করে? তাও আবার আমাদেরটার উজানে? বুকের ভিতরটা আবারও ধক করে উঠলো। কী মুশকিল রে বাবা! রাতে আমরা ঢুকলাম। ট্রলার রাখলাম। নামলাম এখান থেকেই। অথচ সামনে আরেকটা ট্রলার রাখা! কেউ দেখলাম না?

সর্দার বললেন, কুয়াশায় দেখা যায়নি কিছু ভাই। এছাড়া তখন জোয়ার ছিলো। এই ট্রলার মনে হয় তখন আরও উপরের দিকে ছিলো। সায় দিলো মামুন।

হঠাৎ ট্রলারটি দেখে চমকে উঠলাম। দেখে মনে হচ্ছে সাধারণ একটি ট্রলার। জেলেদের মাছ ধরার ট্রলার এমন হয় না। বরং এটি লোকালয়ে চলাফেরা করা ট্রলারের মতো। মনে হচ্ছে রাসমেলায় এসেছিলো তারা।

আকারে মাঝারি। সামেয়ানা দিয়ে সামনে ছই দেওয়া। মামুন বললো, রাতে যখন নামি তখন এরা এখানে ছিলো না ভাই। আরও উপরের দিকে ছিলো। ভরা জোয়ারে সময় নামানোর চেষ্টা করছে মনে হয়। কিন্তু আমাদের ট্রলার থাকায় আর আগাতে পারেনি। জায়গাটা বেশ উঁচু। খালের এই খাঁড়ি ছাড়া ট্রলার ভাসবে না।

বললাম, সারা রাত আমরা ছিলাম না। কিন্তু শহীদুল কাকা তো এখানেই ছিলেন। কাকা বললেন, ঘুমে ছিলাম। কিছু টের পাইনি। আগের রাতেও কারও ঘুম হয়নি। কাকুর ঘুম গভীর হওয়ারই কথা।

তাহলে ওরাই তারা? সর্দারকে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, আর কারা হবে ভাই? এরা মনে হয় চোর। আমাদের মতো চুরি করে এখানে আসছে। বললাম, আমরা চুরি করে আসছি। কিন্তু চুরি তো করতে আসিনি। সর্দার বললেন, সেকথা আপনি বললে হবে? দূর থেকে এখানে আমাদের যেই দেখবে সেই মনে করবে চোর বা শিকারী। বললাম, কেউ আসুক। তখন দেখা যাবে। আপাতত ওই ট্রলারের লোক খুঁজে বের করেন।

পা ধুয়ে ট্রলারে উঠে বসবো। কিন্তু শুকনার উপর দাঁড়িয়ে ট্রলারে উঠা আমার কাজ? কতো করে বলি যে একটা সিঁড়ি বানান ভাই। আর কিছু না হলেও দড়ি দিয়ে একটা সিঁড়ির মতো তো করতে পারেন! সর্দার বললেন, ওহ ভাই! প্রতিবারই মনে করি, পরে আবার ভুলে যাই। বললাম, আপনারা তো লাফ দিয়ে উঠে পড়েন। আমি তো আর পারি না।

মামুন আর বেলায়েত সর্দার হাতে হাত বেঁধে দাঁড়ালো। সেখানে পা রেখে ট্রলারে উঠে বসলাম। সর্দার বললেন, এতো বড় অপমান করতে পারলেন ভাই? বলেই মামুনকে বললেন, ওই দড়ি নিয়ে আয়। ইঞ্জিন রুমে দেখ মোটা দড়ি আছে। ভাইয়ের জন্য আজকেই ঝুলন্ত সিঁড়ি বানায়ে ফেলবো। আমি হাসছি। ভাবছি কী মানুষ এরা! আমাকে বিনা স্বার্থে সময় দেয় মানুষগুলো।

বেলায়েত সরদারের মতো বিশ্বস্ত সহযোগী পাওয়া মুশকিল। শুধু মুশকিল না, অসম্ভব। অথচ কেমন করে মিলে গেলো সবকিছু। বনদস্যুদের নিয়ে আমার যে কাজ চলছে তাতে একটু এদিক সেদিক হলে সবকিছু ভেস্তে যেতে পারে।

গত কয়েক বছর ধরে কাজ করছি এদিকে। কাজ করতে গেলে সোর্স লাগেই। কয়েক জনকে নিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের অবিশ্বস্ততার কারণে কিছু ঝামেলাও হয়েছে। কয়েকজন তো আমার নাম ব্যবহার করে রীতিমতো টাকা পয়সার মালিক বনে গেছে।

সুন্দরবনে চলাফেরা করতে একটি চলনসই ট্রলার প্রয়োজন। অনেক ভাড়া দিয়েও এদিকে সব সময় ট্রলার পাওয়া সম্ভব না। এছাড়া পথঘাট চেনা, ঝুঁকি নেওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ কোথায় পাবো আমি?

যখনই প্রয়োজন হয় সর্দারকে একটা ফোন দেই। ‌আর কিছু করতে হয় না। ট্রলার প্রস্তুত করে নেমে পড়েন তিনি। আবার আমাদের চলাফেরার বিষয়টি গোপন রাখা, বিভিন্ন জনের সাথে চোর পুলিশ খেলা সবার কাজ না। সর্দারকে তাই ভীষণ পছন্দ আমার।

কেউ কেউ অবশ্য এর মধ্যেও উদ্দেশ্য খোঁজেন। বলার চেষ্টা করেন যে সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজটি বেশ লাভজনক। সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিমের আর্থিক সুবিধা নেয়। নিন্দুকেরা বলেন, বেলায়েত সরদার কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। কেউ কেউ বলেন, আমি সরাসরি সুবিধা নেই না। বেলায়েত সর্দারের মাধ্যমে টাকা তুলি।

বিষয়টি পরিস্কার করি। বেলায়েত সর্দার মংলার চিলা বাজারের বাসিন্দা। প্রান্তিক পরিবার। আমার সাথে যখন পরিচয় তখন তাঁর সুন্দরবনে ছোটখাটো মাছের ব্যবসা। শীত মৌসুমে শুঁটকির সাবাড়ে পাঁচ মাসের বেতনে চাকরি করতেন। মাসে বেতন ছিলো ৫-৭ হাজার টাকা। এর বাইরে তেমন কোনো রোজগার নাই।

মাঝে মাঝে সাগরে গিয়ে দেশি-বিদেশি জাহাজে বাজার সরবরাহ করেন। ওদের থেকে পরিত্যাক্ত লোহালক্কর আর জ্বালানী তেল নিয়ে এসে বিক্রি করতেন। মা, ভাই আর বোনকে নিয়ে কোনো রকমে দুই বেলার খাবার জোগাড় হতো এভাবে। সর্দারের ছোটবেলাটা ছিলো ভয়াবহ করুণ।

এই কারা তোমরা? পেছনের ট্রলারটির দিকে তাকিয়ে হাঁক দিলেন বেলায়েত সর্দার। জেলেদের একজন একটু এগিয়ে গেলো। চারপাশটা ঘুরে এসে বললো, ট্রলারে কেউ নাই। সব পালাইছে ভাই। বললাম, পালানোরই তো কথা। ওরা আসছে শিকারে। রাতের বেলা আমরা এসে পড়বো তা কে জানতো?

এবার সর্দারের পালা। সোজা গিয়ে উঠে বসলেন। প্রথমে গেলেন রান্নাঘরে। হাঁড়ি পাতিল উল্টে পাল্টে দেখলেন। তারপর বিরাট একটা হাসি দিয়ে বললেন, ও ভাই, এরা তো হাঁড়ি ভর্তি হরিণের মাংস রান্না করে রাখছে। খাবেন নাকী? বললাম, খাওয়ার রুচি হয় না ভাই। আপনি ট্রলার থেকে নেমে আসেন। আবার চুরির দায়ে পড়তে হবে।

সর্দার বললেন, চোর দিবে চুরির দায়? বলেই এদিক সেদিক খোঁজাখুঁজি করে একটি কর্কসিটের বাক্স বের করলেন। বরফের ভিতরেও মাংস রাখা। বললেন, আরও একটা বড় বড়ফের বাক্স আছে ভাই। এরা পেশাদার হরিণ শিকারী।

জিনিষগুলো যেখানে আছে সেখানেই থাকুক ভাই। আপনি হাত দিয়েন না আর। চলে আসেন। দেখবেন কিছুক্ষণ পর ওরা আসবে। নিশ্চই বনের আড়াল থেকে আমাদের গতিবিধি দেখছে তারা নিশ্চিত ওরা আশেপাশেই আছে।

বললাম, আসুক ওরা। তখন কথা বলা যাবে। আপাতত ওদের ভয় দেখায়েন না। তাহলে আর আসবেই না। সর্দার বললেন, ওরা সব শয়তান ভাই। মনে হচ্ছে রাসমেলায় গেছিলো ওরা। কয়দিন শিকার করে তারপর বাড়ি ফিরবে।

বিশাল সুন্দরবনে কতো রকমের অপরাধ হয়! আমরা থাকি শুধু বাঘ নিয়ে। অন্য অপরাধগুলো গুরুতর। বন বিভাগ ঠেকানোর চেষ্টাও করে। কিন্তু সংবাদ হিসাবে আমরা সেই খবরগুলোকে খুব একটা গুরুত্ব দেই না। তাই আইন শৃংখলা বাহিনীও এসব নিয়ে চাপ নেয় না। অনেক সময় বন বিভাগের লোকজনও এড়িয়ে যায়। সত্যিই তো।

বিস্তীর্ণ এই বনে একজন শিকারী কিংবা অপরাধীকে ধরতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়, দৌড়ঝাঁপ দিতে হয় বনরক্ষীদের। এই কাজে জীবনের ঝুঁকিও আছে।

অনেক কসরৎ করে কাউকে ধরতে পারলে মামলা দিতে হয়। আসামী ধরে নিয়ে কোর্টে চালান দিতে হয়। সেই প্রক্রিয়া বেশ লম্বা।

এজন আসামীকে ধরার পর সুন্দরবন থেকে তাদের নিয়ে যেতে হয় আদালতে। নথিপত্র তৈরি করে বনরক্ষীদের একজন বাদী হন। তথ্য-প্রমাণ গুছিয়ে দিতে হয়। তারিখে তারিখে দূর থেকে আসা যাওয়া করতে হয়। সে এক কঠিন কাজ। খরচের কথা বাদ দিলেও বিরাট ঝক্কি সেই কাজে।

তারপর একদিন আইনের ফাঁক গলিয়ে আসামীরা জামিন নেয়। উকিল ধরে, খরচ করে তারা বেরিয়ে আসে। তারপর আবারও বনে ঢোকে ওরা। আবারও নামে অবৈধ কাজে। এর মধ্যে বনরক্ষীদের দেখলে কটাক্ষ করে। কেউ কেউ উপহাসও করে। বনরক্ষীদের জন্য সেটি বিরাট মনোকষ্টের কারণ। এসব কারণে হতাশ হন অনেকে। কাজে উতসাহ পান না একটা সময়ে এসে।

অন্যদিকে সুন্দরবনে দায়িত্ব পালন করতে গেলে ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রলার চালাতে হয়। তেলের বরাদ্দও অপ্রতুল। বনরক্ষীদের বেতন-ভাতা নিয়ে অসন্তুষ্টি আছে। ভালো পোশাকও পড়তে পারে না অনেকে। ভালো কাজ করতে পারলে পুরস্কার, পদোন্নতির সুযোগ নাই। সব মিলিয়ে ভীষণ মন মরা থাকেন রক্ষীরা।

হতাশা থেকে কাজে আগ্রহ হারান করিৎকর্মা বনরক্ষীরা। কেউ কেউ বলেন, কোনো রকমে চাকরিটা করে যাই। পদোন্নতি না থাকলে কীসের আশায় কাজ করবো? এই হতাশার আরেক প্রান্তে আছি দুর্নীতি আর কাঁচা টাকার লোভ।

এদিকে কিছু মানুষ দুর্নীতি করার সুযোগ খোঁজে। ‌এইটা আছে ওইটা নাই বলতে বলতে তারা জড়িয়ে যায় দুর্নীতিতে। হাত মিলায় সুন্দরবনের মাছ-কাঁকড়া ব্যবসায়ীদের সাথে। কেউ কেউ গাছ চোর সিন্ডিকেটকে সহযোগিতা করে। কেউ অবৈধ জায়গায় অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকারের সুযোগ করে দেয়। কেউ বিষ দিয়ে যারা মাছ ধরে তাদের সুরক্ষা দেয়।

বর্ষা মৌসুমে সুন্দরবনের ভিতরে শুঁটকি করার প্রবণতা আছে। অবৈধ ভাবে চিংড়ি ধরে সেগুলো বনের ভিতরেই আগুন জ্বালিয়ে শুকায় একটি চক্র। এটি ভয়াবহ অপরাধ। অথচ সেই কাজেও কেউ কেউ সহযোগিতা করে অর্থের বিনিময়ে। বনদস্যুদের সহযোগিতাও করে কিছু বনরক্ষী। তাদের আবার সুন্দরবনে দাপট অনেক বেশি।

এতো সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বন বিভাগের কিছু মানুষকে কাজ করতে দেখি। বিশেষ করে তরুণ বনরক্ষীরা বেশ চেষ্টা করেন। কিন্তু বনদস্যুদের চাপে পড়ে সেই চেষ্টাতেও গুঁড়েবালি হয়।

এলোমেলো ভাবনা চলছে মাথায়। এসময় মামুন বললো, ওই যে ভাই, লোকজন দেখা যায়। তাকিয়ে দেখি গেওয়া বনের ভিতর থেকে একজন উঁকি দিচ্ছে। বললাম, ওরাই তাহলে এই ট্রলারের লোকজন? মামুন, ডাক দাও ওদের। দেখি কারা তারা? কী করছে এখানে!

তাহলে ধরা পড়লো ওরা! পালায়ে কোথায় যাবে? এই দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার কোনো কায়দা নাই। সর্দার বললেন, ট্রলারও তো আমাদের কাছে ধরা। পালাবে কোথায়?

(সুন্দরবন, নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top