রূপান্তরের গল্প ৩২৬ | Rupantorer Golpo 326

কাঁটা-কাদা আর বাঘের তাড়া | রূপান্তরের গল্প ৩২৬

কাঁটা-কাদা আর বাঘের তাড়া | রূপান্তরের গল্প ৩২৬ | Rupantorer Golpo 326 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩২৬ : নীল কমল নদীটি নামের মতোই সুন্দর। লম্বা ঘুম দিয়ে ফেলেছি। রাজ্যের প্রশান্তি আমার শরীরে। ঘুম ভাঙলেও চোখ খুলছি না। চারপাশের সবকিছু শুনছি। বুঝতে পারছি চারপাশটা ঝলমল করছে। অনুভূতিটা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না। চোখ বন্ধ করে অদ্ভুত এক ভালো লাগা অনুভব করছি। মুখের উপর রোদ পড়ছে। একটু নড়েচড়ে জায়গা বদল করছি, তবে বিছানা ছাড়ছি না।

বেলায়েত সর্দারের ডেক-এর উপর আমি। বিছানা বলতে খুব আরামদায়ক কিছু না। সেভাবে বলতে গেলে একটু বেকায়দার। আমার মতো মাঝারি উচ্চতার মানুষও এখানে হাত পা ছড়িয়ে শুতে পারে না। আমি শুলে পা দুটো বেরিয়ে যায়।

পিঠের নিচে তোষক আছে। তবে তারও নিচের কাঠের জোড়াগুলো একটু বেকায়দার। জোড়ার জায়গাগুলো উঁচু নিচু, পিঠে ব্যাথা লাগে। তবে তাতে অভ্যস্ত আমি। ট্রলারের সামনে যে সাময়িক ছই করা, তার ভিতরের বিছানাটি বেশ আরামদায়ক। তবে খুব বর্ষা না হলে সেখানে থাকি না। এই অঞ্চলের জেলেরাও জানে ডেকের উপরেই শুই আমি।

দুপুর হয় হয়। ভরা জোয়ার। বাতাস আর পানির স্রোত মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। উফে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। ওদিকে আমার জন্য চা হচ্ছে। বিস্কিট বের করলো মামুন। সুইটি বিস্কিট। গোল গোল বিস্কিট, বড় টিনের কৌটায় পাওয়া যায়। ছোটবেলায় এই বিস্কিট খেতাম। কিন্তু শহরের দোকানে আর দেখি না। ভেবেছিলাম নানা রকম বিস্কিটের ভীড়ে সুইটি হারিয়ে গেছে। অনেক বছর পর সুন্দরবনে এসে আবারও সেই টিনের কৌটার বিস্কিট দেখছি। মামুন বললো, দুবলার চরের নিউমার্কেটে পাওয়া যায়।

বিস্কিটের সাথে চা নিয়ে বন্দর অফিসের জেটিতে উঠলাম। সেখানে বেশ আড্ডা বসেছে। সর্দারের পরিচিত সবাই। পাইলট আর পানির জাহাজ নোঙ্গর করা বড় নদীতে। নীল কমল নদীর মুখে চর পড়েছে বলে সেগুলো বড় নদীতেই থাকে।

জেটিতে উঠে বনরক্ষীদের খবর জানতে চাইলাম। সর্দার বললেন, ওনি সাহেব আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। বললাম, চলেন। পাশেই তো ফরেস্ট অফিস। সর্দার বললেন, ডাঙ্গা দিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না ভাই। এদিকে মামার চাপ খুব বেশি। বললাম, একটা ডিঙ্গি নৌকা থাকলে ভালো হতো। আপনার ট্রলারে তো তেল নাই। যাবো কী করে?

মামুনকে ট্রলারে রেখে আমরা হাঁটা দিলাম। ঠিক হলো, নদীর পাশ দিয়ে মানে চর ধরে আমরা নৌবাহিনী আর বন্দরের অফিসের পিছন দিয়ে হাঁটবো। ওদিকে পুকুর আছে। সেখানে গোসল করবো। তারপর ফরেস্ট অফিস ঘুরে আবার ফিরে আসবো এখানে। মোটামুটি হাঁটতে হবে বুঝতে পারছি। তাই খাবার পানি নিয়ে রওনা হলাম।

নদীর পাড় দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দুটি ছোট খাল পার হতে হলো। কোমড় পর্যন্ত পানি পেরিয়ে গেলাম পশুর নদীর পাশে। এদিকে বালির চর। কিছুটা হাঁটলাম তারপর আবার ঢুকে পড়লাম বনে।

গড়ান, গেওয়া, সুন্দরী, হেঁতাল, গোল, হরগজা, বুনো লেবুসহ কতো শত গাছ এদিকে! একটা কেউটে সাপ পড়লো সামনে। তাকে এড়িয়ে যেতে অন্য পথ ধরলাম। তারপর হাঁটছি তো হাঁটছি। পথ হারিয়ে কোথায় চলে গেছি কেউ বলতে পারছি না। বললাম, দাঁড়ান সবাই। সর্দার বললেন, রাস্তা হারায়ে ফেলছি ভাই। এখন কী হবে? বললাম, পথ চিনে ফিরতে পারবো না আমরা? শহীদুল কাকু বললেন, আমার সাথে আসেন।

কাকুর পিছনে পিছনে হাঁটছি। এদিকে জোয়ারের পানি উঠেছিলো। কাদা কাদা হয়ে আছে। সুন্দরী গাছের শ্বামমূলগুলো খুব শক্ত। সাবধানে পা ফেলছি। তবে হেঁতালের শুকনা কাঁটা থেকে রেহাই পাচ্ছি না। হরগজা তো আছেই। নিরীহ দেখতে গাছগুলোর কাঁটায় পা দুটো নতুন করে ক্ষত হলো। কিন্তু এখন দাঁড়ানোর সময় নাই। মনের ভিতরে কেমন জানি খচখচ করছে।

সর্দার বললেন, সাপ এড়াতে যেয়ে আমরা মনে হয় বাঘের এলাকায় চলে আসছি ভাই। বললাম, এখানে মানুষের চলাফেরা আছে। ওই দেখেন পায়ের ছাপ। হরিণ অহরহ হাঁটে। ওই দেখেন টাটকা ছাপ। ঝাঁক ধরে হরিণ হাঁটছে এদিক দিয়ে। সর্দার বললেন, এখন কাউকে দেখেন? কোনো আওয়াজ পান? বললাম, জঙ্গল থমথমে। শরীরটা ভারী ভারী লাগছে।

এক জায়গায় হলাম সবাই। মরা একটা গড়ান গাছ কেটে লাটি বানানো হলো। হাতে লাঠি থাকলে মনে জোর আসে ভাই। বলেই আমার হাতে একটা গড়ানের কচা ধরিয়ে দিলেন। শহীদুল কাকু বললেন, এখন কোনো রকম অসতর্ক হওয়া যাবে না। রাস্তা আমি খুঁজে পাইছি। কিন্তু সে পর্যন্ত কেউ কাউকে ছেড়ে আগে পিছে যাবেন না। বলেই হাঁটা দিলেন তিনি। আমরা পিছু নিলাম।

কাদায় মেখে গেঝে আমার হাত-পা। বাইড়ে পোকা জমিয়ে আক্রমণ করছে ভেজা অংশে। কিন্তু এখন কিছু করার নাই। দাঁড়ানোও যাবে না। জোর ধাপ ফেলে এগুচ্ছি। পায়ের তলে শুলো পড়ছে, ভাঙ্গা কাঠ পড়ছে, কাঁটা ফুটছে, ব্যাথা লাগছে কিন্তু এসময় ওদিকে তাকানোর সময় নাই।

গভীর বন থেকে মনে হয় বের হচ্ছি। এদিকের গাছগুলো ছোট ছোট। সামনে মনে হচ্ছে ফাঁকা মাঠ। শহীদুল কাকু বললেন, ভাইপোরা এতো বড় হলো, কিন্তু জঙ্গলে পথ চিনে হাঁটতে শিখলো না! বলেই সর্দারের দিকে তাকালেন। বুঝলাম, খোঁচাখুঁচি চলছে। সাথে আমিও যোগ দিলাম। সর্দারকে বললাম, এইটুকু পথ আসতেই হারায়ে যান ভাই? সর্দার এগিয়ে আসলেন। বললেন, কাকুরা তো এই জঙ্গলে চুরি করে বেড়ায়। তারা পথ চিনবে না তো চিনবো আমরা? সবাই হেসে উঠলাম। আবার হাঁটা দিলাম।

সামনে বেশ বড় মাঠ। ফাঁকা জায়গা। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। শরীরের শক্তি শেষ। এখন হাঁটছি মনের শক্তি দিয়ে। এই জঙ্গলময় জায়গাটুকু পার হতে হবে। বাঘ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নেওয়ার নিয়ম নাই এই সুন্দরবনে।

কাদা আর কাঁটাকে পাত্তা দিচ্ছি না এখন। নজর নিচের দিকে। সঙ্গীরা ঘিরে রেখেছেন আমাকে। এক রকম ঘেরাও দিয়ে এগিয়ে নিচ্ছেন কারণ মামা সামনে আসলে উনারা সবার আগে আমাকে বাঁচাবেন। আমি বার বার অবাক হই। কারণ বিনা স্বার্থে নিজের জীবনকে বিপন্ন রেখে আমাকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করবে এমন মানুষ তাঁরা। আমি অবাক হই, কৃতজ্ঞ হই বারে বারে।

দরদর করে ঘামছি। চোখের ভিতরে ঘাম ঢুকে পড়ছে। চোখ জ্বালা করছে। কাঁটা আর গাছের গুতোয় তৈরি ক্ষতগুলো জ্বলছে। ঘাম লেগে জ্বালা বাড়ছে। কিন্তু এখন দাঁড়াবো না। ওরা দাঁড়াতে দিবে না। ভাবছি এই সফরগুলো কেন করি? এই সফর আমার সাংবাদিক জীবনে কোনো ভূমিকা রাখবে?

আমাদের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের কেউ কেউ আমাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বিভিন্ন সংস্থার কর্তারা আমার কাজের ভিতরে অন্য উদ্দেশ্য খোঁজেন। মাঝে মাঝে নেতিবাচক রিপোর্টও করেন। অথচ আমি ভেবে পাই না, বন উপকূলের এতো এতো সমস্যা, বঞ্চনার কথাগুলো লিখেন না কেন তাঁরা? কেন নীতি নির্ধারকদের জানা শোনার আড়ালে থাকে এই উপকূলের মানুষের কথা?

ছুটতে ছুটতে আকাশ পাতাল ভাবছি। নিচের দিকে চোখ। একটু পর পর ডানে বামে দড়ির মতো কিছু দেখছি। সর্দার বললেন, এখন দাঁড়ানো যাবে না ভাই, হাঁটেন। কয়েক মিনিট পর ফাঁকা মাঠে এসে পৌঁছালাম। এখানে ছনের ঝোপ আর দুর্বা ঘাস। ভাবছিলাম এখানে হেঁটে আরাম পাবো।

ঘাসের উপর পা রাখতেই টের পেলাম সুন্দরবনের এই সৌন্দর্যও মসৃণ না। কাটা ছনের গোঁড়াগুলো ধারালো ছুরির মতো। মাঠের ভিতর একটু এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সবাইকে দাঁড়াতে বললাম। পানির বোতলে চুমুক দিতে দিতে বললাম, জঙ্গলের ভিতরে জায়গায় জায়গায় দড়ি বাঁধা দেখলাম।

শহীদুল কাকু বললেন, ওগুলো হরিণ ধরার ফাঁদ। কখনও বনমোরগও পড়ে। বড় সাইজের বক অথবা মদনটাকও ওই ফাঁদে আটকায়। সর্দারকে বললাম, আবার একটু ভিতরে যাবো ভাই। ছিটকে ফাঁদগুলো দেখতে হবে। সর্দার বুঝে গেছেন আমি আবার ভিতরে ঢুকবো। হাসি দিয়ে বললেন, এই বিপদের মধ্যেও আপনার আবার জঙ্গলে ঢুকতে হবে? বললাম, বন বিভাগের স্যার আমাদের ডেকেছেন। তাদের অফিসের পিছনে কী হচ্ছে। সেটা দেখে যেতে হবে না?

চারপাশে ভালো করে দেখে নিলেন উনারা। একটু দম নিয়ে আবার ফিরলাম বনের ভিতর। কাছাকাছি জায়গায় পেতে রাখা কয়েকটা ছিটকে ফাঁদ দেখলাম। এগুলো ভিন্ন রকমের ফাঁদ। ছোট্ট এক টুকরো দড়ি আর সুন্দরবনের গাছ ব্যবহার করে বানানো হয় এই ফাঁদ। একটু অসতর্ক হলে আসার পথে আমাদের কেউ আটকা পড়তে পারতাম। মাটিতে পেতে রাখা ফাঁসে পা পড়লে একটানে উল্টো করে ঝুলে পড়তাম। কী সাংঘাতিক ব্যাপার। ভাবছি এই ফাঁদে বাঘ আটকালেও বোধ হয় ছুটতে পারবে না।

চোখের সামনে পড়া ফাঁদগুলো নষ্ট করলেন সর্দার। তারপর বেরিয়ে পড়লাম আবার। মাঠের মাঝখানে একটা ডোবা। সেখানে পা ধুয়ে আবার রওনা দিলাম।

নীল কমল বন বিভাগের অফিসটি বেশ বড় জায়গা নিয়ে করা। পুরনো কয়েকটি পরিত্যাক্ত ঘর আছে এক পাশে। আরেক পাশে থাকেন বনরক্ষীরা। এখানে সবাই আসে সামনের ঘাট দিয়ে। মানে নীল কমল নদী দিয়েই এই অফিসে আসে সবাই। আর আমরা এসেছি পিছন দিক দিয়ে। আরেক দফা উনারা বিরক্ত হলেন। এই অফিসের কর্মীরা সম্ভবত সুন্দরবনে নতুন। আমাকে কেউ চিনতে পারছেন না। আমিও চিনি না।

ওসি সাহেবের রুমে গেলাম। সালাম দিলাম। আমাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তারপর অবাক হলেন। উঠে এগিয়ে আসলেন। বললেন, মোহসীন ভাই, আপনি আসছেন? আপনি আমাকে চিনবেন না। তবে আমি ভালো করে চিনি। আপনি সুন্দরবনের ডাকাতদের সারেন্ডার করাচ্ছেন। খুব ভালো কাজ হচ্ছে ভাই। বলেই হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমাদের বিদ্ধস্ত চেহারা দেখে জানতে চাইলেন। খুলে বললাম সবকিছু।

গত কয়েকদিন এই অঞ্চলে আছি আমরা। অভয়াশ্রম দখলে রাখা মাছ ব্যবসায়ীরা আমাদের তাড়াতে চেয়েছেন। তারা বনরক্ষীদের নানা রকম ভুল তথ্য দিয়েছেন। তাদের কারও সাথে ওই মহাজনদের লেনদেনের সম্পর্কও আছে। উনারা আমাকে ভয় দেখিয়েছেন। কিন্তু তাড়াতে পারেননি। ভোরবেলা আমাদের দেখে আবারও ক্ষেপেছেন বনরক্ষীরা। উনারা ওসি সাহেবকে আমার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে রেখেছেন। কিন্তু আমার পরিচয় দেননি বা জানেন না।

বন টহল ফাঁড়ীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা স্বজ্জন মানুষ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললেন, আপনি যে আসছে তা কেউ বলেনি। বললে আমি নিজে যেতাম দেখা করতে। বললাম, আপাতত একটা কাজ করবেন ভাই? পিছনের জঙ্গলে কিছু ফাঁদ দেখলাম। হয়তো আপনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেউ এই অকাজ করছে। উনি বললেন, নতুন এসেছি ভাই। খুব তাড়াতাড়ি এসব গুছিয়ে নিবো। পুতনীর দ্বীপের কাহিনী জানালাম। উনি বললেন, ব্যবস্থা নিবেন। আমি বললাম, আপাতত কিছু করতে যাবেন না। ওরা বনদস্যুদের লোকজন।

গল্প করতে করতে লম্বা সময় পার হয়েছে। এর মধ্যে অন্য বনরক্ষীরাও এসেছেন। সবার সাথে পরিচয় হলো। উনাদের মধ্যে আমাকে তাড়াতে যাওয়া ভাইরাও আছেন। বেজার মুখে হ্যান্ডশেক করলেন। বিদায় নিয়ে হাঁটা দিলাম জেটির দিকে। ওখান থেকে একটা ডিঙ্গি নৌকা নিলাম। ফিরবো ট্রলারে। গত চার ঘন্টা ঘটনাবহুল সময় কেটেছে। নৌকার মাঝি একজন সাধারণ জেলে। নৌকা থেকে নামার সময় উনি বললেন, অফিসের পিছনে তিনটা বাঘ আছে। ওরা খুব উৎপাত করছে। মাঝে মাঝে তাড়াও দিচ্ছে।

সর্দারের দিকে তাকালাম। শহীদুল কাকু তাকালেন আমার দিকে। বললেন, জঙ্গলে সমস্যা আছে বলছিলাম না কাকু? বললাম, ভাগ্যিস খেয়াল করছিলেন। না হলে অনেক বড় বিপদ হতে পারতো!

(সুন্দরবন ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top