সুন্দরবনে শনির দশা | রূপান্তরের গল্প ৩২৮ | Rupantorer Golpo 328 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩২৮ : নতুন অস্ত্র কিনেছে দস্যুনেতা নোয়া মিয়া। শুনছি দল বড় করছে সে। বাগেরহাটের রামপাল আর মংলার পুরনো দস্যুরা যোগ দিয়েছে এই দলে। নোয়া মিয়া বেশ দুর্বল মনস্তত্বের মানুষ, অদক্ষ দস্যুনেতা।
২০১৩ সাল থেকে দফায় দফায় অন্য দস্যুদলের আক্রমণের শিকার হয়েছে সে। বন্দুক যুদ্ধে টিকতে পারেনি, কয়েক বার অস্ত্র-গুলি খুইয়েছে সে। একটা সময় সবচেয়ে বড় দস্যুদলের নেতৃত্বে ছিলো নোয়া মিয়া। বিদ্রোহ করে তাকে পরাস্ত করে তৈরি হয় মাস্টার বাহিনী। সেবার নোয়া মিয়া পালিয়ে বাঁচে। তার অস্ত্রগুলো নিয়ে আত্মসমর্পণ করে মাস্টার বাহিনী।
নোয়া মিয়া বেশ কয়েক মাস নিরুদ্দেশ ছিলো। তারপর আবার ফিরেছে। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি আবারও সুন্দরবনে নামে সে। এই দফার শুরুতে হাতে গণা কয়েকটি অস্ত্র ছিলো তার। গুলি ছিলো কম। তাই শুরুতে ডিঙ্গি নৌকায় থাকতো, রাতে রাতে চোরের মতো চলাফেরা করতো নোয়া বাহিনী। দস্যুনেতার সাথে মাঝে মাঝে কথা হয়। বলে আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু কিছুতেই দেখা দিচ্ছে না।
দুবলার চর আজ গমগম করছে। মানুষে ভরা। সাগর উত্তাল। ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। তাই সাগরের সব জেলেরা ফিরেছে দুবলায়। ট্রলার থেকে নেমে হাঁটছি। পরিচিত অনেক জেলের সাথে দেখা হলো। ওরা জানালো, এই গোনে রূপচাঁদা মাছের ঝাঁক পড়ছে। কিন্তু সাগর এতো গরম যে জাল ফেলার উপায় নাই। পরশু কয়েকটি ট্রলার ডুবেছে। জীবন বাঁচাতে জেলেরা চরে ফিরেছে। কিন্তু সাহেব মহাজনরা তাতে নাখোশ।
স্পিডবোট নিয়ে সাহেবরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জেলেদের বহরে বহরে এসে তাগাদা দিচ্ছেন। জেলেরা বললো, সাগর খুব গরম, জালের খ্যাওন দেওয়ার মতো পরিবেশ নাই। কিন্তু সাহেবরা চাপ দিচ্ছেন, জেলেদের জোর করে সাগরে নামানোর চেষ্টা করছেন। গতকাল এক সাহেবের জেলে নামতে রাজি হয়নি। তাকে মারপিট করা হয়েছে। আহত সেই জেলে চিকিৎসা নিতে খুলনা গেছে।
মানুষ ভর্তি দুবলার চরে কোনো আনন্দ দেখছি না। এখানে আসলেই যেভাবে তারা অভ্যর্থনা জানায়, খুশি হয়, তাতে আজ ভাটা পড়েছে। সাহেবদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ সবাই। কিন্তু সাহস করে মুখ খুলছে না। বিষয়টি বন বিভাগের দায়িত্ববানদের জানাতে বললাম। জেলেরা বললো, ফরেস্টাররা চলে সাহেবদের কথায়, আমাদের কথা কে শোনে?
সাহেবরা দুবলার চরে শুঁটকি করার অনুমতি নেন। সেই অনুমতি ব্যবহার করে হাজারও জেলে। ওই সাহেবের কাছে তাই দাদন নিতে বাধ্য থাকে সবাই। নাম কেটে দিলে শুঁটকির কারবারে আসা বন্ধ হয়ে যাবে। বললাম, আপনারা নিজেরা অনুমতি নিয়ে আসেন না কেন? ওরা বললো, অনুমতি বিরাট ব্যাপার, আমাদের দিবে না।
প্রবীন জেলে গফুর গাজী বললেন, সুন্দরবনের ডাকাতরা আমাদের ধরতে পারলে অপহরণ করে, মুক্তিপণ নেয়। কিন্তু সাহেবরা তো সারা বছর ধরে রাখে, মাছের লাভের বেশির ভাগ টাকাই তারা নিয়ে যায়। উনাদের কথা না শুনলে এই চর থেকে বের করে দেয়। নিজের মতো কেউ ব্যবসা করতে গেলে চারপাশ থেকে চাপ দেয়। বললাম, আপনারা একজোট হন কাকা। আমরা বাইরে থেকে বেশি কিছু করতে পারবো না। গফুর কাকা বললেন, আপনি ডাকাত তাড়ানোর কাজটা শেষ করে সাহেবদের দিকে নজর দেন।
শুঁটকি পল্লীর ভিতর দিয়ে হাঁটছি। রাত একটার মতো বাজে। কিন্তু প্রায় সবাই জেগে আছে। আকাশে মেঘ বলে শুঁটকিগুলো গোছানোর কাজ চলছে। খোলের উপর শুকাতে দেওয়া মাছগুলো ঘরে তুলছে কেউ। আড়ের সাথে ঝুলানো লইট্যা মাছগুলো আছে মহা ঝুঁকিতে। নরম মাছ। একটু পানি পড়লেই শেষ। সাবাড় মালিকদের চোখে ঘুম নাই, দুশ্চিন্তার শেষ নাই।
সামনে কাদের ভাইয়ের চায়ের দোকান। এই রাতেও সেখানে পা রাখার জায়গা নাই। দোকানদার চা বানিয়ে কুলাতে পারছে না। আরও মিনিট দশ হাঁটলে নিউমার্কেট। হাঁটা পথ ধরে সেখানে গিয়ে চা খেলাম। মার্কেটের হোটেলগুলোর খাবার ফুরিয়ে গেছে। গোনের সময় চরে মানুষ কম থাকে। হুট করে সবাই চলে এসেছে বলে হিমসিম খাচ্ছে সবাই। আমরা হাঁটছি। খুঁজছি রামপালের এক জেলেকে। তিনি দস্যুনেতা নোয়া মিয়ার ঘনিষ্ঠ।
নিউমার্কেট রেখে আরেকটু সামনে এগিয়ে দাঁড়ালাম। খবর নিয়ে সেখান থেকে সাগর পাড়ের একটি শুঁটকির ঘরে ঢুকলাম। যাঁকে খুঁজছি তিনি এক কোণায় বসে চা খাচ্ছে। চেহারা দেখে মনে হলো আমাকে দেখে খুশি হননি।
কথাবার্তা বেশি দূর এগুলো না। দস্যুনেতা নোয়া মিয়ার সাথে যোগাযোগের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করলেন। বললেন, ইদানিং তাদের মধ্যে কোনো কথা হয় না। অথচ আমি নিশ্চিত জানি যে নোয়া মিয়ার সাথে তার প্রতিদিন কথা হয়। দস্যুনেতা নোয়া আমাকে তার সাথে যোগাযোগ রাখতে বলেছে।
শুঁটকির ঘর থেকে বের হয়ে দেখি আকাশ অন্ধকার। বাতাস বেড়েছে, টিপটিপ বৃষ্টিও পড়ছে। নভেম্বর মাসে বৃষ্টি খুবই অনাকাঙ্খিত। বাড়লে বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে। জেলেরা বলে, পূবের বাতাস দিচ্ছে ভাই। বড় ঝড় হতে পারে।
কয়দিন আগেই ঝড়-বৃষ্টি হলো। আরেক দফা বৃষ্টি হলে শুঁটকির সর্বনাশ হয়ে যাবে। অন্যদিকে ভরা গোনে সাগরে জাল ফেলতে পারছে না তারা। সব মিলিয়ে বিরাট ক্ষতি। দ্রুত হেঁটে ট্রলারের কাছে ফিরলাম। ততোক্ষণে জোয়ার শেষে ভাটাও হয়ে গেছে। পানি কমার আগেই আলোর কোল খালে বের কবো আমরা। ওই খালের ভিতরে কোথাও নোঙ্গর করবো।
বেলায়েত সর্দার আমাদের বের হয়ে যেতে বললেন। বললেন, চরে কিছু কাজ আছে। আমি বললাম, বিচার-শালিষ করবেন? মানে ওই জেলে পিটানো নিয়ে মিটিং করবেন? ওসব হবে না। আপনার এখন এসবে জড়ানো যাবে না। বলেই হাত ধরে টেনে তুললাম তাঁকে। বললাম, বেলায়েত সর্দারের সামনে অনেক কাজ। সেজন্য আপনাকে টিকে থাকতে হবে। দস্যুদের নিয়ে কাজ শেষ করতে করতে আপনাকে এই চরে শুঁটকির কারবার করার অনুমতি নিতে হবে। মানে কারও দাদনে থাকবেন না, নিজের নামেই অনুমতি নিবেন। তারপর নিজেই ছোট করে ব্যবসা করবেন। সাথে আরও জেলেদের উদ্বুদ্ধ করবেন। আমি চাই সবাই যার যার মতো করে ব্যবসা করুক। সর্দার বললেন, সেই দিন কি আসবে এই চরে? বললাম, অপেক্ষা করেন।
ট্রলারের ইঞ্জিন চালু হলো। আমরা এগুচ্ছি ছোট্ট সরু খাল ধরে। বোয়ালিয়ার খাল নামে পরিচিত এটি। বের হলেও আলোর কোল। সেখান থেকে পশ্চিমে পশুর নদী, পূর্ব দিকে খেজুরতলা, জামতলা, মেহের আলীর খাল। পূর্ব দিকের ফুলঝুড়ির ভাড়ানী, রূপের গাঙ, ভেদাখালী, অফিস খাল। দুবলার চরের ফরেস্ট অফিসও ওদিকে। আমরা অতোদূর যাবো না। আলোর কোলেই থাকবো। পরের জোয়ারে লোকালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।
বৃষ্টি থেমেছে। আমাদের ট্রলার চলছে। দুই পাশে শুঁটকির ঘরগুলোতে ব্যস্ত সবাই। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঘরের সামনে তৈরি করা ছোট ছোট মন্দিরে পূজা দিচ্ছেন। মসজিদে মসজিদে দোয়া হচ্ছে বিশেষ মোনাজাত। প্রকৃতির বৈরীতা থেকে মুক্তি চায় সবাই।
হাজার হাজার মাছ ধরার ট্রলার। আলোর কোল থেকে মরণ চর, এদিকে মেহের আলীর খালসহ সবগুলো খালে নোঙ্গর করে রাখা। জেলেরা জবুথবু হয়ে বসা। আবহাওয়া একটু সদয় হলেই সাগরে ছুটবে তারা।
আমরা নোঙ্গর করলাম রূপের গাঙ-এর ভাড়ানীতে। রাতের খাবার খেয়ে দিলাম লম্বা ঘুম। এই ভাটা শেষ হয়ে যখন জোয়ার আসবে তখন ট্রলার ছাড়বো। জোয়ারের স্রোতের সাথে পশুর নদী ধরে এগুবো উত্তরে, মংলার দিকে।
ভোরবেলা আমাদের ডেকে দিলো এক দল চরপাটার জেলে। ঘুম থেকে উঠে দেখি ট্রলারের দুই পাশে অনেকগুলো নৌকা। জেলেরা বেশ উদ্বিগ্ন। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসলো তারা। কয়েক দিন আগে নীল কমলের কেওড়াশুঁটিতে ওদের সাথে দেখা হলো। জানতে চাইলাম, কী খবর আপনাদের? এদিকে কেন? ওরা বললো, গত সন্ধ্যায় তাদের কহরে বনদস্যুরা আক্রমণ করেছে। জাহাঙ্গীর বাহিনী এসে দশটি নৌকা থেকে দশ জনকে অপহরণ করেছে। ফোন নাম্বার দিয়ে গেছে। পরে যোগাযোগ করে মুক্তিপণ দিয়ে তাদের ছাড়ায়ে আনতে বলছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আরও কয়েকটি দুঃসংবাদ এলো। মান্দারবাড়ীয়ার ওদিক থেকে বেশ কয়েকজন জেলেকে তুলে নিয়ে গেছে নোয়া বাহিনী। অন্যদিকে চরাপূঁটিয়া থেকে গণ অপহরণ করেছে আরেক দস্যুদল বড় সুমন বাহিনী। এমনিতে খারাপ আবহাওয়ার কারণে মাছ ধরা বন্ধ। বৃষ্টিতে নষ্ট হচ্ছে শুঁটকি। তার উপর বনদস্যুদের এই আক্রমণ জেলেদের কোমড় ভেঙ্গে দিলো।
জেলেরা দুঃখ করছে, অনেক কথা বলছে। কিন্তু যে কথাগুলো বলছে না তা আমি বুঝতে পারছি। তাদের চোখ বলছে, বনদস্যুদের অত্যাচার কোনো দিন বন্ধ হবে না। সুন্দরবন কখনও দস্যুমুক্ত হবে না। আমার কিছু বলার নাই। সর্দারকে বললাম, ট্রলার ছাড়েন ভাই, বাড়ী যাবো।
(নভেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)