রূপান্তরের গল্প ৩২৯ | Rupantorer Golpo 329

আবারও অপহরণ, অস্থির সুন্দরবন | রূপান্তরের গল্প ৩২৯

আবারও অপহরণ, অস্থির সুন্দরবন | রূপান্তরের গল্প ৩২৯ | Rupantorer Golpo 329 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩২৯ : ঘটঘট ঘটঘট…!! একটানা চেষ্টা চলছে। কিন্তু ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। ঘটনা কী? বড় কোনো সমস্যা? ইঞ্জিন রুম থেকে মামুন বললো, কোথায় সমস্যা বুঝতে পারছি না ভাই। গলুই-এ লগি হাতে দাঁড়ানো শহীদুল কাকু। ব্যর্থ হয়ে বের হয়ে আসলো মামুন। বললো, বেলায়েত ভাইকে ডাক দেন ভাই।

ডেক-এ শুয়ে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছেন সর্দার। পিঠে হাত দিতেই লাফ দিয়ে উঠলেন। ডানে বামে তাকিয়ে বললেন, কী হইছে ভাই? বললাম, আপনি ঘুমালে ট্রলারও ঘুমায়ে যায়। ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না।

ডেক থেকে নেমে ইঞ্জিন রুমে গেলেন সর্দার। তেলের লাইনে হাত দিয়েই সমস্যা বুঝে গেলেন। বললেন, লাইনে বাতাস ঢুকছে। মামুনকে দুটো গালি দিয়ে বললেন, এইটুকু বুঝিস না তোরা? এতো দিন ট্রলার চালাস? বলতে বলতে, হ্যাঁচকা টান দিয়ে তেলের পাইপ খুললেন। তারপর ফু দিয়ে বাতাস পরিস্কার করে আবার জুড়ে দিলেন। লিভার ঘুরাতেই চালু হলো ইঞ্জিন।

সুকানিতে আমি। গিয়ার ফেলে সামনে এগুতে শুরু করলাম। কিছু দূর এগিয়ে আটকে গেলো ট্রলার। আলোর কোল খালের মুখেও চর পড়েছে। ছোট্ট একটা খাঁড়ি আছে। সেই পথ চিনি। কিন্তু তাতেও মনে হয় চর পড়ে গেছে। এদিকে নদীর গতিপথ যখন তখন বদলে যায়।

সামনে দাঁড়িয়ে লগি দিয়ে পানির গভীরতা মাপছেন শহীদুল কাকু। ইশারা দিয়ে পেছনে নিতে বললেন। ব্যাক গিয়ারে ফেললাম। কিন্তু এখন পিছনেও যেতে পারছি না। আমার অবস্থা দেখে হেসে দিলেন সর্দার। বললেন, কেবল জোয়ার শুরু হলো। কয়েক মিনিট দাঁড়ান। এমনিতেই ভাসবে ট্রলার।

ভোর হতে হতে একটার পর একটা দু:সংবাদ আসছে। গত রাতে তিনটা দস্যুদল জেলেদের অপহরণ করেছে। এসব নিয়ে পুরো সুন্দরবন গরম। সকাল হতে হতে এই খবর ছড়িয়ে যাবে লোকালয়ে। ভাবলাম তার আগে আমি একটু খবর করি।

ফোন দিলাম দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের ফোনে। বন্ধ। এরপর কল করলাম নোয়া মিয়ার ফোনে। রিং ঢুকলো। কিন্তু সেও ফোন ধরলো না। পূর্ব সুন্দরবনের দস্যুনেতা বড় সুমনের নাম্বার জোগাড় করলাম। ফোন দিলাম। তার ফোনও বন্ধ। খবর যা পাচ্ছি তা বেশ জটিল। সম্ভবত ৪০ থেকে ৫০ জন জেলে অপহরণ হয়েছে গত রাতে।

ইঞ্জিন বন্ধ করে অপেক্ষা করছি। দু্বলার চরের এদিকটাতে অনেকগুলো ট্রলার আটকে আছে। পানি একটু বাড়লে তারাও বের হবে খাল থেকে। ওরা অবশ্য সাগরে যাবে জাল তুলতে। এদিকে মামুন এসে রান্নাঘর খুললো। শহীদুল কাকু মুড়ি মাখলেন। সরিষার তেল, পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে মাখানো মুড়ি, সাথে গরম চা। সকালের নাস্তা হয়ে গেলো।

আধা ঘন্টার মধ্যে জোয়ারের পানির চাপ আসলো। ভাসলো ট্রলার। ইঞ্জিন চালু হলো। আমরা রওনা হলাম। এই খাল থেকে কোনো রকমে পশুর নদীতে বের হলাম। তারপর ধরলাম উত্তরের পথ। জোয়ারের স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে ছুটছে ট্রলার। আপাতত নদীর পূর্ব পাশ ধরে যাবো। কারণ দস্যুদল সুমন বাহিনী এদিকটাতেই থাকে। কোনো ভাবে যদি সামনে পড়ে তাহলে ভালোই হবে। জানতে পারবো অপহরণের কাহিনী।

ঘন্টা খানেক সময় আমরা ফোনের নেটওয়ার্ক পাবো। তারপর চলে যাবে। আবার নেটওয়ার্ক আসবে ভদ্রা পার হয়ে। এক ঘন্টার মধ্যে জাহাঙ্গীরসহ অন্য দস্যুদলগুলোকে ফোনে ধরার চেষ্টা করবো। সাধারণত সকাল সকাল ওরা নেটওয়ার্কে এসে ফোন চালু করে। সেই আশায় রইলাম।

দ্রুত আগাচ্ছি আমরা। এভাবে চলতে পারলে মংলা পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না। এখন বাজে সকাল ৭টা। বেলা ১টার মধ্যে আমরা লোকালয়ে পৌঁছে যাবো।

ট্রলারের সবাই গভীর ঘুমে। ডেক এর উপর বসে হাল ধরেছি আমি। মামুন রান্নাঘরে বসে ভাত রান্নার আয়োজন করছে। সকালের নাস্তায় ভাতের সাথে থাকবে ডাল আর ডিম ভাজা। বললাম, ভাত তোলার আগে এক কাপ চা দিও মামুন। আমরা রূপের গাঙ ফেলে এগিয়ে গেছি। এর পর পড়বে আগুন জ্বলার মুখ। তারপর চার গাঙ পেরিয়ে গেলেই মূল পশুরে উঠবো। ততোক্ষণে চলে যাবে ফোনের নেটওয়ার্ক।

চা হাতে নিয়ে আবার ফোন করলাম জাহাঙ্গীরের নাম্বারে। ফোন ধরলো বাছের নামে একজন। জাহাঙ্গীরের ভাগ্নে হিসাবে পরিচিত বাছের দস্যুদলটির উপনেতা। আমাকে মামা নামে ডাকে। আগেও দেখা হয়েছে তার সাথে। ফোন ধরেই সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করতেই বললো, তারা জেলে অপহরণ করেছে। কিন্তু সংখ্যাটা বলতে চাইলো না। একটু চাপ দিলাম। জানালো ২০-২২ জন জেলেকে অপহরণ করেছে তারা। এর মধ্যে দুবলার চরের জেলেও আছে কয়েক জন।।

এবার ফোন দিলাম দস্যুনেতা নোয়া মিয়াকে। ফোন ধরলো মারুফ নামের এক দস্যু। বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল। পুরনো দস্যু সে। তার সাথে প্রথম পরিচয় রাজু বাহিনীতে। পরে ইলিয়াস বাহিনীতেও পেয়েছিলাম তাকে। দস্যুদলটির ম্যানেজার বা মুহুরি মারুফ জানালো তারা ১২ জেলেকে অপহরণ করেছে। জেলেরা সবাই সাগরের। দক্ষিণ তালপট্টির ওদিক থেকে জেলেদের উঠিয়েছে তারা।

মারুফের ফোন রেখে বড় সুমনের নাম্বারে ফোন দিলাম। কিছুতেই ফোন ঢুকলো না। সম্ভবত এখনও নেটওয়ার্কে আসেনি তারা। অথবা অন্য কোনো নাম্বার দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। রাতে শুনেছি ওরা কম-বেশি ১০ থেকে ১৫ জন জেলেকে অপহরণ করেছে চরাপূঁটিয়ার ওদিক থেকে। তার মানে সব মিলিয়ে সংখ্যা অনেক। অপহৃত জেলেদের জনপ্রতি এক থেকে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে হবে।

ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা চারগাঙ পেরুলাম। নেটওয়ার্ক চলে গেলো। ডান পাশে মানে পূর্ব দিকে অনেক গুলো ছোট ছোট খাল। একের পর এক পার হলাম বগা, কাগা, ইন্দুরকানি, সিন্দুরকৌটা। আরেকটু পর ঘসিয়াঙ্গাড়ী। এটা কড় সুমন বাহিনীর মূল আস্তানা।

ট্রলার নিয়ে আর পশ্চিম পাশে গেলাম না। সোজা চললাম। আরও ঘন্টা তিন চলার পর ধানসিদ্ধের চর। সেখানে জেলেদের সাথে দেখা হলো। ওরা বললো, এদিকে রাতে বেশ ছুটোছুটি করেছে দস্যুরা। কোনো রকমে পালিয়ে বড় নদীতে এসেছে তারা। ওরা বললো, চরাপূঁটিয়ার উপরে নিচে মিলিয়ে দুটি দস্যুদল আতঙ্ক তৈরি করছে। আরেকটি দল কারা? ওরা বললো, মোশাররফ বাহিনী মনে হয়।

মনটা ভারী হয়ে আছে। ভালো লাগছে না। গত ছয় মাসে কয়েকটা বনদস্যু দল আত্মসমর্পণ করলো। কিন্তু দস্যুতা কমছে না। বরং নতুন দডস্যুরা চাঁদার হার বাড়িয়ে দিয়েছে। মুক্তিপণের পরিমানও বেড়েছে। জেলেদের জন্য এ এক বিরাট বিপদ।

দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা এই সুযোগটিই খুঁজছে। নেটওয়ার্কে আসার পর আঁচ পেলাম। অসংখ্য মানুষ ফোন দিচ্ছে। কিছু মাছ ব্যবসায়ী বলে বেড়াচ্ছেন, আর কোনো দস্যুদের আত্মসমর্পণ করতে দেওয়া হবে না। এই পদ্ধতি কোনো কাজে আসছে না। শুধু তারাই নয়, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকেও একই রকম আওয়াজ পাচ্ছি।

নেটওয়ার্কে আসতেই অফিসে ফোন করলাম। অপহরণের খবর জানালাম। নিউজটি ছাড়তে বললাম। তারপর ফোন রেখে হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। সর্দারসহ বাকীরাও ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে নিলো।

ভদ্রা পেরিয়ে হাড়বাড়িয়া পার হলাম। সেলা নদীর আগে নন্দবালা টহল ফাঁড়ীর সামনে পরিচিত জেলেদের সাথে দেখা হলো। ওরা জানালো মোশারফ বাহিনী নামের দস্যুদল গত কয়েক মাস ব্যাপক অত্যাচার করছে। এদিকেও জঙ্গল থেকে কয়েকজন কাঁকড়ার জেলেকে অপহরণ করেছে তারা। তার মানে গত রাতে চারটি দস্যুদল অপহরণ করেছে।

নিউজ দেখে বরিশাল RAB থেকে ফোন দিলেন মেজর আদনান কবীর। বললেন, আপনার টিভির নিউজ দেখে সদর দফতর গরম। আমাদের উপর ব্যাপক চাপ। অপহৃত জেলেদের উদ্ধার করতে নামতে হবে। বললাম, এই সুন্দরবনে ওদের কোথায় খুঁজবে? আদনান বললেন, খুঁজে পাবো না জানি। কিন্তু নামতে হবে। চেষ্টা করতে হবে। বললাম, তোমরা এই বৃথা চেষ্টা না করে গোঁড়ায় হাত দাও। বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকদের চিহ্নিত করো। তাদের গায়ে হাত না দিলে এসব থামবে না।

পরের ফোনটি আসলো ঢাকা থেকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এপিএস জানালেন, জাহাঙ্গীর বাহিনী আর নোয়া বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানোর অনুরোধ করেছেন মন্ত্রী। বললাম, ঢাকা ফিরে কথা বলবো।

নন্দবালার পরেরই সেলা নদীর শুরু। সেখান থেকে লোকালয়। জয়মনিরঘোলে জমাট বেঁধেছে জেলেরা। ডাকাতির গল্প মুখে মুখে। তার মানে উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। আরেকটু এগিয়ে চিলা বাজার। সর্দার নেমে গেলেন। ট্রলার নিয়ে আমরা পৌঁছালাম মংলায়। সুন্দরবন সফর শেষ হলো।

এক সোর্সকে ডাকলাম। মংলা খেয়া ঘাটে দাঁড়িয়ে কথা হলো। বললাম, নোয়া বাহিনী আর জাহাঙ্গীর বাহিনীর সাথে আমি কথা বলবো। আপনি বড় সুমন আর মোশাররফ বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করেন। আজকেই ওদের ফোন দিতে বলবেন। বলবেন, আমি দেখা করতে আসবো, ওদের আত্মসমর্পণ করাতে হবে।

অফিসের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমরা ঢাকার পথ ধরলাম। চলতি পথ কাটলো ফোনে ফোনে। দ্রুত পরবর্তী দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করাতে হবে। কাজটি সহজ হবে না।

(নভেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top