রূপান্তরের গল্প ৩৩১ | Rupantorer Golpo 331

চাঙ্গা অবৈধ অস্ত্রের বাজার | রূপান্তরের গল্প ৩৩১

চাঙ্গা অবৈধ অস্ত্রের বাজার | রূপান্তরের গল্প ৩৩১ | Rupantorer Golpo 331 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৩১ : সাগরে সমানে কোপ চলছে। জেলেরা আতঙ্কিত। সেই সেন্টমার্টিনের ওদিকেও দস্যুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শুনলাম, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর দস্যুরা বেশ তৎপর ওদিকে। মহেশখালী চ্যানেল থেকে মধ্য ও পূর্ব বঙ্গোপসাগরে তারা তান্ডব চালাচ্ছে। এদিকে সুন্দরবনের একটি দস্যুদল নাকী সাগরে নেমেছে। সব মিলিয়ে পুরো উপকূল অস্থির।

সেদিন কক্সবাজার থেকে একজন বহদ্দার ফোন দিলেন। বললেন, সাগর থেকে তার ট্রলার আর জেলেদের অপহরণ করেছে সুন্দরবনের ডাকাত। দশ লাখ টাকা চাচ্ছে। জানতে চাইলাম, কোন বাহিনী? বললেন, নাম জানেন না। একটা ফোন নাম্বার থেকে বলা হয়েছে, টাকা না দিলে ট্রলার, জেলে কোনোটাই ফেরত যাবে না। বললাম, ডাকাত দলের নাম বলেনি? বললেন, নাম জানায়নি। শুধু একটা অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়েছে। কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। থানায় অভিযোগ করলে জেলেদের মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে ওরা।

আমি নিউজ করতে পারি। এর চেয়ে বেশি কী করতে পারি? ট্রলার মালিক বললেন, আপনার সাথে তো দস্যুদের ভালো সম্পর্ক। একটি বলে দিলে কিছু কম রাখতো। এতোক্ষণে বুঝলাম কেন আমাকে ফোন করেছেন উনি। বললাম, মুক্তিপণের দর দাম করার অভ্যাস নাই ভাই। আপনি মামলা করেন। যতোদূর মনে হয় এটা জাহাঙ্গীর বাহিনীর কাজ। ওরা ছাড়া সাগরে যাওয়ার মতো সুন্দরবনে আপাতত কেউ নাই। উনি মামলা করতে রাজি না।

২০০৯ থেকে ২০১৬। একটানা কাজ করছি সুন্দরবনে। খোঁজ খবর রাখছি। দস্যুদের আত্মসমর্পণে সহযোগিতা করছি। কিন্তু চাঁদা, অপহরণ, মুক্তিপণ নিয়ে কোনো মামলা হতে দেখি না। এই সাত বছরে কয়েকটি হত্যাও ঘটেছে বনের ভিতর। কিন্তু মামলার খবর পাইনি। দস্যুদের নামে মামলাগুলো বেশির ভাগ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর করা। সেগুলো দস্যুতা, ডাকাতি, ডাকাতির প্রস্তুতি, অস্ত্র মামলা। সবকিছু কেমন জানি একটা বৃত্তের মতো করে চলছে।

কক্সবাজারের ওই বহদ্দারের ফোন রেখে খোঁজ খবর নিলাম। জাহাঙ্গীরও সাগরে যায়নি। তাহলে ট্রলারটি ধরে আনলো কে? আরও ভালো করে খোঁজ খবর নিলাম। জানলাম, আলিফ বাহিনী এই দস্যুতার ঘটনা ঘটিয়েছে। আলিফ পশ্চিম সুন্দরবনের ডাকসাইটে দস্যুনেতা। আত্মসমর্পণের কথা বলে সেও আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে সে সাগরে বেশ কয়েকটি দস্যুতা করেছে।

ফোন করতেই লম্বা হাসি দিলো আলিফ। বললো, ছোট ট্রলার নিয়ে সাগরে নেমেছে সে। তারপর কক্সবাজারের ওই ট্রলার ধরেছে। শুধু মাঝিকে রেখে বাকী জেলেদের নামিয়ে দিয়েছে তাদের ট্রলারে। ওই ট্রলার সুন্দরবনে ফিরেছে। সশস্ত্র দস্যুদের নিয়ে গভীর সাগরে গেছে। চোখের সামনে যতোগুলো মাছ ধরার ট্রলার পড়েছে সবগুলো থেকে একজন করে জেলে অপহরণ করে নিয়ে এসেছে। মোট সংখ্যা বললো আলিফ। জানতেও চাইনি।

আলিফ আমাকে আব্বাজান বলে ডাকে। দেখা হয়নি কখনও। কিন্তু কথাবার্তা হয় বেশ। পরে জেনেছি আলিফ সবাইকেই আব্বাজান, বাপজান ইত্যাদি নামে ডাকে। জঙ্গলে তার নাম- দয়াল। বুঝি না কেন এই নাম? ইদানিং কালের সবচেয়ে অত্যাচারী বনদস্যু আলিফ। শুনেছি বেশ মারপিট করে সে। তারপরও দয়াল বলে ডাকে কেন জেলেরা? কে দিলো এই নাম?

আলিফ বললো, নামটা আমার নিজের দেওয়া বাজান। হাসলাম শুধু। বললাম, এতোদিন ধরে কথা হচ্ছে তোমার সাথে। বললে সারেন্ডার করবে। কিন্তু সেই পথে হাঁটছো না। ডাকাতি করে বেড়াচ্ছো। আলিফ বললো, এবার নামার সময় অস্ত্র আর গুলি কিনতে কোটি খানেক টাকা লাগছে বাজান। টাকাটা খুলনার এক স্বর্ণকারের কাছ থেকে চড়া সূদে ধার নেওয়া। টাকাটা শোধ না করলে আমাকে ডাঙ্গায় টিকতে দিবে না ওরা।

আলিফকে বললাম, সারেন্ডার না করলে আমার সাথে যোগাযোগ করো না। শুধু শুধু গল্প করার প্রয়োজন নাই। তুমি তোমার আকাম চালিয়ে যাও। বলে ফোন রাখলাম।।

তিনদিন পর কক্সবাজারের ওই বহদ্দার ফোন দিলেন। বেশ খুশি মনে হচ্ছে। বললেন, আলিফ ডাকাত তার ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। কোনো টাকা নেয়নি। তার জেলেদের সাথেও নাকী ভালো ব্যবহার করেছে। ধন্যবাদ দিতে দিতে বললেন, কিছু মাছ পাঠাবেন আমার জন্য। বললাম, আমি কিন্তু আলিফকে কোনো অনুরোধ করিনি। ও নিজে থেকেই মুক্তিপণ নেয়নি। ব্যবসায়ী বললেন, আমি পাঁচ লাখ টাকা রেডি করছিলাম ভাই। এখন ওটা তো লাগলো না। কিছু মনে না করলে আপনাকে এক লাখ পাঠাই? বললাম, টাকাটা আমাকে না দিয়ে আপনার জেলেদের দেন। ওরা গরীব মানুষ। দশ হাজার করে টাকা হাতে পেলে ওদের বিরাট উপকার হবে।

মুক্তিপণ না নিয়ে দস্যুরা ট্রলার ছেড়ে দিয়েছে। ঘটনাটি ছড়িয়ে গেলো জেলে মহলে। তার পরের কয়েক দিন শুধু ফোন আর ফোন। সাগরের কোথাও ডাকাতি হলেই আমাকে ফোন করে বসেন বহদ্দাররা। এদিকে সুন্দরবনের ভিতরে পরের গোনেও অনেক গুলো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। শুনলাম নোয়া বাহিনীর হাতে নতুন অস্ত্র গেছে। গুলিও বেড়েছে। মান্দারবাড়িয়া থেকে রামপালের এক জেলের ট্রলার কেড়ে নিয়েছে সে। তার মানে আপাতত সারেন্ডারে আসবে না নোয়া মিয়া। আলিফের মতো সেও লোভে পড়েছে।

এদিকে দ্রুত কোনো একটি দস্যুদলকে আত্মসমর্পণ করানো প্রয়োজন। বরিশাল RAB এর নতুন অধিনায়ক এসেছেন, লে কর্নেল আনোয়ারুজ্জামান। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের সাবেক ক্যাডেট, আমার বন্ধু। নিয়মিত কথা হচ্ছে। বললেন, দস্যুতা দমনে টানা অভিযান চলছে, কিন্তু ফলাফল ভালো না। পন্ডশ্রম বলা যায়। তাই তারাও আত্মসমর্পণে জোর দিতে চায়। তাদের সদর দফতরও বেশ চাপে আছে। আত্মসমর্পণ কাজে আসছে না এমন প্রশ্নে পড়েছে তারাও।

আবার ফোন দিলাম দস্যুনেতাদের। জাহাঙ্গীর কথা বলতে চায় না। ফোন ধরলো তার ভাগ্নে বাছের। বললো, তার মামা অর্থাৎ দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর কিছুতেই সারেন্ডার করবে না। এসব নিয়ে দলের মধ্যে বেশ অশান্তি চলছে। দুইজন সদস্য এর মধ্যে অস্ত্র-গুলি নিয়ে পালিয়েছে। সারেন্ডার করা না করা নিয়ে দ্বন্দ থেকে পালিয়েছে সে। ফারুক নামের সেই দস্যু নাকী আলাদা দল বানিয়েছে। থাকে সুন্দরবনের ভদ্রা-ঝাপসী এলাকায়।

বাছের বললো, মামা বেশি পাগলামী করছে। বললাম, জাহাঙ্গীর কোনো ভাবেই সারেন্ডার করবে না? বাছের বললো, যারা সারেন্ডার করতে চায় তাদের অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে জাহাঙ্গীর। পরিবেশ খুব খারাপ। বললো, এর মধ্যে দস্যুনেতার স্ত্রী-সন্তান আসছে। মানে জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় স্ত্রী ময়না তার সন্তানসহ এখন জঙ্গলেই আছে? বাছের বললো, আসছে আরও এক সপ্তাহ আগে। বনের ভিতরে ঘর তুলে আছে তারা।

নোয়া মিয়া প্রায় সময় নেটওয়ার্কে থাকে। ফোনে প্রচুর কথা বলে। আমার ফোন ঢুকলেও ধরছে না। পরে নতুন একটা নাম্বার থেকে ফোন দিলাম। এবার ধরলো। বললাম, আমার সাথে চালাকি করছেন ভাই? এরপর বেশ বকাঝকা করলাম। বললাম, বিপদে পড়ার আগে সারেন্ডার করেন। সে বললো, বিপদে পড়ার আগেই সারেন্ডার করবো ভাই। আমাদের একটু সময় দেন। অস্ত্র কিনতে গিয়ে অনেক গুলো টাকা চলে গেছে।

শুনলাম অনেকগুলো অস্ত্র কিনলেন? একথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে। বললো, অনেকগুলো না ভাই। মোটামুটি চলার মতো একটা ব্যবস্থা করতে হয় না? বললাম, সারেন্ডার যখন করবেন তখন আর নতুন অস্ত্র কিনবেন কেন? সে বললো, জাহাঙ্গীরের একটা ব্যবস্থা না করে উঠি কী করে ভাই? নাটা জাহাঙ্গীর আমাকে হুমকি দেয়। আমার এলাকায় এসে জেলেদের উপর অত্যাচার করে। ইজ্জত থাকে? বললাম, যা পারেন করেন। তবে এভাবে চললে বাঁচতে পারবেন না।

গোপন কিছু খবর পাচ্ছি। খুলনার অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসায়ীরা আবার নড়েচড়ে বসেছে। সুন্দরবনে অনেকগুলো দস্যুদল তাদের শক্তি বাড়াচ্ছে। তাদের ব্যবসা তাই রমরমা। একনলা বন্দুকের রেট এখন দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। দোনলা বন্দুক তিন লাখ, এইট শ্যুটার অটোমেটিক বন্দুক আট থেকে বারো লাখ টাকা। গুলি বিক্রি হচ্ছে প্রতি পিস ১২শ’ থেকে ১৪শ’ টাকা।

এমনিতে অবৈধ মার্কেটে এসব অস্ত্র-গুলির খুব বেশি চাহিদা নাই। এর বাজার সুন্দরবনের দস্যুরা। জঙ্গলে যতো বাহিনী বাড়বে, তাদের মধ্যে যতো সংঘর্ষ হবে ততোই সেই অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লাভ। এই জগতের গডফাদারা শহরের বাসিন্দা, ভদ্রলোক হিসাবে পরিচিত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কেন জানি তাদের গায়ে হাত দেয় না। যাক, এতো কিছু সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আমার নাই, দায়িত্বও না।

ইদানিং নিয়মিত অফিস করছি। দৈনন্দিন কাজগুলো শুরু করেছি। তার মাঝে মাঝে অফিসে বসে সুন্দরবনের খোঁজ খবর রাখছি। সবশেষ পূর্ব সুন্দরবনের দস্যুদল বড় সুমন বাহিনীর সাথে নতুন করে যোগাযোগ হলো। ওরা দেখা করতে চায়। দস্যুনেতা জামাল শরীফের বাড়ি বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ। তার পরিবার থেকেও যোগাযোগ করছে। দস্যুনেতার স্ত্রী বললেন, আমার স্বামীটাকে বাঁচান ভাই। ওই দলের মধ্যে শত্রুতা শুরু হইছে। যেকোনো সময় মেরে ফেলতে পারে।

বেশ মজা পাচ্ছি। তার মানে বড় সুমন বাহিনীর আত্মসমর্পণের সময় এগিয়ে এসেছে। কথা হলো দস্যুদের সাথে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেখা হতে পারে। এখন মনে হচ্ছে সুন্দরবনে আবার নামতে হবে। বেলায়েত সর্দারকে ফোন দিলাম। বললাম, ট্রলার নিয়ে তৈরি থাকেন।

(ডিসেম্বর ২০১৬)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top