ডাকছে আবার সুন্দরবন | রূপান্তরের গল্প ৩৩২ | Rupantorer Golpo 332 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩২ : নূর হাবিব তার দলবল নিয়ে ডাকাতি করতো পূর্ব সুন্দরবনে। জেলেরা ডাকতো নূরাবি। পরিচিতি ছিলো সৌখিন দস্যুনেতা হিসাবে। সাদা লুঙ্গি, জামা পড়তো সে। প্রচুর পান খেতো। সদস্যদের নিয়ে তাশ খেলা ছিলো তার নেশা। তার ডেরায় চলতো জুয়া খেলা। শুনেছি, এই তাশ খেলার সময় সে পাশ দিয়ে যাওয়া জেলেদের ডাকতোও না।
নূর হাবিবের শীষ্য ছিলো রাজু ও জুলফিকার। পরে তাদের আলাদা করে দেয় সেই দস্যুনেতা। অস্ত্র-গুলি ভাগ করে দুইজন দল গড়ে তোলে। রাজু দখল করে পশুর নদীর পশ্চিম পাশ। জুলফিকার তার দলবল নিয়ে পূর্ব সুন্দরবনের ত্রাশে পরিণত হয়। রাজুর দস্যু নাম ছিলো ছোট সাহেব। পরবর্তীতে এই দস্যুনেতা আত্মগোপনে চলে যায়। পুর্ব সুন্দরবনের ডাকসাইটে দস্যুনেতা জুলফিকারের মৃত্যু হয় RAB এর বন্দুকযুদ্ধে।
এরপর ওই দলের প্রধান হয় জুলফির ছোট ভাই মর্তুজা। কয়েক মাসের মধ্যে দল গুছিয়ে নেয় সে। কিন্তু তার পরিণতিও হয় বড় ভাই জুলফিকারের মতো। বন্দুকযুদ্ধে মর্তুজার মৃত্যুর পর ভেঙ্গে যায় দল। শীষ্য নামে একজন নতুন দল গড়ে তোলে। ফেরাউন বিল্লাল নামে আরেকজনকে নিয়ে সে পূর্ব সুন্দরবনকে আবার সন্ত্রস্ত করে ফেলে। কিছুদিন পর এই দুইজনও মারা যায় RAB এর গুলিতে। জুলফিকারের অস্ত্র-গুলি নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে দস্যুরা। তার একটি অংশ ছিলো শান্ত বাহিনী। ওরা আমার মধ্যস্ততায় আত্মসমর্পণ করেছে।
জুলফিকারের বাকী অস্ত্রগুলো নিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিলো বড় সুমন ওরফে জামাল শরীফ। বড় ভাই রিপন শরীফকে নিয়ে সে গড়ে তোলে নতুন দস্যু বাহিনী। ২০১৫ সালে এসে পূর্ব সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যুদলে পরিণত হয় এই দলটি। ইদানিং তার সাথে কথা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন সকাল-বিকাল ফোন দেয় তারা।
মজার ব্যাপার হলো এই দলের কোনো সদস্য আমার পরিচিত না। মানে আগে কখনও তাদের সাথে দেখা হয়নি। তারা আমাকে যেতে বলছে। একটু অস্বস্তি হচ্ছে। পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছি না। শুনেছি এই দলের ভিতরে নেতৃত্ব নিয়ে বিভেদ আছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এছাড়া আত্মসমর্পণ নিয়েও মতভেদ আছে। প্রায়ই তাদের মধ্যে গন্ডগোল হয়। গোলাগুলি হয়নি, তবে হতে পারে যেকোনো দিন।
দস্যুনেতা জামাল শরীফকে বার বার আত্মসমর্পণে আগ্রহের কারণ জিজ্ঞেস করি। সে বলে আর ভালো লাগে না। বাড়ি ফিরতে চায় তারা। কিন্তু মামলার কারণে বাড়ি ফিরতে পারছে না। অনেকগুলো মামলা নিয়ে তারা ফেরারি। তার সাথে ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের ভয়ে ফিরে আসতে পারছে না। কয়েকটি দস্যুদলের আত্মসমর্পণ দেখার পর তাদের মনে সাহস এসেছে।
মোড়েলগঞ্জের আরেক দস্যুদল শান্ত বাহিনীর সদস্যরা জামিনে বের হয়েছে। তাদের বাড়ি ফিরতে দেখে অবাক হয়েছে প্রতিবেশিরা। তারপর পেছনের কাহিনী শুনে দস্যুনেতা বড় সুমন অর্থাৎ জামাল শরীফের স্ত্রী এগিয়ে এসেছেন। পরিবারের সাথে কথা হচ্ছে বলে একটু সাহস পাচ্ছি। সেই সাথে আমার সোর্স আলমগীরকেও নিয়মিত খোঁজ রাখতে বলেছি।
আলমগীরের সাথে এই দস্যুদলের বিশেষ সম্পর্ক আছে। বড় সুমনের এলাকায় মাছ ধরে তার জেলেরা। মানে সুন্দরবনে আলমগীরের মাছের ব্যবসা আছে। দস্যুদের সাথে ভালো সম্পর্ক থেকে পশুর নদীর পূর্ব দিকে জমিয়ে ব্যবসা করে সে। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথেও সোর্স হিসাবে কাজ করে আলমগীর। আমারও বিশ্বস্ত সে। এর আগে শান্ত বাহিনীর আত্মসমর্পণে সহযোগিতা করেছে এই সোর্স।
কয়েকদিন পূর্ব বাদার এই দস্যুদলকে সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে পশ্চিম সুন্দরবনে ঘটে গেছে অনেকগুলো বড় বড় ঘটনা। নাটা জাহাঙ্গীরের আস্তানায় হামলা করেছে নোয়া বাহিনী। বিশাল ঘটনা। পুরো সুন্দরবন গরম হয়ে গেছে।
শিবসা নদীর বাওনে আদাচাই খাল। একটি ফরেস্ট আফিস আছে। সেখানে দস্যুদল নিয়মিত আসা যাওয়া করে। বন বিভাগের অফিসটি এমন জায়গায় যে দস্যুদের সাথে সমঝোতা করে থাকা ছাড়া উপায় নাই। অতীতের বড় দস্যুদলগুলো আদাচাই অফিসে আসতো, থাকতো। একই ভাবে নাটা জাহাঙ্গীরও এই অঞ্চলে আসে যায়। কিছুদিন আগে তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে এসেছে বনে। সাময়িক আস্তানা বানিয়ে ওই অফিসের কাছাকাছি ছিলো তারা।
এদিকে নোয়া মিয়ার এখন শক্তি বেড়েছে। অস্ত্র-গুলি এসেছে নতুন করে। একটি ট্রলার কিনেছে। সেই সাথে বোধ হয় বুদ্ধিও খুলেছে। জঙ্গলে জাহাঙ্গীরের পরিবার আসার খবর পেয়ে হামলার পরিকল্পনা করে। এবিষয়ে জেলেদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আসল খবরটি সে পায় আদাচাই ফরেস্ট অফিসে কর্মরত একজনের কাছে। ফোনে সেই বনরক্ষী জাহাঙ্গীরের অপস্থানের জায়গা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়।
এদিকে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে জাহাঙ্গীর বেশ আয়েশ করে দিন কাটাচ্ছে। শীত বেড়েছে, কুয়াশাও পড়ছে রাতে। তাই পরিবারের সদস্যদের হুট করে বাড়ি পাঠাতে পারছে না। এনিয়ে দলের মধ্যে অসন্তোষ ছিলো। কিন্তু কেউ প্রকাশ করেনি। শুধু তার ভাগ্নে বাছের বলেছিলো, এভাবে বৌ-বাচ্চাদের কাছে রাখলে বিপদ হতে পারে। পাত্তা দেয়নি জাহাঙ্গীর। বলেছে, আমার কাছে যে অস্ত্র-গুলি আছে তা জঙ্গলের সবাই জানে। কেউ সাহস করবে না। খুঁজেও পাবে না আমাদের।
জাহাঙ্গীরের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়েছে নোয়া বাহিনী। শুনলাম, আগের রাতে আক্রমণ করেছে তারা। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে জীবন নিয়ে পালিয়েছে জাহাঙ্গীর। সদস্যরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। খবর পেয়ে সারাদিনে বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম ওদিকে। দুই দলের কাউকে ফোনে পেলাম না। অন্য দিক দিয়ে কোনো খবর আসছে না। পুরো সুন্দরবনে ঘুরে বেড়াচ্ছে নানা রকমের খবর। কেউ বলছে, দুই দলের মধ্যে গোলাগুলিতে জাহাঙ্গীর মারা গেছে। আবার শুনি মারা গেছে নোয়া মিয়া। আসলে কি ঘটেছে তা জানতে এক দুই দিন অপেক্ষা করতে হবে।
গভীর রাতে ফোন পেলাম। ওপাশ থেকে নোয়া মিয়া বললো, জাহাঙ্গীরের উপর অ্যাটাক করছি ভাই। সাথে বৌ-বাচ্চা ছিলো বলে মারিনি। গুলিতে পড়ে ওরা পালায়ে গেছে। ওদের ট্রলার, দুইটা বন্দুক আর কিছু গুলি নিয়ে আসছি। ট্রলার ভর্তি বাজার ছিলো। আমাদের কয়দিন ভালোই চলবে ভাই।
যাক, আমার শংকা কেটেছে। মানে দুই দস্যু নেতাই বেঁচে আছে। নোয়া মিয়াকে বললাম, সতর্ক থাকেন। জাহাঙ্গীর কিন্তু প্রতিশোধ নিবে। নোয়া বললো, একটা ভালো মেশিন আনছি ভাই। তার নাম ৩১০। ভারতের তৈরি বেশ ভালো বন্দুক। থ্রি নট থ্রির চেয়ে একটু বড় গুলি। এখন কাউকে ভয় পাই না। নোয়া মিয়া বেশ ফুরফুরে। মনে মনে বললাম, আপনার খবর আছে, অপেক্ষা করেন।
এদিকে বড় সুমন বাহিনীর সাথে দেখা করার দিন ঠিক হলো। ২৮ ডিসম্বের ২০১৬ দেখা হবে। চুড়ান্ত সবকিছু। আমরা ঢাকা থেকে রওনা দিবো দুই দিন আগে। ওদের সাথে থাকবো দুই বা তিনদিন। ফিরে এসে RAB-এর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলবো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথেও বসবো। তবে এই সফর পুরোপুরি গোপন রাখবো। আপাতত দস্যুনেতা জামাল শরীফ, আমি আর আমার সোর্স ছাড়া কেউ জানবে না। ঢাকা ছাড়ার আগের দিন জানাবো বেলায়েত সর্দারকে।
(সুন্দরবন, ডিসেম্বর ২০১৬)