বুকটা দুরু দুরু করছে | রূপান্তরের গল্প ৩৩৬ | Rupantorer Golpo 336 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩৬ : ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে তা বুঝতে দেওয়া যাবে না। এই মুহুর্তে একটা ভুল সবকিছু উল্টে পাল্টে দিতে পারে। সেজন চারপাশে তীক্ষ্ণ নজর রাখছি। ভাবছি, আমাকে তো কখনও ভয় গ্রাস করেনি। আজ এমন মনে হচ্ছে কেন? কতো বিপদ আপদ মাথায় নিয়ে হেঁটেছি কিন্তু মনের ভিতরে এমন টান কখনও দেয়নি!
নিজেকে সংযত করলাম। এখন পরিস্থিতি অনুযায়ী চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই। এখন শুধু আমি ঠিক থাকলে চলবে না, বাকীদেরও বুঝেশুনে চলতে হবে। সহকর্মী-সহযাত্রীদের সাথে চোখের ইশারায় কথা বার্তা চলছে। আমি বলতে চাইছি, সবাই সাবধান! পরিস্থিতি অন্য রকম। ওরাও চোখে চোখে উত্তর দিচ্ছে। বলছে, আমরা সতর্ক আছি, আপনি নিশ্চিন্তে থাকেন। চোখে চোখে ভরসা পেলাম। এবিষয়ে সহকর্মী বায়েজিদ ইসলাম পলিনের উপর আমার আস্থা বেশি। সেও আমার ভাষা বুঝে।
আমরা সুন্দরবনের দস্যুদল বড় সুমন বাহিনীর আস্তানায়। আস্তানা বলতে ছোট্ট খালে একটি ভাসমান ট্রলার। তার পিছনে কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকা আছে। সেগুলো কাদের এখনও জানতে পারিনি। জানতাম এই দস্যুদল নৌকা নিয়ে চলাফেরা করে। কিন্তু এসে দেখি ট্রলার! সবকিছু কেমন জানি গোলমেলে।
আমার সোর্স আলমগীর পাশে দাঁড়ানো। তার উপর ভরসা আছে। কিন্তু এখন কেমন জানি তাকেও বোকা বোকা লাগছে। যাই হোক আলমগীরকে নিয়ে দস্যুদের সাথে পরিচয় পর্ব সেরে নিলাম। আলমগীরের সাথে তাদের সম্পর্ক বেশ পুরনো, মজবুত। এ দফায় তাকে কাজে লাগাচ্ছি। প্রাথমিক সংকট প্রশমনে এখন বেশ কিছু কাজ করতে হবে।
জুয়েল ছাড়া অন্য দস্যুরা আমাদের ট্রলারে। ওদিকে ভোরের আবছা আলো কেটে গেছে। এখন পূর্ব আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। সকাল সাতটা বাজে। অথচ চারপাশ দেখলে মনে হবে দুপুর ঘনিয়ে এসেছে। আকাশ বেশ পরিস্কার। অথচ রাতেও মেঘ ছিলো। ছিঁটাফোঁটা বৃষ্টিও পড়েছে কোথাও কোথাও।
পরিস্থিতি বদলাতে হবে। হুট করে সর্দারকে বললাম, চা জ্বালান ভাই। মেহমানদের নাস্তা দেন। সর্দারের নির্দেশে মামুন গিয়ে বসলো রান্নাঘরে। এদিকে দস্যুনেতা হায় হায় করে উঠলো। বললো, মোগো বাড়ি আইসে চা নাস্তা হবে আপনার ট্রলারে? এইটা কোনো কথা? বললাম, এটা কোনো ব্যাপার না ভাই। প্রথম চা আমাদের এখানে হোক, পরেন নাস্তা আপনি করায়েন।
বলতে বলতে বেলায়েত সর্দার বিস্কিটের প্যাকেট বের করলেন। হাতে হাতে ধরিয়ে দিলেন। চকচকে বিদেশি বিস্কিট। সাথে কড়া লিকারের চা। সকাল সকাল সুন্দরবনে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না।
বন্দুকের বাঁটে রাখা হাতগুলো একটু শিথিল হলো। হাতের পেশিগুলো একটু নরম হলো। হঠাৎ করে দস্যুনেতা আমার সামনে বন্দুকটি রাখলেন। ট্রলারের ছাদে আমরা। একটি টুলের উপর বন্দুক রেখে বললেন, এসব নিয়ে যান ভাই। আমাদের বাঁচান।
পিছনে দাঁড়ানো দস্যুর নাম রিপন শরীফ। দস্যুনেতার বড় ভাই। হঠাৎ করে কান্না করে দিলেন তিনি। সামনে এসে হাত ধরে বললেন, আমরা দুই ভাই জঙ্গলে। মা বাপের সাথে দেখা হয় না কতোদিন! বউ বাচ্চারা কান্নাকাটি করে। কিন্তু বাড়ি ফিরবো কী করে? মাঝে মাঝে মনে হয় এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে ক্রসফায়ারে মরা ভালো। বললাম, আমি চলে আসছি। আর ক্রসফায়ারে মরতে হবে না। ওরা পলকহীন। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আর চারপাশে নজর বুলাচ্ছে। মনে হয় ওরা এখনও ভাবছে যে আমাদের সাথে প্রশাসনের কেউ আসছে!
আমাকে ঘিরে দাঁড়ানো দস্যুরা। গল্প করতে করতে ওদের গতিবিধি খেয়াল করছি। হঠাৎ করে দস্যুনেতাকে নিয়ে নিচে গেলাম। মানে ট্রলারের ভিতরে। দস্যুদের জন্য বাজার করেছি। সেই বাজারগুলো বুঝিয়ে দিলাম। তারপর অন্যদের ডেকে বাজাগুলো নিয়ে যেতে বললাম। দস্যুনেতা জামাল শরীফকে নিয়ে তারপর উঠে আসলাম উপরে। আসলে বাজার দেখানোর উছিলায় তাদের ট্রলারের ভিতরটা দেখিয়ে আনলাম। এর ফলাফলও পেলাম হাতেনাতে।
বাজার নিতে নিতে দস্যুরা চোখের ইশারা বিনিময় করলো। মুহুর্তেই পাল্টে গেলো পরিবেশ। দস্যুরা বেশ নড়াচড়া শুরু করলো। কেটে গেলো এতোক্ষণের স্থবিরতা। থমথমে সুন্দরবনের গুমোট পরিবেশ কাটতে শুরু করলো। আসলে এই দস্যুদলের সদস্যরা আমাদের ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না। ভেবেছিলাম প্রথম দেখা বলে আস্থার সংকট। কিন্তু পরে বুঝেছি দলটির মধ্যে আত্মসমর্পণ নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ আমাদের বিশ্বাস করেছে, কেউ করেনি।
বিষয়টি বুঝতে পেরেছি বলে শুরুতেই আস্থার সংকট কাটানোর চেষ্টা করছি। সকালের চা-বিস্কিট, বাজার সদা হস্তান্তর, সেই সাথে তাদের মনোভাব বুঝে কথা বলতে বলতে পরিবেশ একদম হাল্কা হয়ে আসলো। সহযাত্রীদের মধ্যে এতোক্ষণ যে দুশ্চিন্তা ছিলো তাও কেটে গেলো। জানতে চাইলাম, দুপুরে আমরা খাবো কী?
বড় কাউইন মাছ রাখছি ভাই। সাথে জঙ্গলের আরও মাছ আছে। আপনারা আসবেন বলে জাল দিলাম নিজেরা। ভালো মাছ হইছে। বলছিলেন দস্যুনেতা জামাল শরীফ। বললাম, তাহলে তো আর দুশ্চিন্তা নাই। রান্না বান্না শুরু করেন। ওরা বললো, আগে জায়গা পরিবর্তন করতে হবে। তারপর শুরু হবে রান্না।
জোয়ার হচ্ছে। খালের ভিতরটা পানিতে ভরে গেছে। বললাম, চলেন তাহলে। দস্যুনেতা ছাড়া বাকীরা পাশের ট্রলারে ফিরলো। গাছের সঙ্গে বাঁধা ট্রলারটি খুলে নিলো। সেই সাথে পিছনের নৌকাগুলোও খোলা হলো। যে খালে ছিলাম সেই খাল থেকে বের হলাম। লগি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে পুরো বহর নিয়ে বের হলাম বড় খালে। তারপর ইঞ্জিন চালু করা হলো। চাত্রী খাল ধরে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি পশ্চিম দিকে।
দুই পাশে অনেকগুলো ছোট খাল পড়লো। আমাদের দেখে কয়েকটি কাঁকড়ার নৌকা পালানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু দস্যুরা তাদের ডেকে নিলো। ওরা সব সাধারণ জেলে। এমনিতে খুব দূরন্ত। কিন্তু সামনে বনদস্যুরা থাকলে একদম নরম হয়ে যায়। সেই সাথে আমাদের দেখে রীতিমতো ভড়কে গেছে সবাই। দস্যুরা তাদের নৌকাগুলো বেঁধে নিলো।
আতঙ্কে এই বহরের জেলেদের শেষ অবস্থা। ওরা বুঝতে পারছে না কেন তাদের আটকানো হলো! অপহরণ করলে তো অনেক টাকার ব্যাপার হয়ে যাবে। তারা চাঁদা দিয়ে এসেছে। কিন্তু ডাকাতদের চোখ পাল্টি দিতে সময় লাগে না! ওরর চোখ পড়ার চেষ্টা করছি আমি। আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় খাঁখাঁ করছে ওদের ভিতরটা।
দস্যুরা বললো, তোমাদের কোনো সমস্যা নাই। আমরা কাঁকড়ার নৌকা ধরি না। একজন বললো, তাহলে আমাদের ছেড়ে দেন। দস্যুনেতা বললো, এখন ছেড়ে দিলে তো তোমরা কোকিলমনি কোস্টগার্ডের কাছে গিয়ে বলে দিবে। সেই সুযোগ তো দেয়া যাবে না। বলেই আমার দিকে তাকিয়ে জামাল শরীফ বললো, জেলেদের কোনো বিশ্বাস নাই ভাই। ওদের সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলে উল্টো মাথায় উঠে বসে। বুঝতে পারছি, আমরা আছি বলে জেলেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করছে না তারা।
ধীরে ধীরে চলছে আমাদের নৌকা-ট্রলারের বহর। চলতি পথে আরও কয়েকটি জেলে নৌকা ধরলো ওরা। আধা ঘন্টার মতো চলার পর একটি ছোট খালে ঢুকে পড়লাম। নাম না জানা সেই খালটি অসাধারণ সুন্দর।
এক পাশে গোলপাতার বন। আরেক পাশে হেঁতাল আর হরগজা। একটু ভিতরে কিছু গড়ান গাছ আছে। ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গেওয়া গাছ। তবে এই অঞ্চল ভর্তি সুন্দরী গাছ। বেশ ঘন বন। এক হাত ভিতরের কিছু দেখা যায় না। দস্যুরা বললো, এদিকে মামার চাপ খুব বেশি ভাই।
পুরো শরীর শিরশির করে উঠলো। এখানে জঙ্গল এতো গভীর যে বাঘ মামা থাকলেও তাকে দেখার কোনো উপায় নাই। বরং নিজেকে আড়াল করে বাঘ মামা মনের মতো করে আক্রমণ করতে পারবে। দস্যুনেতা বললো, ভয়ের কিছু নাই ভাই। সাথে লোহা লক্কড় থাকলে বাঘ আসে না। বললাম, এই জঙ্গলে কতো শিকারী বাঘের হাতে মরছে তার হিসাব আছে? দস্যুনেতা বইশেল জাহাঙ্গীরকেও তো বাঘে মারছে। জামাল শরীফ হাসতে হাসতে বললো, ওটা বাঘ না ভাই, জঙ্গলের ভুত। আমিও হাসলাম। ভাবছি কতো অজানা এই বন!
বন্দুক হাতে ঘুরে বেড়ানো দস্যুরা বাঘের সামনে পড়ে। কখনও দুজন দুজনকে এড়িয়ে যায়। কখনও আক্রমণ করে। কে কখন কাকে আক্রমণ করবে বলা মুশকিল। কয়েক বছর হলো বাঘ কমেছে বলা হয়। কিন্তু বনের এদিকটাতে আসলে বাঘের আনাগোণার গল্প শুনি, জায়গায় জায়গায় উনার পায়ের ছাপ দেখি। কখনও দূরের সরু খাল লাফ দিয়ে পার হতে দেখি। তাতে বনে ঢুকলে মনে হয় না যে বাঘ কমেছে। পূর্ব সুন্দরবনের এদিকটাতে আসলে মনে হয় যেন বাঘের বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমরা।
খাল আরও সরু হয়ে আসলো। দুই পাশের গোল আর হেঁতাল গাছ ধরে টেনে নেওয়া হচ্ছে ট্রলার। কিছুদূর এগিয়ে ঠেকে গেলাম। তবে অসুবিধা নাই। জোয়ার হচ্ছে। কিন্তু দস্যুদের হাতে সময় নাই। হাঁকডাক দিয়ে তারা জেলেদের পানিতে নামালো। ওই সরু খালের কাদা পানিতে নেমে তারা ট্রলার ঠেলে নিয়ে গেলো সামনের দিকে। কিছু দূর এগিয়ে ভাসলো ট্রলার। জেলেরা উঠলো না। নৌকা-ট্রলার ঠেলে সামনে এগিয়ে চললো।
দস্যুনেতাকে বললাম, আর কতদূর যাবো আমরা? বললো, আরেকটু ভিতরে যাবো ভাই। জোয়ার হচ্ছে তো। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো জায়গায় থাকা যাবে না। আপনারা আসছেন। অনেকে দেখছে। প্রশাসনের কাছে খবর গেলে এসময় অভিযান দিতে পারে। তেমন কোনো ঝামেলা হলে গোলাগুলি হবে। তখন আপনাদের নিয়ে বিপদে পড়বো আমরা। বললাম, এমন গোলাগুলিতে পড়ার অভ্যাস আছে। সামলে নিবো।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)