গোলপাতার বাগানে বনদস্যুর ডেরা | রূপান্তরের গল্প ৩৩৮ | Rupantorer Golpo 338 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৩৮ : এলাকায় থাকতে পারিনি। শত্রুতা করে মার্ডার কেস দিছি আমাদের নামে। তারপর পালায়ে ঢাকা চলে যাই। পরে পুশিশের হাতে ধরা পড়ি। অনেকগুলো টাকা খরচ হয় জেলখানা আর আইন আদালত করতে। কিন্তু এতো টাকা পাবো কই? ধার করি সূদে। এভাবেই গত কুড়ি বছর ধরে চলছে। মামলার খরচ চালাতে জমিজমা সব বেচা হয়ে গেছে। এখন শুধু বাপের ভিটাটা আছে। এবার গ্রেফতার হলে আর জামিন নিতে পারবো না। আবার RAB এর হাতে ধরা পড়লে কোন বিপদে পড়ি তা তো জানেনই…. ক্যামেরার সামনে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলছেন বড় সুমন বাহিনীর প্রধান জামাল শরীফ।
একে একে অন্য দস্যুদের সাক্ষাৎকার নিলাম। সবার কাহিনী একই রকম। এলাকায় মামলা খেয়ে ফেরারি হয়ে এসেছে দস্যুতায়। তারপর আর ফিরতে পারেনি। পলিন ছবি তুলছেন। তাকে সহযোগিতা করছেন বাগেরহাটের সহকর্মী ইয়ামীন ভাই। ট্রলারের অন্যরা বিশ্রাম নিচ্ছে।
দেখতে দেখতে জোয়ার শেষ হলো। পুরো বন ছলছল করছে। পানির কলকল শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। এদিকে হরিণ থাকার কথা। কিন্তু চোখে পড়লো না, ডাকাডাকিও বন্ধ। সময় সময় কুকু পাখি ডাকছে। কিছু মাছরাঙ্গা ছুটছে গাছ থেকে গাছে। মাঝে মাঝে পানিতে ছোঁ মারছে। মাছ ধরে আবার ফিরে যাচ্ছে গাছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে ভেসে আসছে হরিণের ডাক।
কারা যেন আসছে। দস্যুনেতার ইশারায় সবাই চুপ করলো। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছে। মিনিট খানেক পর দেখি পাহাড়ায় যাওয়া দস্যুদের নৌকা। পাহাড়ায় থাকা দুজন গাছে বসা। নতুন করে দুইজন যাবে এখন। তারপর ওরা ফিরবে। তিন ঘন্টা পর পর এভাবে ডিউটি বদল হয়। পরবর্তী দুইজন রেডি হলো। কিছু শুকনা খাবার বেঁধে নিয়ে ফিরবে তারা। আমিও নৌকায় চড়ে বসলাম। দেখবো ওরা কেমন করে পাহাড়া দেয়!
নৌকা চলছে স্রোতের বিপরীতে। জোরসে বৈঠা চলছে। সামনে পেছনে দুইজন। মাঝখানে বসা আমি। তীব্র স্রোতে এগুনো যাচ্ছে না। পরে পাশের গোল গাছ ধরলাম।
ভারসাম্য হারিয়ে গেলো নৌকার। কোনো রকমে সামাল দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ালো নৌকা। জেলেরা রেগে গেছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না। একজন শুধু বললো, জঙ্গলে যেমন তেমন চললে হয় না। বললাম, স্যরি ভাই। সাথে সাথে এক গাল হাসি দিয়ে তিনি বললেন, আপনি আমার ভাইপোর মতো। কিছু মনে করবেন না। বললাম, মাফ করে দেন কাকা! বেশ লজ্জা পেলেন তিনি। প্রায় কুড়ি মিনিট লাগলো খালের আগা পর্যন্ত যেতে।
কু- কু- কু- কু। চারপাশ থেকে ডাকছে কুকু পাখি। মানে জোয়ার শেষ। এখন ভাটা শুরু হলো। স্রোত ঘুরে গেছে উল্টো দিকে। তবে চাপ নাই। নৌকা বাঁধা হলো গাছের সাথে। এখানেও গোল পাতার ঝাড়। পাহাড়ারত দস্যুরা বসা একটি বাইন গাছে। ওখান থেকে বড় খালের দুই পাশ দেখা যায়।
জঙ্গলে প্রায় কোমড় সমান পানি। আমার সাথে আসা দুইজন দস্যু নৌকা থেকে নামলো। পানি কাদা মাড়িয়ে গিয়ে উঠলো ওই গাছে। গাছের দুইজন নেমে আসলো। পানিতে নেমে হেঁটে আসলো তারা। তারপর টুপ করে নৌকায় উঠে বসলো।
গোলপাতার ঝাড় এখানেও। নৌকা ঘুরাতে তাই বেগ পেতে হচ্ছে। ভাবছি গোলপাতা ধরে আবার একটু সহযোগিতা করবো। কিন্তু আসার সময়ের অভিজ্ঞতা মনে পড়লো। নৌকার মাঝি সেই প্রবীন জেলে। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন। বললেন, জঙ্গলকে আমরা বলি বাদা-বন। মানে বাধায় ভরা বন। চারপাশে এতো রকমের বাধা যে এখানে চলতে না জানলে প্রতি ধাপে বিপদ।
স্রোতের চাপে নৌকা ঘুরে যাচ্ছে। আমি যেখানে বসা সেই জায়গাটি গিয়ে বাড়ি খেলো গোল গাছের সাথে। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়ালেন মাঝি। বৈঠা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকা সরালেন। তারপর ভারসাম্য ঠিক করে বললেন, গোল গাছে সাপ দেখছেন? না তো! কিছু দেখতে পাচ্ছি না। ভালো করে তাকিয়েও কিছু দেখছি না। দেখবো কী করে? গাছের পাতাও সবুজ, সাপের রঙও সবুজ। সাপটি বিষধর কী না জানি না। তবে ওরা বললো, অনেক বিষ! পুরো শরীর আমার শিরশির করে উঠলো। সাপ আমি ভীষণ ভয় পাই।
ফিরতি পথ ধরলাম। এখন স্রোতের কোনো চাপ নাই। বেশ স্বাচ্ছন্দে চলছে নৌকা। প্রবীন সেই জেলে এবার খুব নরম সুরে বললেন, জঙ্গলে এসে হুট করে কোনো গাছে হাত দিবেন না। বিশেষ করে গোল গাছের পাতায় কখনও হাত দিবেন না। সবুজ রঙ এর সাপ আর পোকামাকড়ের অভাব নাই। ওই সাপ দেখতে নিরীহ। কিন্তু খুব বিষ! বললাম, জঙ্গলে কেউটে সাপের অভাব নাই। কিছু বলে না কেন? কাকা বললেন, ওরা আক্রমণ করে না। করলে জঙ্গলে পা রাখতে পারতো না কেউ!
গল্পে গল্পে ফিরলাম ট্রলারে। এদিকে মহা ধুমধামে রান্না চলছে। দস্যুদের বাবুর্চিকে সরিয়ে রান্নায় বসেছেন বেলায়েত সর্দার। তার হাঁকডাকে চারপাশ সরগরম! কাউইন মাছগুলো কেটেকুটে পরিস্কার করা। বড় কড়াইয়ে হবে রান্না। এই মাছ সাধারণত এক পাকে রান্না করতে হয়। হবেও তাই।
বেশ ক্ষুধা লেগেছে ভাই। রান্না শেষ হবে কখন? সর্দার বললেন, এদের চুলার যে অবস্থা ভাই! ছোট ছোট হাঁড়ি পাতিল। এতোজনের রান্না করা যায়? তাকিয়ে দেখি নৌকায় নৌকায় চুলা জ্বলছে। ভাগ ভাগ করে রান্না হচ্ছে। মানে ছোট হাঁড়িতে করে তিন চুলায় ভাত হচ্ছে। দস্যুদের মূল নৌকার চুলাটা একটু বড়। তরকারি হচ্ছে তাতে। সর্দারের রান্না বলে কথা! সুঘ্রাণ ছড়িয়ে গেছে।
ভাটা চলবে আরও প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। এর মধ্যে আমরা আর জায়গা পরিবর্তন করবো না। এসময় প্রশাসনের লোকজনও আসেন না। কারণ পানি কমছে। স্পিডবোট বা ট্রলার নিয়ে এমন গহীন খালে আসার অভ্যাসও নাই তাঁদের। শুধুমাত্র সুনির্দিষ্ট খবর পেলে অভিযান চালাতে পারেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময় এভাবে অভিযান চলে না। বাদাবনের পরিবেশের সাথে চলতে জানা মানুষ ছাড়া সেই অভিযান সম্ভবও না।
জোয়ার-ভাটা, গহীন বন আর রাতের অন্ধকারের সুযোগ নেয় বনদস্যুরা। এমন খালে এসে বসে থাকলে দিনের আলোতেও তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ এসে আক্রমণ করলে আস্তে করে জঙ্গলে নেমে যায় দস্যুরা। তারপর হারিয়ে যায়। বনে হেঁটে তাদের ধরা বা পরাস্ত করা এক রকম অসম্ভব কাজ।
বড় সুমন বাহিনীর এই বহরে এখন কয়েকজন অপহৃত জেলে আছে। তাদের কাউকে বেঁধে রাখা হয়নি। দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। সুন্দরবনের খাল থেকেই তাদের ধরে এনেছে দস্যুরা। আগাম চাঁদা না দেওয়ার অপরাধে তাদের এখন শাস্তি হবে। মুক্তিপণ দিয়ে তাদের ফিরতে হবে। এই দস্যুদলের মুক্তিপণের পরিমান পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লাখ। বিরাট দুশ্চিন্তার বিষয়!
বনদস্যুদের নির্যাতনের গল্প শুনি আমরা। তারা জেলেদের মারপিট করে। বিশেষ করে কারও উপর রাগ থাকলে তার উপর নির্যাতন চলে। আগে শুনতাম অপহরণের পর জেলেদের বেঁধে রাখে দস্যুরা। প্রচুর মারপিট করে। কিন্তু দস্যুদের ডেরায় এসে দেখি অন্য চিত্র। জেলেদের খোলামেলা চলাফেরা দেখে বুঝা যায় যে তারা অপহৃত। তবে ব্যতিক্রমও আছে।
সকাল থেকে বনদস্যুদের সাথে কথা বলছি। ওই এক কথাই বলছে সবাই। নির্যাতিত হয়ে দস্যুতায় এসেছে। অপরাধের এই জীবন ছাড়ার ইচ্ছা আছে। কিন্তু ক্রমফায়ারের ভয়ে এখন আর তারা ডাঙ্গায় ফিরে না। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্সরা তাদের সব খবর জানিয়ে দেয়, ধরিয়ে দেয়।
দস্যুনেতা জামাল শরীফ সামনে বসা। সোর্স আলমগীরকে ডেকে নিলাম। বললাম, আপনারা একই সাথে দস্যুদের বন্ধু আবার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স। দুটি জিনিষ একসাথে চলে কী করে? আলমগীর বললো, বেঈমান তো তাদের দলের ভিতরে থাকে। আমরা তো শুধু খবর পৌঁছাই। ধরেন এই দলের ভিতর থেকেই কেউ না কেউ RAB-পুলিশের সোর্স। তারাই সব খবর জানিয়ে দেয়। আমার মতো সোর্স তো এদিকে অসংখ্য। সবাই দুই দিকে খেলে।
গল্প জমে উঠলো। দস্যু জগতের ভিতরের গল্প। বেঈমানীর এক একটা কাহিনী সিনেমার গল্পকেও হার মানায়।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)