রূপান্তরের গল্প ৩৪০ | Rupantorer Golpo 340

জঙ্গলে হারিয়ে গেলো সর্দার! | রূপান্তরের গল্প ৩৪০

জঙ্গলে হারিয়ে গেলো সর্দার! | রূপান্তরের গল্প ৩৪০ | Rupantorer Golpo 340 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৪০ : দরদর করে ঘামছি। ভ্যাপসা গরম। মনে হচ্ছে সারা বেলা সূর্যের উত্তাপ জমা হয়েছে এই বনের ভিতর। বাতাস নাই বললেই চলে। এই গরমের মধ্যে টিকে থাকাই মুশকিল। একদম দম বন্ধ করা অবস্থা। অথচ রাতের বেলা ছিলো উত্তরা বাতাস। ভোর বেলায় ছিলো ভারী কুয়াশা।

বড় সুমন বাহিনীর দস্যুরা একটু দমে গেছে। আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে দুশ্চিন্তায়। পুরনো দস্যু রফিকুল অবশ্য বিষয়টি ভিন্ন ভাবে দেখছে। সে বলছে, কোনো ভাবে জঙ্গল থেকে উঠায়ে নেন ভাই। তারপর বাকীটা দেখা যাবে। এখানে তো কখন কার গুলিতে মরি তার নাই ঠিক।

আপনারা কি আসবেন? নাকী গল্পই করে যাবেন? নৌকায় দাঁড়িয়ে বলছেন বেলায়েত সর্দার। তাকিয়ে দেখি দুটি নৌকা একাসাথে বাঁধা। চারটি গড়ান গাছ কেটে চারপাশে বাঁধা। তার উপর বিছানার চাদর দিয়ে সামেয়ানার মতো করে টানানো। নৌকা দুটোর মাঝখানে ভাতের হাঁড়ি রাখা। গামলায় কাউইন মাছের তরকারি। আরেক গামলায় চিংড়ি দিয়ে সবজি। এখন আমার জন্য শুকনা মরিচ ভাজা চলছে। খোন্তা দিয়ে মরিচ ভাজছে এক জেলে। তাকে অপহরণ করেছে সুমন বাহিনী।

অবলীলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে অপহৃত জেলেরা। রান্নাসহ নানা কাজে সহযোগিতা করছে। আমরা আসায় তাদের কাজ বেড়েছে। ওদের মন খারাপ। ডাকাতরা মারপিট না করলেও টাকা তো নিবে। দস্যুদের সাথে আমার সম্পর্ক দেখে চোখ বড় বড় করে দেখছে। কিছু বলছে না।

জোড়া নৌকা ভাসছে চাত্রীর এই সরু খালে। চারপাশে আরও নৌকা আছে। তার মাঝখানে ছাউনি দেওয়া জায়গাটুকু দেখতে বেশ লাগছে। সর্দার বললেন, এটা আমাদের জঙ্গলের ডাইনিং রুম ভাই। আপনাদের শহরের বাড়িতে থাকে না? খাওয়ার ঘর? কথা শুনে না হেসে পারা যায়? হাসতে হাসতে এগিয়ে গেলাম। দস্যুনেতাসহ অন্যদের ডাকলাম। আমার সহকর্মীরাও ঘুম জড়ানো চোখ ডলতে ডলতে এসে বসলো পাশে।

আমার ভিডিওগ্রাফার পলিন ঝাল একটু বেশি খায়। আমারও একই অবস্থা। ঝাল ছাড়া খেতে পারি না। বিশেষ করে সুন্দরবনে আসলে ঝালের চাহিদা বেড়ে যায়। জেলেরাও ঝাল খায়। তাই যেকোনো নৌকায় চড়লে শুকনা মরিচ টেলে একবেলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারি। যাই হোক, আজ সকালের খাবারের আয়োজনটা বেশ জমকালো।

খেতে বসে অন্য দস্যুদেরও বসতে বললাম। কিন্তু লোকজন কম দেখছি। ওরা সব কোথায় গেলো? দস্যুনেতা বললো, আশেপাশে আছে ভাই। বললাম, আশেপাশে মানে? কোনো কাজে গেছে? আলমগীর কোথায়? জুয়েলকেও দেখছি না যে! মনের ভিতরটা খচখচ করে উঠলো। দস্যুনেতাকে বললাম, এখন আবার কোন কাজে গেছে? সে বললো, রাতে খাবেন না ভাই? বললাম, রাতে থাকবো, খাবো। কিন্তু লোকজন গেলো কোথায়? সর্দার বললেন, ওরা শিকারে গেছে ভাই। রাতের জন্য হরিণ মারতে গেছে!

মেজাজটা বিগড়ে গেছে। কিন্তু প্রকাশ করলাম না। জামাল শরীফকে বললাম, শিকারে পাঠালেন কেন ভাই? এসেই তো নিষেধ করলাম। বলে, মানা করলেন ঠিক আছে। তাই বলে দাওয়াত দিয়ে এনে সুধা ভাত খাওয়াবো? সর্দারকে বকাঝকা দিলাম। বললাম, আপনি না করতে পারলেন না? আমাকে তো জানাতে পারতেন? সর্দার বললেন, খেয়ে নেন আগে ভাই। আমি ওদের ধরে আনবোনে।

এক দুই লোকমা ভাত মুখে দিতেই গুলির শব্দ পেলাম। খুব কাছে থেকে আসলো সে শব্দ। সর্দার উঠে দাঁড়ালেন। কোনো কথা না বলে নৌকা থেকে নৌকায় লাফিয়ে গিয়ে নামলেন জঙ্গলে। কিছু বুঝে উঠার আগে জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন সর্দার।

খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠলো। টেনশনে উঠে দাঁড়ালাম। দস্যুনেতা বললো, বসেন ভাই। আমরা দেখতেছি। বললাম, কী দেখবেন বলেন তো ভাই? আপনার লোকজন শিকারে চলে গেলো। সর্দারও জঙ্গলে হারিয়ে গেলো। এখন একটা অঘটন ঘটলে কী হবে? জামাল শরীফ হাসছে। বললো, ওরা এদিকে আসছে ভাই। টেনশন করেন না। বলতে বলতে হাজির হলেন সর্দার। বললেন, ও ভাই, চোর সব ধরে আনছি দেখেন।

শিকারীর দল ফিরেছে। সাথে জুয়েল, আলমগীর আর একজন জেলে। বললাম, গুলি করলে কাকে? পাইছো শিকার? সর্দার বললেন, ওরা তো হরিণ টার্গেট করে গুলি করেনি ভাই। সামনে বাঘ পড়ছিলো। সেই ভয়ে ফাঁকা ফায়ার করছে। বললাম, বাঘ মানে? এখানে বাঘ? নৌকায় উঠে আসেন আপনারা!

একে একে নৌকায় উঠলো সবাই। পা ভর্তি কাদা। ভাটার পর এদিকের জঙ্গল কাদায় ভরে থাকে। শুলো, কাঁটা আর কাদায় হাঁটা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু জঙ্গল করা মানুষেরা পারে। অনায়াসে তারা জঙ্গলের এমাথা ওমাথা দাপিয়ে বেড়াতে পারে। পায়ের কাদা ধুয়ে উঠে আসলো সবাই। বললাম, বাঘের খাবার হতে গেছিলেন?

হাতে বন্দুক থাকলে বাঘে কী করবে ভাই? এতো সহজ? শিকারে যাওয়া দস্যু রিপন শরীফ বলছিলেন কথাগুলো। লিকলিকে শরীরের মধ্যবয়সী এই বনদস্যু চোখে-মুখে কথা বলে। বললাম, আমি তো ভাবছি হরিণ মারলেন। বোকার মতো হাসি দিয়ে সে বললো, সকাল থেকে কোনো হরিণের ডাক শুনলেন ভাই? বললাম, না। যা একটু শুনছি সেটা অনেক দূরের। তার মানে বাঘ মামা এখানে আগে থেকেই আছে?

এবার মুখ খুললেন সর্দার। বললেন, এখানে আসর পর থেকেই শরীরটা ভার ভার লাগছিলো ভাই। বাঘের আলামত এটাই। জঙ্গল করা মানুষেরা বিপদ টের পায়। যারা মানে তারা বেঁচে যায়। আর যারা আলামত দেখেও সাবধান হয়না তারা বিপদে পড়ে, মারা পড়ে। বললাম, আপনি তাহলে লাফ দিয়ে গেলেন কেন? তাও একা একা? সর্দার বললেন, ওদের ধরে না আনলে তো আপনার মুখে ভাত উঠবে না। এছাড়া গুলির শব্দ আসলো একদম কাছে থেকে। দেখলেন না কতো তাড়াতাড়ি ফিরে আসলাম? এবার আমার সোর্স আলমগীরের দিকে তাকালাম। সে বললো, স্যরি ভাই। ভাবলাম একটু শিকার দেখে আসি।

আবার খেতে বসলাম। বললাম, রাতের বেলাও আমরা মাছ খাবো। শেষ ভাটায় জাল তোলা হয়। আশেপাশে জেলেরা আছে না?

এবার রফিকুল বললো, জাল পাওয়া যাবে ভাই। সময় আছে আরও দুই ঘন্টা। আমি খোঁজ নিয়ে রাখছি। ভাত খেয়ে বের হবোনে। বললাম, এখানে কি সব বেন্দী জাল? সে বললো, বেন্দী, চরপাটা আর খালপাটা জাল আছে আশেপাশে। দুই চারটা ফাঁসজালও আছে।

খাওয়া শেষ করে ট্রলারে ফিরলাম। গোসল করবো। মিঠা পানির ড্রাম থেকে কয়েক মগ পানি ঢাললাম। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো শরীর-মন। জামা কাপড় বদলে রেডি হলাম। এবার জাল তুলতে যাবো। সর্দারকে বললাম, খেয়ে নেন ভাই। মাছ ধরতে যাবে। উনি বললেন, আমি একটু রেস্ট নিবো ভাই। আপনারা যান। বললাম, রেস্ট নেন অসুবিধা নাই। আবার জঙ্গলে নামবেন না! আবার হারায়ে যাইয়েন না! ফিক করে হেসে দিলেন সর্দার। বললেন, আপনার জ্বালায় কিছু করতে পারি না ভাই। একটা বাঘ আসছে এদিকে তাকে একটু দেখতে হবে না?

আপনি কোথাও যাবেন না। দস্যুরাও কেউ আপাতত জঙ্গলে নামবেন না। যদি মাছ নিয়ে আসতে না পারি তাহলে ডাল ভাত খাবো। সর্দার বললেন, তাহলে তো আমার আর কোনো কাজ নাই। চলেন, আপনার সাথে জাল টানতে যাবো!

(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top