রূপান্তরের গল্প ৩৪১ | Rupantorer Golpo 341

অজানা শংকা! ধকধক করছে বুক! | রূপান্তরের গল্প ৩৪১

অজানা শংকা! ধকধক করছে বুক! | রূপান্তরের গল্প ৩৪১ | Rupantorer Golpo 341 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৪১ : ছোট খালটি প্রায় শুকিয়ে গেছে। জায়গায় জায়গায় শুধু কাদা। অবশ্য এখনও ঘন্টা খানেক ভাটা আছে। আমাদের দ্রুত নেমে যেতে হবে বড় খালে।

আমার নৌকার সামনে পেছনে দুজন সশস্ত্র বনদস্যু। তারাই বৈঠা ধরেছে। পাশে আরেক দস্যু আকরাম। বেলায়েত সর্দার বসেছেন আরেক নৌকায়। সেখানেও সশস্ত্র তরুণরা আছে। দুটি নৌকা নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। ছোট খাল ধরে প্রথমে যাবো বড় খাল- চাত্রীতে। তারপর কোন দিকে যাবো জানি না।

সুন্দরবনের প্রতিটি খাল ভরা জোয়ারে দেখতে এক রকম। আবার সার ভাটিতে তার চেহারা পাল্টে যায়। শেষ ভাটায় পানি যখন একদম নেমে যায় তখন খালগুলোর চেহারা হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর।

আমরা নৌকা বেয়ে চলছি। মাঝে মাঝে ঠেকে যাচ্ছে তলা। কাদায় নেমে দস্যুরা ধাক্কা দিয়ে পার করছে। তারপর আবার যখন নৌকা ভাসছে তখন বৈঠা চলছে। খালের একপাশে গোলপাতার বন। আরেক পাশে হেঁতালের ঝোপ। গাছের গোঁড়ায়, কাদায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কাঁকড়া। মাড স্কিপার বা মেনু মাছগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে শিকার ধরছে। কয়টা পুরুষ মেনু মাছ পাখনা ফুলিয়ে মারামারি করছে। দেখতে ভালো লাগছে। জায়গায় জায়গায় পানির সাপ শিকারের চেষ্টা করছে। সামান্য পানিতে আটকা পড়া মাছগুলো তাদের টার্গেট। মনে পড়লো সকালের সেই সবুজ সাপের কথা। আমি ভয় পাই। জড়োসড়ো হয়ে নৌকার মাঝখানে বসা আমি। সাপকে ভয় পাওয়া দেখে অন্যরা হাসছে।

খালটির মুখে দুইজন দস্যু পাহাড়ায় আছে। কিন্তু ওদের দেখছি না এখন। গেলো কোথায়? সাথে থাকা দস্যুরা একটু দুশ্চিন্তায় পড়লো। নৌকা থামিয়ে একজন নেমে পড়লো। কোমড় সমান কাদা মাড়িয়ে বাম পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়লো একজন। ফিরে আসলো দুটি বন্দুক নিয়ে।

ঘটনা কী? ওরা কোথায়? বন্দুক হাতে নিয়ে ছেলেটি বললো, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। পাহাড়া দিতে এসে দুইজন ঘুমাচ্ছে। এমন ঘুম যে হাত থেকে বন্দুক নিয়ে আসলাম তাও টের পায়নি। বললাম, ডাকো ওদের। বন্দুকগুলো নৌকায় রাখতে রাখতে ওই দস্যুরা এসে দাঁড়ালো। চোখ ডলতে ডলতে যা বললো তার অর্থ হলো, দুইজনের একজন পালা করে ঘুমানোর কথা ছিলো তাদের। কিন্তু কখন যেন দুইজনই ঘুমিয়ে পড়েছে। বললাম, কোনো জেলে আসলে তো বন্দুক নিয়ে যেতো। বাঘ আসলেও তো খবর ছিলো।

বন্দুকগুলো ফেরত দেওয়া হলো না। বনদস্যু আকরাম বললো, তোমরা এখানে থাকো। খালি হাতে ডিউটি দাও। আমরা ফিরার সময় নিয়ে যাবো। তারপর লিডারের কাছে বিচার দিবো। এরপর যদি লিডার বলে তাহলে বন্দুক ফেরত পাবে। তার আগে না। ওরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আমরা রওনা দিলাম।

বড় খালটির নাম চাত্রী। অনন্য সুন্দর একটি জায়গা। ভাটায় পানি নেমে গেছে। মাঝ দিয়ে চলছে দুটি নৌকা। জানতে চাইলাম, কতোদূর যাবো আমরা? ওরা বললো, জাল খুঁজতে হবে। ঠিক কোন জায়গায় জেলেরা আছে জানি না। তবে আশেপাশে কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে। এখন জাল তোলার সময়। ওরা সব জালে থাকবে।

আধা ঘন্টা চলার পর একটি পাশ খালের মুখে জাল পাতা দেখলাম। খালপাটা জাল। সেখানে একটি নৌকা বাঁধা। কিন্তু লোকজন নাই। সম্ভবত মাছ তুলতে তারা খালের আগায় গেছে। বনদস্যু আকরাম বললো, ফিরার পথে ওদের সাথে দেখা হবে।

নৌকা বাইতে বাইতে আমরা প্রায় পশুর নদীর কাছাকাছি চলে আসলাম। পথে কোনো জাল পাইনি। তবে একটি নৌকার দেখা পেলাম। ওরা কাঁকড়ার জেলে। ওদের কাছে আশপাশের জালের খবর নিলাম। বললো, ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়া থেকে পূর্ব দিকে বেন্দী জাল আছে।

ওদের সাথে নিয়ে রওনা দিলাম। ভাটার স্রোত যেটুকু আছে তার সাথে বৈঠা বেয়ে সেখানে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। সাধারণত দিনের আলোয় বনদস্যুরা এভাবে চলে না। আমরা আছি বলে একটু ঝুঁকি নিলো ওরা। বললাম, বন্দুকগুলো লুকিয়ে রাখো। বাকীটা আমি দেখবোনে। এই সার ভাটির সময় প্রশাসনের আসার সম্ভাবনা নাই। তার উপর সন্ধ্যা নামছে। অন্ধকারে প্রশাসন এসব খালে আসে না।

ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়া পেরিয়ে পূর্ব দিকে যাচ্ছি। এক বাঁক ঘুরতেই জালের দেখা পেলাম। বেন্দী জালে নৌকা বাঁধা। তিনজন জেলে জাল টানছে। সুন্দরবনে জাল ফেলানো ও জাল টানার সময় এই শেষ ভাটা। যে যেখানেই থাকুক, এই সময় তারা জালে আসবেই।

আমাদের দেখে একটু থমকে গেলো জেলেরা। মনে হলো যেকোনো সময় নৌকা নিয়ে দৌড় দিবে। আমি হাত নেড়ে তাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। চিৎকার করে বলছি, সমস্যা নাই ভাই। আপনারা থাকেন, কাজ করেন! মনে হলো আরও ভয় পেয়ে গেছে ওরা। এদিকে ভয় বলতে দস্যুরা। তারচেয়ে বেশি ভয় বন বিভাগ। অভয়াশ্রমে যদিও তারা ঘুষ দিয়ে আসে। তবুও কখনও কখনও সেই বনরক্ষীরাই পাল্টি দেয়। ওরা সম্ভবত সেই ভয়টা পাচ্ছে।

পাশের নৌকায় সর্দার আর আলমগীর। আমার সোর্স এই আলমগীর সম্ভবত ওদের চিনতে পেরেছে। নৌকায় দাঁড়িয়ে সে হাত তুললো। বললো, এই তোমাদের ভয়ের কিছু নাই। বলতে বলতে আমরা চলে আসলাম জালের কাছে। আলমগীরকে তারা ভালো করে চিনে। পরে জেনেছি, ওরা আলমগীরেরই জেলে। মানে পূর্ব সুন্দরবনের এদিকে জেলেদের নিয়ে ব্যবসা করে সে। দস্যুদের সহযোগিতায় চলে তার অন্তত ২৫-৩০টি জেলে নৌকা। চরপাটা, খালপাটা, বেন্দী জাল মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জেলে এদিকে মাছ ধরে।

আলমগীরকে দেখে জেলেরা আশ্বস্ত হলো। সাথে দস্যুদের দেখে ভড়কে গেলো। সাথে আমাকে দেখে রীতিমতো বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলো। তারপরও হাত চলছে তাদের। কারণ ভাটা শেষ হওয়ার আগেই জাল তুলতে হবে। এর মধ্যে আলমগীর উঠে তাদের নৌকায় গেলো। কানের কাছে বিরবির করে কিছু বললো। আমি না দেখার ভান করলাম।

কাঁথার নিচে রাখা বন্দুকগুলো তুলে হাতে নিলো দস্যুরা। মূল খাল বলে এখন একটু বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে। সন্ধ্যা হলে অন্য ডাকাতের দল এদিক দিয়ে চলাফেরা করতে পারে। তাই বন্দুকে গুলি ভরে সতর্ক অবস্থানে বনদস্যুরা। চারপাশে নজর রাখতে বলে আমিও জেলেদের নৌকায় উঠলাম।

জাল টানা প্রায় শেষের দিকে। আরেকটু পর উছোল উঠবে। জেলেদের শক্ত হাতগুলো চলছে। এদিকে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে সূর্য। উত্তরা বাতাস শুরু হলো। শীতল বাতাসে কেঁপে উঠছে শরীর। অবশ্য শীত-গরম কিংবা বর্ষা নিয়ে জেলেদের কখনও মাথা ব্যাথা নিতে দেখি না। ভেজা শরীরে তারা নির্বিকার থাকে। কাজ করে যায়।

উছোল মানে জালের শেষ অংশ। ওখানেই সব মাছ জড়ো হয়। বেন্দী জাল তোলার সময় পুরো আকর্ষণ থাকে ওই উছোলের দিকে। জেলেদের কাছে জানতে চাইলাম, মাছ কি আছে মনে হয়? মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো তারা। তার মানে মাছ আছে।

কয়েক মিনিটের মধ্যে উছোল উঠলো। এবার মাছগুলো ফেলবে নৌকার উপর। আমি লাফ দিয়ে আমাদের নৌকায় ফিরলাম। কারণ ছোট্ট নৌকায় জায়গা কম। এছাড়া জালে সাপ থাকে। আমার ভয় লাগে।

জালের উছোল ভর্তি মাছ। মুখের দড়ি খুললো একজন। ঝরঝর করে মাছ পড়লো। নৌকার পাটাতন ভরে গেলো সাপ, কাঁকড়া, কুচিয়াসহ নানা জাতের মাছে। চিংড়ি পড়েছে না হলেও এক-দেড় মণ। এ পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু এরপর যা দেখলাম তা দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

জালে যা পড়েছে তার সবটুকু নৌকার খোলের ভিতরে ফেললো ওরা। তারপর দেখি ভিতরে খলবল করছে কী যেন। প্রথমে ভেবেছিলাম গুইসাপ। এসময় সর্দার বললেন, ও ভাই জালে কী পড়ছে দেখেন!

লাফ দিয়ে ওই নৌকায় গেলেন সর্দার। খোলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বের করলেন একটি কুমিরের বাচ্চা। জেলেরা বললো, কুমিরের বাচ্চা ফুটছে। ইদানিং জালে পড়ছে। শুনলাম পূর্ব সুন্দরবনের এদিকটাতে কুমিররা ডিম দেয়, বাচ্চা ফোটায়। সেলা নদী সংলগ্ন খালগুলোতে বড় বড় কুমির দেখা যায় সারা বছর। তবে ডিম পাড়ার সময় এদিকের ছোট খালগুলোতে আসে তারা।

সন্ধ্যা নেমেছে। সূর্য ডুবলেও এখনও আবছা আলো আছে। সেই আলোতে কাজ শেষ করে জেলেরা ফিরতে চায়। কিন্তু দস্যুদের সাথে দেখা হওয়ার পর কোনো জেলেদের ফিরে যাওয়ার উপায় থাকে না। দস্যুদের সুবিধা মতো তাদের ছাড়া হয়।

বেন্দী জাল আর কাঁকড়ার নৌকাটি নিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। চারটি নৌকা চলছে খালের ডান পাশ ঘেঁসে। ঘসিয়াঙ্গাড়ীর দোয়া পেরিয়ে চাত্রীর দিকে ঘুরলাম। ততোক্ষণে স্রোত ঘুরে গেছে। ভাটা শেষ হয়ে শুরু হয়েছে জোয়ার। বুকটা ধক ধক করছে।

মাছ ভর্তি নৌকা নিয়ে চলছি আমরা। ফিরে যাবো দস্যুদের ডেরায়। আপাতত নৌকা বাওয়ার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। সবাই চুপ। এর মধ্যে বুকের ভিতরের ধকধক শব্দটা মনে হলো বাইরে থেকেও শুনতে পাচ্ছি। অজানা শংকা ভর করেছে মনে।

(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top