কাছেই হাঁটছে বাঘ মামা | রূপান্তরের গল্প ৩৪২ | Rupantorer Golpo 342 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৪২ : হুমমম….!! ভয়ঙ্কর শব্দে চারপাশ খান খান হলো। ভেঙ্গে পড়লো নিরবতা। আমরা ডিঙ্গি নৌকায় বসা। প্রথম জোয়ারের স্রোতের সাথে পানিতে পড়ছে বৈঠার বাড়ি। পর পর চলছে চারটি নৌকা। আমাদের নৌকাটি সবার সামনে।
হুমমম…. আবার ডাকছে বাঘ! একবার না। পর পর তিন বার। ভর সন্ধ্যায় এমনিতেই বুকটা দুরু দুরু করছে। তার মধ্যে এমন গগণ বিদারী গর্জন! সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে। ভয়টা বেশি লেগেছে কারণ বাঘটি আমাদের থেকে বেশি দূরে নাই। আমরা যে খালে আছি তার কাছাকাছি কোথাও।
বাঘের ডাক এর আগেও কম বেশি শুনেছি। তবে এতো কাছে থেকে না। যতোবার ওদের হাঁকডাক শুনেছি প্রতিবারেই ট্রলারে ছিলাম অথবা নিরাপদ জায়গায় ছিলাম। দুপুরে দস্যুরা যখন শিকারে যায় তখন বাঘ দেখেছে বলছে। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। এবার বুঝলাম বাঘ মামা আমাদের আশেপাশেই আছে।
বুকটা ধরফর করছে। মনে হচ্ছে হৃৎপিন্ডটা বুক ভেঙ্গে বের হয়ে আসবে। এমন পরিস্থিতিতে কী করা যায়? সত্যি বলতে কিছু করার নাই। ভয় কমিয়ে ধাতস্ত হতে হবে। এটাই আপাতত আমার প্রথম কাজ। নৌকার অন্যরা স্বাভাবিক। শুধু সর্দার খোঁজ নিচ্ছেন। পেছনের নৌকা থেকে আমাকে ডাক দিয়ে বললেন, ও ভাই, কীরাম হলো? বললাম, খুব ভালো। আপাতত ট্রলারে চলেন।
চাত্রী পেরিয়ে আমাদের খালের মুখে আসলাম। এক সিকি জোয়ার হয়েছে। সরু খালটিতে সামান্য পানি ঢুকেছে। দেখি পাহাড়ার দায়িত্বে থাকা দুই দস্যু খালে নেমে দাঁড়িয়েছে। আবছা আলোয় তাদের দেখছিলাম। কাছে গিয়ে দেখি থরথর করে কাঁপছে। বাঘের ডাক শুনে তারা জঙ্গল ছেড়ে নেমে এসেছে খালে।
এই তোমরা নৌকায় উঠো। বলতেই ঝটপট আমার নৌকায় উঠে পড়লো তারা। বাঘের ভয় আর শীত মিলিয়ে বেহাল অবস্থা তাদের। চলতে চলতে মনে পড়লো ডেরায় পৌঁছে তাদের বিচার হবে। অস্ত্র রেখে ঘুমিয়ে পড়ার অপরাধ। সেটি নিয়েও মহা দুশ্চিন্তায় ওরা।
খালের অন্য মাথায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। এদিকে পানি আসেনি এখনও। ট্রলার দুটি কাদায় আটকানো। বাকী নৌকাগুলোরও একই অবস্থা। সাথে আরও দুটি জেলে নৌকা যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে বিশাল বহর।
বড় সুমন বাহিনীর নেতা আছেন বিশ্রামে। পাশে তার ভাই রিপন শরীফ বসা। হাতের অস্ত্র লোড করা। অন্য দস্যুরা যে যার মতো সময় কাটাচ্ছে। কেউ বসে আছে, কেউ বা দাঁড়িয়ে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক খুঁজছে। আমাদের দেখে সবাই নড়েচড়ে বসলো। দস্যুনেতা উঠে বললো, আপনাদের নিয়ে টেনশনে ছিলাম ভাই। একটা বাঘ আমাদের চারপাশে ঘুরছে। মনে হয় আমাদের টার্গেট করেছে। বললাম, তাহলে আমাদের এখানে থাকা ঠিক হবে? আমার কথা শুনে সর্দার বললেন, এতো মানুষের মধ্যে বাঘ আসবে না ভাই।
বাঘ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিবো না আমি। কখনও ইচ্ছা করে এবিষয়ে ঝুঁকি নেইনি। বাঘ নিয়ে কখনও উদাসীন হইনি। যেখানে বাঘের আনাগোণা থাকে সেই জায়গা এড়িয়ে চলা আমার অভ্যাস। শুরু থেকে মামাকে এড়িয়ে চলি আমি। গত ভোর থেকে এই জায়গাটি থমথমে হয়ে আছে। সর্দার বলছিলেন যে জঙ্গলটা ভারী ভারী লাগছে। বাঘ থাকলে যে আলামতগুলো থাকে তার সবই আছে এখানে। অন্যরা পাত্তা না দিলেও ভাবছি এই জোয়ারে জায়গা বদল করবো।
একজন চা নিয়ে আসলো। অন্ধকার বলে কাপের দিকে খেয়াল করিনি। মুখে দিলাম। রীতিমতো চমকে উঠলাম। সেই জঙ্গলের চা! মানে কড়া লিকার। মামুনকে ডাক দিলাম। বললাম, একটু দুধ চা বানাও। শরীরটা ভালো লাগছে না। চারপাশ অন্ধকার কেন? বাতি জ্বালাও। মামুন বললো, ডাকাতরা আলো জ্বালাতে না করলো ভাই।
সন্ধ্যার পর সুন্দরবনে আলো জ্বালানো নিয়ে কিছু নিয়ম আছে। সাধারণ জেলে হোক বা বনদস্যু, কেউই নৌকা-ট্রলারে বাতি জ্বালিয়ে রাখে না। প্রয়োজনের সময় ছোট করে টর্চ জ্বালায়। কাজ শেষ হলে আবার নিভিয়ে দেয়। চা জ্বালানো হয় যে চুলায় তা থাকে নৌকার খোলের ভিতর। আড়াল করা থাকে যাতে বাইরে থেকে আগুন দেখা না যায়। আমি বললাম, আমরা আছি যখন তখন আর সমস্যা নাই। আমাদের ট্রলারের ভিতরের কেবিনের বাতিটা জ্বালাও। এতো অন্ধকার ভালো লাগছে না।
আলো জ্বললো। টর্চ হাতে এগিয়ে গেলাম বেন্দী জালের নৌকায়। মাছগুলো দেখতে হবে। কিছু মাছ কিনবো আমরা। রাতের খাবার হবে এই মাছ দিয়েই। জামাল শরীফের নির্দেশে একজন বনদস্যু এগিয়ে এলো, সাথে আলমগীর। নৌকার পাটাতন খুলে মাছ বাছতে বসলো জেলেরা।
চাকা চিংড়ি, চালি চিংড়ি, বাগদা, গলদা মিলিয়ে ভরে আছে নৌকার খোল। কিছু কুচিয়া আর সাপ আছে। বড় কোনো মাছ নাই। কিছু দাতিনা আর পাতাড়ি আছে। সেগুলো কেজি সাইজ হবে। কাউইন মাছগুলোও ছোট ছোট। আসলে বনের ভিতরে বেন্দী জালে মূলত চিংড়ি মাছই ধরা পড়ে।
জেলেদের সাথে হাত মিলালো কয়েকজন দস্যু। পাশে আলমগীরও বসে পড়লো। গলদা মাছগুলো আলাদা করছে সে।
সর্দার বললেন, ও ভাই, জালে দেখি চান্দা মাছের ঝাঁকও উঠছে। ফিস ফ্রাই খাবেন নাকি? টাটকা মাছ। ভালো লাগবে! ক্ষুধা পেটে সেটা ফিরাই কী করে? সাথে সাথে উনিও নেমে পড়লেন নৌকায়। চান্দা মাছগুলো বেছে নেওয়া হলো। তারপর সর্দার চলে গেলেন তার কাজে। গলদা চিংড়িগুলো বেছে আলাদা করলো অন্যরা। সব মিলিয়ে কেজি দশ হবে। জেলে ভাইকে বললাম, মাছের দাম কতো দিবো?
সাথে সাথে দৌড়ে আসলো দস্যুনেতা। বললো, আমাদের এখানে এসে মাছ কিনবেন মানে? বললাম, আমি তো সব সময় জেলেদের কাছ থেকে মাছ কিনে নেই। এনিয়ে আপনার টেনশন করতে হবে না। দস্যুনেতা বললেন, এটা কেমন কথা ভাই? দাম দিলে আমরা দিবো। বললাম, আপনাদের টাকায় জেলেদের রক্ত লেগে আছে। আর আমাদের বাজেট আছে। অফিস আমাদের সব খরচ দেয়।
দস্যুনেতাকে ফিরালাম। তারপর দেখি পাশে এসে দাঁড়ালো আলমগীর। তাকে উপেক্ষা করে জেলেদের কাছে গেলাম। তারা মাছ বাছাবাছি করছে। মানিব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বের করে আলমগীরের হাতে দিলাম। এবার সে বলে, টাকা দেওয়া লাগবে না ভাই। এটা আমি খাওয়াই। বললাম, আপনি কেন খাওয়াবেন? এবার সে বললো, ওরা আমার জেলে। মাছগুলো আমারই।
এতোক্ষণে বুঝলাম। সুন্দরবনের এই অংশে তার মাছের ব্যবসা আছে তা নিশ্চিত হলাম। একই সাথে বড় সুমন বাহিনীর সাথে তার খাতিরের কারণটাও বুঝলাম। বনদস্যুরা তাদের বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীদের মাছ ধরার সুযোগ দেয়। জাল নৌকা অনুযায়ী চাঁদা দিতে হয়। তবে বিশ্বস্ত না হলে চলবে না।
এই ব্যবসায়ীরাই দস্যুদের লোক। মানে আমরা যাদের বলি বনদস্যুদের লোকাল গডফাদার। আলমগীর তেমনই একজন। একই সাথে সে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীরও সোর্স। থাকে মংলায়। সুন্দরবন উপকূল জুড়ে বেশ কয়েকজন সোর্স আছে আমার। তার মধ্যে অন্যতম সে।
আলমগীরের এই পরিচয় এতোদিন গোপন ছিলো। মানে আমার জানা ছিলো না। সেও বলেনি। বিকালে জেলেদের সাথে দেখা না হলে জানতেও পারতাম না। আমি যে সব বুঝে গেছি তা আলমগীরকে বুঝতে দিলাম না। বললাম, আমার সফরকালের সব খরচ অফিস দেয় ভাই। আপনি বরং টাকাটা জেলেদের নিতে বলেন।
চিংড়ি মাছের দাম দিলাম। তবে চান্দা মাছের দাম নিলো না তারা। মাছ বাছতে বাছতে জেলেরা বললো, ভরের নৌকা আসবে রাতে। মাছগুলো বড়ফে না দিলে নষ্ট হয়ে যাবে। বললাম, দস্যুদের আস্তানা থেকে তো সহজে ছাড়া যাবে না ভাই। তবে আমি দেখছি কী করা যায়।
ট্রলার থেকে ডাক দিলেন সর্দার। হাতে গামলা ভর্তি চান্দা মাছের ভাজা। সাথে শুকনা মরিচ ভাজা। পেঁয়াজ, রসুন আর সরিষার তেল দিয়ে আরেক গামলায় মাখানো মচমচে মুড়ি। মুড়িটা বেশ ভালো লাগছে। আলমগীর বললো, তার মায়ের হাতে ভাজা মুড়ি। দেশি মুড়ি।
মাছ ভাজার সাথে মুড়ি। অনন্য এক খাবার। সুন্দরবনের বৈরী পরিবেশে নৌকায় বসে এই নাস্তার তুলনা হয় না। সর্দার বললেন, কীরাম হলো ভাই? হাসতে হাসতে বললাম, খুব ভালো। সর্দার বললেন, আপনি চা খেয়ে একটু দম নেন। আমি রাতের খাবার চড়াই। বললাম, রাতের রান্না ওরাই করুক। আপনিও একটু বিশ্রাম নেন।
কথা বলতে বলতে সর্দার ট্রলার থেকে নামলেন। এগিয়ে গেলেন জেলেদের নৌকার দিকে। খোলের ভিতরে টর্চ মেরে বললেন, খোল ভর্তি কুমিরের বাচ্চা ভাই। নানা ঘটনায় কুমির ছানাদের কথা ভুলে গেছিলাম। বললাম, ওদের ছেড়ে দেন ভাই। সর্দার বললেন, এই ছোট খালে ওদের ছাড়া যাবে না। যেখানে জালে বাধলো সেই খালে গিয়ে ছাড়বোনে!
রাত নামলো। চারপাশ এখনও নিরব হয়ে আছে। একদম ভুতুড়ে অবস্থা! অর্ধেক জোয়ারে পানি এসেছে খালে। নৌকাগুলো ভাসলো। পাহাড়া দিতে দুজন দস্যুকে পাঠানো হলো খালের মাথায়। তারপর বিকালের দুই পাহাড়াদারকে নিয়ে বিচার বসলো। পাহাড়ায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার শাস্তি হবে। কিন্তু কী শাস্তি দেওয়া হবে তা বুঝতে পারছি না। অস্ত্র হাতছাড়া হওয়ার জন্যই নাকী শাস্তি হবে। পাশের ট্রলারে বসেছে বিচার। পাশে বসে আমি শুনছি তাদের কথাবার্তা। চোখ জুড়ে ঘুম আসছে। কিন্তু কিছুতেই ঘুমাবো না আমি। এমন সময়ে ঘুমানো যায় না। যতো কষ্টই হোক, জেগে থাকতে হবে।
বসে বসে ভাবছি সারাদিনের ঘটনা। দস্যুদের আত্মসমর্পণ নিয়ে কাজ করছি। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে কতো কিছু দেখছি। বিপন্ন মানুষগুলোর কথা ভাবছি। দেখছি জেলেদের পাশাপাশি বিপন্ন বনদস্যুরাও। এই জঙ্গলও বিপন্ন নানা কারণে। অথচ সুন্দরবনকে নিয়ে আমরা কতো কিছু ভাবি। সুন্দরবন রক্ষায় কতো কথা বলি!
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)