রূপান্তরের গল্প ৩৪৫ | Rupantorer Golpo 345

দস্যুদের ডেরায় গোলাগুলি, পালিয়ে আসলো জেলেরা | রূপান্তরের গল্প ৩৪৫

দস্যুদের ডেরায় গোলাগুলি, পালিয়ে আসলো জেলেরা | রূপান্তরের গল্প ৩৪৫ | Rupantorer Golpo 345 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৪৫ : ক্লান্তিতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মুখে চর পড়ে গেছে। শেষ ভাটায় এক রকম মরা খালে পরিণত হয়েছে বিশাল এই খাল। ঘুম ভাঙ্গলো ডাকাডাকিতে। চোখ মেলে দেখি পাশের চরে বিশাল এক কুমির বসা। হা করে রোদ পোহাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কাদার মধ্যে বড়সড় একটি মরা কাঠ। জেলেরা বললো, সারা রাত মাছ শিকার করে সকালের ভাটায় চরে এসে বিশ্রাম নেয় কুমির। এই কুমিরটি প্রতিদিন এখানে আসে। এই খালে আরও কয়েকটি কুমির দেখা যায়।

কুমিরটির ছবি তুললাম। এর মধ্যে সহযাত্রীরা উঠলো। বিশাল দেহী কুমিরটি আমাদের শোরগোল শুনে বিরক্ত হলো। নেমে পড়লো খালে। মুহুর্তে হারিয়ে গেলো। জলের এই বন্যপ্রাণিটি দৈর্ঘ-প্রস্থে জেলেদের ডিঙ্গি নৌকার চেয়ে বড়। তাদের ভয় লাগে না? আক্রমণ করে না? জেলেরা বললো, সাধারণত আক্রমণ করে না। কুমির যদি ঝামেলা করতো তাহলে আমরা জঙ্গলে নামতেও পারতাম না।

আমাদের চারপাশে চর। রাতের বেলা যেখানে নোঙ্গর করলাম সেখানে কোনো পানি নাই। একটু দূরে খাঁড়ি। ওদিকে একটু পানি আছে। এদিকে সর্দার ঘুম থেকে উঠলেন। হাতমুখ ধুতে ধুতে বললেন, আমরা যাবো না ভাই? বললাম, ট্রলার না ভাসলে যাবো কী করে? জোয়ার আসুক। তারপর রওনা দিবো। সর্দার বললেন, তাহলে তো রান্নাবান্না করা লাগে।

এখানে আমাদের আরও ঘন্টা দুই অপেক্ষা করতে হবে। সর্দার গিয়ে বসলেন রান্নাঘরে। জেলেদের দুইজনকে নিয়ে আমরা নেমে পড়লাম। কোমড় সমান কাদা। কোনো রকমে হাঁচড়ে পাঁচড়ে এগিয়ে চললাম ওই খাঁড়ির দিকে। সাথে ঝাঁকি জাল।

মাছে মাছে ভরপুর এই খাল। চিংড়ি আর পারশে মাছের ঝাঁক! ভীষণ ভালো লাগছে দেখতে। আমরা জাল দিয়ে টানা দিলাম। কাদা পানি এখানে সমান সমান। মাছ ধরতে ধরতে কাদায় লুটোপুটি খেলাম। খুব ভালো লাগছে। রান্না চড়িয়ে সর্দার এসে যোগ দিলেন। মাছের ব্যাগ হাতে নিয়ে বললেন, এগুলো তো সব নারী নির্যাতন মাছ!

গত দুই দিনের পরিবেশ বেশ গুমোট ছিলো। দস্যুদের সাথে থাকলে দুশ্চিন্তা থাকেই। তাই সকাল সকাল মুক্ত পরিবেশটা ভালো লাগছে। আমাদের কাদায় লুটোপুটি করতে দেখে ট্রলার থেকে অন্যরাও নামলো। সর্দার বললেন, যে মাছ ধরলেন, তা বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। এগুলো নিলে ভাবী মারতে পারে। বললাম, মাছগুলো আমরা পরের বেলায় খাবো। সর্দার বললেন, ও আমি বাছতে পারবো না ভাই।

আধা ঘন্টা মাছ ধরে ফিরতি পথ ধরলাম। জোয়ার চলে এসেছে। বড় নদী থেকে ঢুকছে পানি। আমরা ট্রলারে ফিরলাম। কাদা ধুয়ে উঠলাম। ট্রলারে রাখা মিঠা পানি দিয়ে গোসল করলাম। ভাতের সাথে পাতলা ডাল আর চিংড়ি ভুনা। পাঁচ মিশালী চিংড়ির সেই স্বাদের তুলনা হয় না।

ভরপেট খেয়ে চায়ের অপেক্ষা করছি। গলুইয়ে বসে চারপাশটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। জোয়ারের পানি বাড়ছে। বদলে যাচ্ছে চারপাশ। এতোক্ষণ জঙ্গলের কিনার ধরে কিছু হরিণ ঘুরছিলো। পানি বাড়ছে বলে তারাও ভিতরে ঢুকে গেলো। কয়েকটি বন্যশুকর আর বানর এখনও ঘুরছে-ফিরছে। এতো কিছুর ফাঁক গলিয়ে কিছু মানুষ দেখছি। জঙ্গলের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। ওদের দৃষ্টি আমাদের দিকে।

বেলায়েত ভাই, ওরা কারা দেখেন তো? ইঞ্জিন রুম থেকে বেরিয়ে কাছে আসলেন তিনি। মামুন আসলো চা নিয়ে। তারপর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এরা কালকের জেলেরা মনে হচ্ছে! বলেই ওদের ডাক দিলেন সর্দার। বললেন, এই কারা তোমরা? চোরের মতো লুকায়ে আছো কেন? সামনে আসো!

একে একে তিনজন বের হলো। গা ভর্তি কাদা। জামা কাপড় শতচ্ছিন্ন। মনে হয় জঙ্গলে দৌড়াতে গিয়ে ছিঁড়েছে। আরও কাছে আসতেই চিনলাম ওদের। বড় সুমন বাহিনীর হাতে জিম্মি ছিলো তারা। মানে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের ধরে রাখছিলো। কিন্তু ওরা এখানে কেন?

হাত ধরে ট্রলারে টেনে তুললাম ওদের। বললাম, হাত-মুখ নেন। মামুনকে বললাম, ওদের খেতে দাও। রীতিমতো হাঁসফাঁস করছে ওরা। একটু দম নিয়ে বসলো। খাবার আসলো। গপগপ করে ভাতগুলো খেয়ে ফেললো। মামুনকে বললাম, আবার ভাত উঠাও। ওদের ক্ষুধা মিটেনি।

জেলেদের হাত পা কেটে-ছিঁড়ে গেছে। বললো, জীবনটা নিয়ে কোনো রকমে পালাইছি ভাই। কোনো রকমে জীবনটা বাঁচছে। ওরা একটু স্থির হয়েছে। বড় বিপদ থেকে বের হয়ে একটা আশ্রয় পেয়েছে। জানতে চাইলাম বিস্তারিত।

তিনজনের মধ্যে একজনের বয়স বড়জোর ১৮ হবে। বাকী দুইজন ত্রিশের কোঠায়। তাদের একজন বললো, রাতে আমাদের বিদায় দিয়ে দস্যুদের বহর চলে যায় পূর্ব দিকে। কয়েকটা খাল পাড়ি দিয়ে তারা চরাপূঁটিয়ার ভাড়ানির দিকে রওনা দেয়। কিন্তু ওই ভাড়ানীটা বেশ সরু। তার উপর ভাটার কারণে আটকে যায় তাদের সাথে থাকা ট্রলার। ভোরবেলা উল্টা দিক দিয়ে দুটি ছোট নৌকা নিয়ে আরেক পার্টি আসছিলো। দুই বাহিনী মুখোমুখি হলো। গোলাগুলি হলো। আমরা এই সুযোগে জঙ্গলে নেমে পলান দিলাম। তার মানে ভোরবেলা এদের গোলাগুলির শব্দ শুনেছি!

একজন বললো, পালিয়ে জঙ্গল দিয়ে হাঁটছি। এদিকে আসছি কারণ পশুর বাওনে আসতে পারলেই নৌকা-ট্রলার পাওয়া যাবে। তারপর একটার পর একটা খাল পাড়ি দিলাম। ভোরবেলা আসছি এখানে। এসেই দেখি আপনারা।

বললাম, তাহলে ভোরবেলা আমাদের কাছে আসলেন না কেন? একজন বললো, আপনাদের কাছে আসলে যদি আবার ডাকাতদের হাতে তুলে দেন? কথাটা শুনে একটু থমকে গেলাম। তারপর ভাবলাম, সত্যিই তো। আমরা বনদস্যুদের অতিথি ছিলাম। বিশ্বাস করবে কী করে? মনের কথা মনে রাখলাম। বললাম, যাক অসুবিধা নাই। তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিবো।

বেশ আশ্বস্ত হলো জেলেরা। সাথে সাথে উঠে পড়লো। পেছনে গিয়ে রান্নাঘরের সামনে বসলো। কড়া লিকারের চা খেয়ে ইঞ্জিন রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। ক্লান্ত শরীরগুলো আর চলছে না। ওরা ঘুমাক, আমরা রওনা দেই।

জোয়ার প্রায় দুই ঘণ্টা হলো। ট্রলার ভাসবে আরেকটু পর। সাথের জেলে নৌকাগুলো বিদায় নিলো। আমরা গোছগাছ করছি। ভাসলেই রওনা দিবো। এসময় সামনে থেকে সর্দারের ডাক। ও ভাই, একটা জিনিষ দেখে যান!

গেলো রাতে জেলেরা একটি টুকরি দিয়েছিলো। ভেবেছিলাম মাছ। ট্রলার গোছাতে গিয়ে দেখা গেলো তার ভিতরে তিনটি কুমির ছানা। প্লাস্টিকের সূতা দিয়ে বাঁধা। কী আশ্চর্য! এগুলো রাতে ছাড়া হয়নি? সর্দারকে বললেন, এগুলো আপনাকে উপহার হিসাবে দিছে ওরা। বললাম, উপহার দেওয়ার আর জিনিস পায়নি? সর্দার বললেন, মাছ দিতে চাইলো। আপনি তো নিলেন না। তাই কুমিরের বাচ্চা দিছে।
কুমির ছানাগুলোকে মুক্ত করা হলো। তারপর ছেড়ে দিলাম খালে। এর মধ্যে ট্রলার ভাসলো। ইঞ্জিন চালু হলো। আমরা রওনা দিলাম মংলার উদ্দেশ্যে।

ঘসিয়াঙ্গাড়ী খাল থেকে পশুর নদীতে পড়তে সময় লাগলো দশ মিনিট। উল্টো পাশে পাশাখালী ফরেস্ট অফিস। বড় নদীতে পড়তেই সর্দার বললেন, একটু পাশাখালী যাবেন ভাই? আমিও মনে মনে ভাবছিলাম সে কথা। এছাড়া দিনের বেলা সুন্দরবন থেকে ফেরা একটু ঝুঁকির। বললাম, পশুর পাড়ি দেন। পাশাখালী চলেন। অনেক দিন যাই না!

(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top