বনদস্যুদের সরাইখানা- পাশাখালী | রূপান্তরের গল্প ৩৪৬ | Rupantorer Golpo 346 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৪৬ : পশুরে পড়তেই দুলে উঠলো ট্রলার। ঘসিয়াঙ্গাড়ীর মুখে বড় নদীর এই জায়গাটি একটু উত্তাল থাকে। এমনিতেই স্রোত থাকে বেশি। তার উপর বাতাস বাড়লে ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করে জায়গাটি। পশুর নদীর দুই পাশের খালের মুখগুলো এমনই। সেই সেলা নদীর মুখ থেকে আলোর কোল পর্যন্ত কয়েকটি জায়গার পানি বেশ গরম। মানে স্রোত আর ঢেউ মিলিয়ে জায়গাগুলো উত্তাল থাকে।
আমরা যাচ্ছি পাশাখালী। ছোট্ট একটি খাল। তার মুখে আছে বন বিভাগের একটি টহল ফাঁড়ী। কৌশলগত দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেকারণেই ফরেস্ট অফিসটি করা। পশুর নদীর এপাশ ওপাশ মিলিয়ে কাছাকাছি আর কোনো অফিস নাই। পশ্চিমে শিবসার বাওনে আছে আদাচাই। পূর্ব দিকে ভদ্রা অফিসটি সবচেয়ে কাছের। তার উত্তরে ছিলো ঝাপসি। বনদস্যুদের উৎপাতে অফিসটি বন্ধ। একই কারণে হংসরাজের মাইটে, সেলা নদীর মৃগামারী, পশ্চিম সুন্দরবনের হরিণটানা অফিসও বন্ধ। হরিণটানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করেছিলো বনদস্যুরা। এরপর থেকে দূরবর্তী বন টহল ফাঁড়ীগুলোতে অস্ত্র রাখা হয় না। পাশাখালীরও একই অবস্থা।
ভাবছি মধ্য সুন্দরবনের পাশাখালী অফিসটি কেন চালু রেখেছে বন বিভাগ? এখানে প্রথম এসেছি বনদস্যুদের সাথে। তারপর যতোবার এসেছি প্রতিবারই দস্যুদের পেয়েছি। বন বিভাগের দুই-চারজন কর্মী থাকেন। নিরস্ত্র অবস্থায় তাদের অসহায় চিত্র দেখে অভ্যস্ত আমরা। বনদস্যুরা ওখানে আসে, থাকে, পানি নেয়, খায় দায় তারপর চলে যায়। এক বাহিনী গেলে আরেক বাহিনী আসে। মনে হয় যেন বনদস্যুদের সরাইখানা এই পাশাখালী।
হঠাৎ বাতাস ছেড়েছে। ট্রলার নিয়ে নদী পাড়ি দিতে মনে হয় ঝামেলা হবে। আমি ডের এর উপর বসে। সর্দার শক্ত হাতে সুকানি ধরেছেন, উল্টা পাল্টা ঢেউ সামলে আগানোর চেষ্টা করছেন। মধ্য সুন্দরবনের বড় খালের মুখগুলো পার হয়ে উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া খুব কঠিন না। কিন্তু আমরা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছি। ঢেউগুলো ট্রলারের বুকে বাঁধাতে না পারলে বিপদ। সর্দার বললেন, তুফানে আইড়ো বাড়ি দিচ্ছে ভাই। বাতাস না কমলে পার হওয়া যাবে না। বললাম, এখন পার হতেই হবে কে বললো? দিনটা কাটাতে হবে এদিকে। পাশাখালী যেতে না পারলে পশুরের পূর্ব দিকের কোনো খালে ঢোকেন।
সর্দারের মনে হয় মাথায় জিদ চেপেছে। ঢেউগুলোর সাথে খেলছেন তিনি। এদিকে আমাদের অবস্থা খারাপ। ঢেউগুলো আড়াআড়ি বাড়ি খাচ্ছে। ট্রলারের ভিতরটা ভিজে গেছে নদীর লবণ পানিতে। মামুন আর শহীদুল কাকু গলুইয়ে বসা। ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে ট্রলার।
পশুর ধরে আরেকটু দক্ষিণে নামলাম। কয়েকটি ছোট খাল আছে এদিকে। আরেকটু দক্ষিণে নামলে চার-গাঙ। পশুরের সাথে শিবসা মিলেছে এখানে। নদী গরম হলে এই জায়গাটি থাকে সবচেয়ে বেশি উত্তাল। কোনো রকমে জায়গাটি পার হলে পড়বে কোকিলমনির খাল। তারপর তিনকোণা দ্বীপ। দ্বীপের দক্ষিণের খালটি পার হলে বামে অর্থাৎ পূর্ব দিকে চলে গেছে অফিস খাল। নামে খাল হলেও সেটি দেশের বড় নদীগুলোকেও হার মানাবে। এই খালটির মুখে একপাশ থেকে আরেক পাশে যেতে সময় লাগে আধা ঘণ্টা। বাতাস একটু বৈরী হলে এই জায়গা অতিক্রম করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই জেলেরা এর নাম দিয়েছে আগুন জ্বলার মুখ।
আমরা অতোদূর যাবো না। নদীর গতিবিধি বুঝে সর্দার ঢুকে পড়বেন মাঝ পশুরে। তারপর যা হয় হবে। মানে ঢেউ আর স্রোতের সাথে যুদ্ধ করে পৌঁছে যাবেন ওপাশে। পশুরের পশ্চিম দিকটা বেশ ঠান্ডা দেখাচ্ছে। কারণ বাতাস বইছে ওদিক থেকে। উত্তর পশ্চিমের বাতাসের ধাক্কায় টালমাটাল হয়েছে নদীর পূর্ব পাশ।
নদী সাগরে চলার সময় আমি সর্দারের উপর ভরসা করি। দিনের বেলায় সাহসটা বেশি থাকে। মনে হয় বিপদ হলেও সামলে নিতে পারবো। যদিও এখন পর্যন্ত ট্রলার ডুবির মতো দুর্ঘটনায় পড়িনি। সর্দার বললেন, সামনে খালি তেলের ড্রাম আছে। ঝামেলা হলে ওইটা ধরে ভেসে থাকবেন। বললাম, সে চিন্তা মাথায় আছে। আপনি পার হন।
মিনিট পনেরো পর বাতাস একটু কমলো। ইঞ্জিনের গতি বাড়লো। ট্রলার ছুটলো মাঝ পশুরে। প্রায় আধা ঘণ্টা ঢেউয়ের সাথে লড়াই করে আমরা বড় নদীর উল্টোপাশে পৌঁছালাম। তারপর ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম পাশাখালী।
অফিসের সামনে কোনো নৌকা বা ট্রলার নাই। একটু ভিতরে কাঠের জেটি। কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা। কোনো লোকজন নাই। খালের ভিতরে আমরা। অফিসের পিছনে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি দেখছি। সম্ভবত জেলে।
জেটিতে ট্রলার বেঁধে নামলাম। নামলাম। সর্দার বললেন, আপনি নামেন। আমি একটু রান্না চড়াই। দুপুরে খাওয়া লাগবে তো! শহীদুল কাকুকে নিয়ে নেমে পড়লাম। কাঠের তৈরি জেটিটির বেহাল দশা। কোনো রকমে পার হয়ে ডাঙ্গায় উঠলাম। তারপর শুরু হাঁটা পথ। হেঁতাল গাছ দিয়ে তৈরি চলার পথটি আমার পরিচিত। সোজা পথটি চলে গেছে অফিসে। ডানপাশের পথটি গেছে পুকুর পাড়ে। দুটি পুকুর আছে। তার একটি গোগোসলের জন্য, আরেকটি খাওয়ার পানির। ওদিকে বাঘের আনাগোণা আছে। মাঝে মাঝেই আসেন উনারা। তাই একা একা ওই পুকুর পাড়ে যাওয়ার নিয়ম নাই।
সোজা হেঁটে অফিসের সামনে গেলাম। ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া পেলাম না। ভিতরে কেউ নাই। তারপর ফিরে ডানপাশের রাস্তা ধরলাম। পুকুর পাড়ে বসা দুজন ফরেস্টার। ইউনিফরম না থাকলেও তাদের চিনতে সমস্যা হলো না। সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে ভুত দেখার মতো অবস্থা তাদের। অফিসে আপাতত দুজনই আছেন। ওসি সাহেব খুলনা গেছেন মামলার সাক্ষী দিতে। আরই তিনজন ছুটিতে আছেন। সব মিলিয়ে ছয়জন বনরক্ষী এখানে। সাথে কোনো অস্ত্র নাই।
পরিচয় দিলাম। তারপর উনাদের সাথে হেঁটে ফিরলাম অফিসে। ভাঙ্গা ভবনের দরজাটি খোলা। পরিস্থিতি ঠিক বুঝতে পারছি না। বললাম, আমরা আসতেই কারা যেন পালিয়ে গেলো। অফিসের পিছন দিয়ে দৌড় দিলো। কারা ওরা? একজন বললো, মনে হয় কাঁকড়ার জেলে! বললাম, জেলেরা পালাবে কেন? বললেন, ভয় পাইছে মনে হয়। বললাম, আপনারা অফিস ছেড়ে পুকুর পাড়ে কেন?
বনরক্ষীরা উত্তর দিলেন না। বুঝতে পারছি ঝামেলা আছে। হুট করে জানতে চাইলাম, জাহাঙ্গীর আসছিলো নাকি নোয়া মিয়া? পাশের জন উত্তর দিলেন, অতো চিনি না। মনে হয় নোয়া বাহিনী। বললাম, সেটা বললেই হয়। এখানে ডাকাতরা আসে তা তো জানিই।
বনরক্ষীরা ঠিক বুঝতে পারছেন না। আমাদের কাজ সম্পর্কেও ধারণা নাই। দুজনই নতুন সুন্দরবনে। প্রথম জন বললেন, আপনি যেই হন, এখান থেকে চলে যান। এখানে সমস্যা আছে। বললাম, সুন্দরবনের এই সমস্যাটাকেই তো খুঁজছি। আপনারা খোলামেলা কথা বলতে পারেন। আমার সাথে নোয়া মিয়ার যোগাযোগ আছে। পুকুর পাড়ে নির্দিষ্ট জায়গায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। সেখানে গিয়ে ফোন করলাম। ওরা নেটওয়ার্কে নাই। ফিরতি কল করতে পারে ভেবে সেখানেই ফোন ঝুলিয়ে রাখলাম।
রান্না তুলে দিয়ে সর্দার আসলেন। সাথে আমার গামছা, লুঙ্গি আর শ্যাম্পু। গোসলে নামলাম। বড় পুকুরটির পানি একটু নোন্তা। এই পুকুরের নিচে বনদস্যু মাস্টার বাহিনীর অস্ত্র লুকানো ছিলো। চারপাশটা উঁচু করে বাঁধা। পাশের জঙ্গল পরিস্কার করা। ফলে বাঘ আসলে হুট করে আক্রমণ করতে পারবে না। এর পরের জঙ্গলটি গড়ানের। ভিতরের কিছুই দেখা যায় না। জঙ্গলের পর সরু খাল। সেটিই পাশাখালী। ওই খাল ধরে পশ্চিম সুন্দরবনের যেকোনো জায়গায় যাওয়া যায়। নোয়া বাহিনীর যারা এখানে ছিলো তারা সম্ভবত ওদিকেই আছে।
লম্বা সময় ধরে গোসল করছি। বেশ হই হুল্লোড়ও চলছে। এমন সময় বনরক্ষীদের একজন এসে আমাদের উঠতে বললেন। কর্কষ ভাষায় অফিস ছাড়তে বললেন। বেশ অপ্রস্তুত হলাম। উঠে গা মুছতে মুছতে ফোন বেজে উঠলো।
ওপাশে দস্যুনেতা নোয়া মিয়া। ঝুলানো ফোনে লাউড স্পিকারে কথা হচ্ছে। সালাম দিয়ে দস্যুনেতা বললো, ও ভাই, আপনি আসবেন বলবেন না? আমরা তো ভাবলাম প্রশাসনের লোক! একটু পানি আনতে গেলাম গত রাতে। ভাবছিলাম দুই দিন থাকবো অফিসে। আপনারা এসে আমাদের তাড়ায়ে দিলেন! বললাম, ফেরত আসেন। দেখা হয় না অনেক দিন!
দস্যুনেতার সাথে কথোপকথন দেখে বনরক্ষীর চোখ কপালে উঠেছে। এক দৃষ্টিতে দেখছেন। এর মধ্যে নোয়া মিয়া বললো, একটু দূরে চলে আসছি আমরা। না হলে আসতাম। আপনারা থাকেন। আমি ফরেস্টের লোকজনদের বলে দিচ্ছি। বললাম, ফরেস্টের এক ভাই পাশেই আছেন। ফোনে নোয়া মিয়া বললেন, মোহসীন ভাই আসছে। উনারা আমার মেহমান। আপ্যায়ন যা করা লাগে করেন। আমি বিকাশে টাকা পাঠায়ে দিবো!
বললাম, আমাদের আপ্যায়ন করা লাগবে না। আপনারা দেখা করলে বলবেন। সারেন্ডার কিন্তু করতেই হবে। হাতে সময় নাই। তারপর নতুন করে পুরনো কথাগুলো বলে ফোন রাখলো দস্যুনেতা। আমরা এসেছি ঘন্টা দুই। ওরা এতোক্ষণে নিশানখালী বা আদাচাইয়ের ওদিকে গেছে।
সবাইকে নিয়ে হাঁটা দিলাম। অফিসের সামনে এসে বনরক্ষী ভাইকে বললাম, আমরা এসে আপনাদের ঝামেলায় ফেললাম। নদীর অবস্থা ভালো থাকলে এখনই যেতাম। আপাতত ট্রলারে আছি। রাতের জোয়ারে ফিরে যাবো। ভদ্রলোক এবার বেশ বিচলিত। বললেন, আপনারা যাবেন কেন? অফিসে আসেন। চা খান। রান্নার ব্যবস্থা করি।
অফিসের ভিতরে ঢুকতেই রান্নাঘর। সেখানে বড় পাতিল রাখা। পাশে রান্নার আয়োজন চলছিলো। তার মানে বনদস্যুরা এখানে রান্না করছিলো? একজন বনরক্ষী বললেন, ওরা দুই দিন ধরে এখানে। বড় বাহিনী। গত রাতে অফিসের ভিতরেই ছিলো। ওসি সাহেবের রুমটাও ওদের জন্য খুলে দিতে হলো। এমনিতে অসম্মান করে না। তবে ডাকাতরা আসলে আমরা বের হয়ে যাই। ট্রলার বা নৌকায় থাকি। কিছু করার নাই। ওরা সশস্ত্র আর সংখ্যায় বেশি। আর আমাদের হাত খালি! অবৈধ জেলে বা শিকারীদের তাড়া করবো সেই সুযোগই নাই। চাকরি করি বলে থাকতে হয়। এছাড়া এই অফিসে থাকা না থাকা সমান কথা!
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)