বড় কানছিঁড়ায় রাতের বিরতি | রূপান্তরের গল্প ৩৪৭ | Rupantorer Golpo 347 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৪৭ : নিস্তব্ধ দুপুর। খালের পানি ঠেকেছে তলানিতে। সার ভাটিতে এই পাশাখালীতে এক ফোঁটা পানিও থাকে না। আর এটাই এই অঞ্চলের সুবিধা। বলছি জলদস্যুদের সুবিধার কথা। পুরো জোয়ার ছাড়া এদিক দিয়ে নৌকা-ট্রলার ঢুকতে পারে না। তাই প্রশাসন বা অন্য কোনো দস্যুদল, যেই আসুক ওই বড় নদীতেই আটকে যাবে। তাই পাশাখালী তাদের জন্য নিরাপদ। তিন পাশে ঘন জঙ্গল লুকানোর পথ আরও সহজ করে দেয়।
ঘুঘু ডাকছে। ডাকছে নানা জাতের পাখি। ট্রলার ভেসে আছে কাদার উপর। সহযাত্রীরা বিশ্রাম নিচ্ছে। আমার শরীরও বিশ্রাম চায়। কিন্তু দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। নোয়া বাহিনী সরে গেছে। কিন্তু জাহাঙ্গীর বাহিনী আছে আসেপাশে। ওরা যদি এসে পড়ে তবে কী ঘটবে বলা যায় না। জাহাঙ্গীর আত্মসমর্পণ করবে না। কিন্তু দলের সদস্যরা করতে চায়। এনিয়ে দলের মধ্যে গন্ডগোল চলছে। ওরা আমার সাথে দেখা করতে চায়। তা নিয়ে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর আমার উপর ক্ষিপ্ত।
দুপুরের খাবারে আজ মজার একটা আইটেম ছিলো। চিংড়ি ভর্তা আর ওল বাউলা দিয়ে চিংড়ির তরকারি। সকালে তিনকোণা দ্বীপে ধরা ছোট মাছগুলো বনরক্ষীদের দিয়েছি। রাতে কী খাবো এখনও ঠিক হয়নি। ঘুমাতে যাওয়ার আগে সর্দার বললেন, জেলেদের সাথে দেখা না হলে রাতে ডাল ভাত খাওয়া লাগবে। জঙ্গল জীবনে দুই বেলার ভাতের কথা মাথায় রাখতে হয়। কারণ চাইলেই সুন্দরবনে কোনো কিছু পাওয়া যায় না।
বসে বসে সুন্দরবনের নিরবতা দেখছি। সত্যি বলতে এই জঙ্গলের সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টি নিরবতা। এমন পরিবেশে বনের গাছপালার আড়ালে ঘুরে বেড়ানো বন্যপ্রাণিদের হাঁটাচলা অনুভব করা যায়। বসে বসে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করছি। ওরা ঘুমাচ্ছে ঘুমাক। এখন চুপচাপ বসে থাকতেই ভালো লাগছে।
খালের ভিতর থেকে কথাবার্তা বলার শব্দ আসছে। কারা যেন আসছে। এদিকেই আসছে। মিনিট দশ পর ওদের দেখতে পেলাম। কাদার উপর নৌকা। কোমড় সমান কাদায় নেমে নৌকা ঠেলছে দুই জন। এক শিশু নৌকায় বসা। নৌকা ভিড়লো। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলো তারা।
কাঁকড়া শিকারী। নৌকাটি একটু বড়সড়। কথা বলে জানলাম, এটি তিন প্রজন্মের জেলে বহর। মানে নৌকায় বসা শিশুটি এসেছে বাবা ও দাদার সাথে। বাড়ি শান্তা বাজারে। সুন্দরবনের ঝাপসী থেকে নিশানখালী পর্যন্ত এলাকায় কাঁকড়া ধরে তারা।
এদিকে নাকী বনদস্যুরা থাকে? দেখছেন ওদের। জানতে চাইলাম। বিরক্তিসহ একজন উত্তর দিলো, জানি না। বললাম, পাশাখালীতে কাঁকড়া ধরেন আর ডাকাতদের খবর জানেন না? প্রবীন ব্যক্তিটি বললেন, চোর-ডাকাতের খবর আমরা রাখি না কাকা। বললাম, আপনারা তাদেরই লোক। এখন বলেন নোয়া মিয়ার লোক আপনারা? না কী নাটা জাহাঙ্গীরের? আর কোনো উত্তর দিলো না।
সুন্দরবনে জেলেরাই বনদস্যুদের টার্গেট। আবার কিছু জেলে দস্যুদের ঘনিষ্ঠ। এই জেলেরা নিঃসন্দেহে দস্যুদের লোক। মনে হচ্ছে আমাদের খোঁজ খবর নিতে এসেছে তারা। কোনো দস্যুদল পাঠিয়েছে। তা না হলে এই কাদা ঠেলে এখানে আসার কথা না। সে যাই হোক। ওদের কাছে কাঁকড়া আছে। রাতের খাবারের জন্য নিতে হবে।
সুন্দর করে ডাক দিলাম আবার। উত্তর দিলো না। এবার সুন্দরবনের কৌশল নিলাম। আবার ডাক দিলাম। এবার কড়া ভাষায়। বললাম, সুন্দর করে বলছি বলে পছন্দ হচ্ছে না? বলেই মামুনকে ডাক দিলাম। বললাম, একটু নামো তো। এরা কারা একটু দেখি! সাথে সাথে কাজ হলো। মুরুব্বি লোকটি বললেন, আসতেছি কাকা। হাতের কাজটুকু সেরে নেই।
মামুন এসে পাশে দাড়ালো। বললো, এরা তো শুধু কাঁকড়া ধরে না ভাই। শিকারও করে! বলেই নেমে গেলো সে। নৌকায় রাখা একটি বস্তা খুললো। বস্তা ভর্তি দড়ি। মানে হরিণ ধরার ফাঁদ। সাথে সাথে নৌকার দুইজন দৌড়ে পালালো। বসে রইলো ছোট্ট ছেলেটি। ভয়ে একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ছেলেটি। তাকে ট্রলারে ডেকে নিলাম। বললাম, তোমার কোনো ভয় নাই বাবা।
মুহুর্তের মধ্যে কতোকিছু ঘটে গেলো! জেলেদের নৌকার খোল ভর্তি কাঁকড়া। বললাম, থাক। হাত দেওয়ার দরকার নাই। শুধু ফাঁদের বস্তাটা নদীতে ফেলো। ফরেস্টাররা দেখলে নতুন ঝামেলা শুরু হবে। আমরা এ বেলা থাকবো। নতুন কোনো ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নাই।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। আধা জোয়ারেও খালে পানি উঠেনি। তার মানে এখান থেকে ট্রলার বের করতে করতে জোয়ার প্রায় শেষ হয়ে যাবে! তাহলে আমরা রাতে যাবো কী করে? মামুন বললো, উজান ঠেলে যেতে হবে। মরা গোন চলে। বেশি কষ্ট হবে না।
মরা গোন মানে মরা কাটাল। এসময় জোয়ার কিংবা ভাটায় স্রোত কম থাকে। সেই স্রোতের বিপরীতে চলা যায়। তবে বেশ সময় লাগে। এতো লম্বা রাস্তা উজান ঠেলা কষ্টকর।
জোয়ার ভাটার হিসাব মিলাতে বসলাম। এখন বাজে বিকাল চারটা। জোয়ার শেষ হবে আর ঘন্টা দুই পর। মানে ছয়টার দিকে জোয়ার শেষ হবে। ভাটা শুরু হবে তার পর পর। আমরা যদি ছয়টার মধ্যে রওনা দেই তবে মংলা পর্যন্ত পুরো পথ ভাটার স্রোত ঠেলতে হবে। যেতে সময় লাগবে প্রায় ৮ ঘণ্টা। অন্যদিকে ভাটা শেষ হবে রাত ১২টার দিকে। সেই জোয়ারে রওনা দিতে পারলে সহজেই যেতে পারবো। আপাতত রাতের জোয়ারে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে ট্রলার ভাসলে আমাদের এই খাল ছাড়তে হবে।
মামুন আমার জন্য চা নিয়ে আসলো। জেলেদের নৌকার ছেলেটিকে নাস্তা দিলাম। বেচারা বেশ দুশ্চিন্তায়। গল্প করতে করতে জানলাম, ওরা মূলত শিকার করে। ফাঁকে ফাঁকে এই নৌকা নিয়ে কাঁকড়া ধরে। শিকারের কাজে তারা ব্যবহার করে অন্য নৌকা। সাথে আরও লোকজন আছে। লোকালয়ে হরিণের মাংসের চাহিদা অনেক। কেজি প্রতি বিক্রি হয় ৪০০ টাকায়। তবে ব্যবসাটি তার বাবা বা দাদার না। এজন্য শান্তা বাজারের একজন দাদন দেয়। মানে হরিণ শিকারেরও মহাজন আছে?
এই জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে কতো কিছু দেখছি, কতো কিছুর সাক্ষী হচ্ছি! অবাক করা সব ঘটনা! মামুন বললো, দুবলার চর থেকে সামুদ্রিক কচ্ছপ আনে কিছু লোক। সেই কচ্ছপ বিক্রি হয় পাইকগাছায়। সেটারও দাদন আছে। তার মানে সুন্দরবনে শুধু জেলে মৌয়াল না, সব ধরণের অকাজেরও দাদন হয়! ছেলেটির বয়স আনুমানিক ১২-১৩ হবে। তাকে বললাম, তুমি অফিসের দিকে যাও। পিছনে তোমার বাপ-দাদারা লুকিয়ে আছে। তাদের ডেকে আনো। বলবে, ভয়ের কিছু নাই। ছেলেটি নামলো। রওনা দিলো অফিসের দিকে।
সর্দারের ঘুম ভাঙছে। হাত মুখ ধুয়ে সামনে এসে বসলেন। বললেন, যাবেন না ভাই? বললাম, ট্রলার তো কাদায়। যাবেন কী করে? এখনও ভাসেনি। ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা জানালাম। সর্দার বললেন, তাহলে রাতের রান্নার আয়োজন করতে হয়! বললাম ভাত, ডাল আর মরিচ ভর্তা করেন।
উঠতে গিয়ে সর্দারের নজর গেলো কাঁকড়ার নৌকার দিকে। বললাম, ওরা কাঁকড়া শিকারী। কিন্তু চা পায়ের কাঁকড়াও শিকার করে। দড়ির বস্তা ফেলে পালাইছে। সর্দার উঠে নৌকায় গেলেন। খোলের ভিতর থেকে এক ঝুড়ি কাঁকড়া নিলেন। তারপর ট্রলারে ফিরে মামুনকে সেগুলো কাটতে বললেন। আমি বললাম, মালিক ছাড়া কাঁকড়া নেওয়া কি ঠিক হলো ভাই?
সর্দার বললেন, চোরের কাছ থেকেও বলে নিতে হবে? বলেই কাঁকড়ার ঝুড়ি নিয়ে ট্রলারে উঠলেন। বললেন, ওরা ফিরলে হিসাব করে টাকা দিয়েন। আজকে কাঁকড়ার বার বা কিউ খাওয়াবো আপনাকে। বললাম, বার বি কিউ না ভাই, বার-বি-কিউ। সর্দার বললেন, ওই হলো! মসলা মাখায়ে পোড়ায়ে খাওয়ার নামই তো বার বা কিউ! ও আমরা অনেক খাই। আজকে আপনিও খাবেন।
জেটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন বনরক্ষী। বললেন, আমাদের ওসি সাহেব ফোন দিয়েছিলেন। আপনাদের চলে যেতে বলেছেন। বললাম, আমরা আসছি এটা উনাকে কে বললো? আপনারা? উনি বললেন, আমাদের তো জানানো দায়িত্ব। বললাম, খুব ভালো কথা। তো এখানে যে বনদস্যুরা আসে, থাকে সেগুলোও বলেন তো? এই নৌকাটি দেখেন। ওরা কাঁকড়া শিকারী। কিন্তু কোনো কাগজ-পত্র নাই। ওরা হরিণও শিকার করে। আপনাদের অফিসের চারপাশে শিকার চলে। সেই খবরগুলো স্যারদের দেন তো? সত্যি বলতে মেজাজটা একটু বিগড়ে গেছে। বনরক্ষীরা এমনিতে আমাদের সহযোগিতা করেন। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ অসহযোগিতাও করেন।
বিরক্তি নিয়ে বললাম, ট্রলার ভাসা থাকলে এখনই বের হতাম। চিন্তা করবেন না। একটু পরেই পাশাখালী ছাড়বো। চিন্তা করবেন না।
এরপর মুখ ছুটালেন বেলায়েত সর্দার। বললেন, আমরা যে কাজ করছি তার কোনো মূল্য দিলেন না! ডাকাত দল তো কাল রাতেও ছিলো। ফরেস্ট অফিস তো ওরাই দখল করে রাখে। তাদের তো চলে যেতে বলেননি। গেলো রাতে ওরা অফিসের ভিতরে ছিলো। জায়গায় বসে হরিণ মারছে ওরা। আপনাদের রান্নাঘরে রান্না হইছে। আমি সব খবর পাইছি। পুকুরের ওই পাড়ে হরিণের নাড়িভুড়ি পড়ে আছে এখনও। ওদের কিছু বলতে পারেন না। আমাদের নিয়ে পড়লেন। ভাই ভদ্রলোক বলে কিছু বলে না। তাই বলে আমরা চুপ থাকবো? এই জঙ্গলে কতো কিছু হয়। আজকেও আমরা খাওয়ার মাছ দিলাম! এক নাগাড়ে কথাগুলো বললেন সর্দার।
বেচারা বনরক্ষী একটু অপ্রস্তুত! বললেন, আমরা তো চাকরি করি ভাই। স্যাররা যা বলেন তাই করি। সর্দার বললেন, স্যাররা কি অফিসে চোর-ডাকাত পুষতে বলছেন? সর্দারকে থামালাম। বললাম, উনাদের এসব বলে লাভ নাই ভাই। আধা ঘন্টার মধ্যে ট্রলার ভাসবে। আমরা বের হয়ে যাবো। উনারা থাকুক। বনরক্ষী ভাইকে বললাম, আপনি অফিসে যান। আমরা চলে যাচ্ছি।
ট্রলার ভাসতে ভাসতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। এর মধ্যে সন্ধ্যা নামলো। এখনও কাঁকড়ার নৌকার লোকগুলো ফিরলো না। বাচ্চা ছেলেটা নৌকায় বসা। তাকে ডেকে কাঁকড়ার দাম দিলাম। তারপর লগি দিয়ে ঠেলে খাল থেকে ট্রলার বের করলো মামুন ও শহীদুল কাকা। পিছনে গিয়ে দেখি বড় সুমন বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা জেলেরা কাঁকড়া কাটাকুটি করছে।
বাতি নিভলো ট্রলারের। ট্রলার নিয়ে আমরা ছুটল উত্তর দিকে। স্রোতের বিপরীতে চলতে গেলে জঙ্গল ঘেঁষে চলতে হয়। কিন্তু এদিকে ডাকাতরা থাকে। তাই একটু মাঝ নদী দিয়ে যাচ্ছি আমরা। মোটকথা বন্দুকের গুলির রেঞ্জ এর বাইরে দিয়ে চলাই সুন্দরবনের নিয়ম।
আধা ঘণ্টা পর বাম পাশে চাইলেবগী। এই খাল বনদস্যুদের চলাফেরার পথ। এখানে দাঁড়ানো যাবে না। এর পরে আর বড় খাল নাই। পরের নদী ভদ্রা। কিন্তু সেখানেও ফরেস্ট অফিস আছে। সর্দারকে বললাম, আমরা কি তাহলে নদী পাড়ি দিবো? উল্টো দিকের কোনো খালে ঢুকবো? সর্দার বললেন, নদী তো বেশ গরম। অন্ধকারে পাড়ি দেওয়া রিস্ক হয়ে যাবে। এসময় জেলেদের একজন বললো, বড় কানছিঁড়া খালে ঢুকলে হয় না? ভদ্রার আগে পড়বে ওই খাল। মুখের দিকটা ছোট হলেও খালটা ভিতরে বেশ বড়। পাশে আরেকটা খাল আছে। তার নাম ছোট কানছিঁড়া। ওই খালও ভালো। কিন্তু ভাটায় পানি থাকে না।সামনের জোয়ার আসা পর্যন্ত বড় খালটাতে থাকা যাবে। ভিতরে ঢুকলে বাইরে থেকে কেউ দেখতে পাবে না।
ট্রলার নিয়ে ঢুকলাম সেই খালে। ভিতরে ঢুকতেই দেখি বেশ কয়েকটি নৌকা। আমাদের দেখে যে যার মতো ছুটলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে হারিয়ে গেলো তারা। আমরা নোঙ্গর করলাম। বাজে রাত আটটা। এখানে চার ঘণ্টার বিরতি নিবো।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)