আদাচাই-এ গোলাগুলি, মুখোমুখি জাহাঙ্গীর ও নোয়া বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৩৪৯ | Rupantorer Golpo 349 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৪৯ : নৌকার সাথে নৌকা। একটার সাথে আরেকটা বাঁধার সময় পায়নি জেলেরা। মনে হয় কেবলই আসছে সবাই। চরপাটা, খালপাটা, বড়শি আর কাঁকড়ার নৌকা। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে সবার বাড়ি খুলনার দাকোপ অথবা পাইকগাছা। নিচু স্বরে কথা বলছে সবাই।
অন্ধকারে কাউকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছে না। নৌকাগুলোতে কোনো বাতি জ্বলছে না। সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। জানতে চাইলাম, কী হলো? কোথায় গুলি? শব্দ তো পেলাম না! একজন বললো, আদাচাই এর ভাড়ানীতে ছিলাম আমরা। ওখানকার ফরেস্ট অফিসের আশেপাশে গোলাগুলি হইছে। প্রচুর গুলি। আমরা ভয়ে এদিকে চলে আসছি।
কিন্তু কার সাথে কার গোলাগুলি হলো? কেউ বলতে পারে না। বুঝতেও পারছি না ঠিক। গতকাল পাশাখালী থেকে নোয়া মিয়া বের হলো। তারা হয়তো ওদিকেই গেছে। তাদের সাথে কোনো আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ হলো না তো? ভাবছি, কী হতে পারে?
আমাদের দেখে প্রথমে এই জেলেরা দ্বিগুণ ভয় পেয়েছে। ওদের নাস্তা দিতে বললাম। তারপর গণহারে চা খাওয়ালাম। সর্দারকে বললাম, ট্রলারে চাল-ডাল আছে? আর কিছু বলতে হলো না। নিচ থেকে চালের বস্তা বের করা হলো। নৌকায় নৌকায় দেওয়া হলো চাল, ডাল আর খাবার পানি। ভয় কাটলো ওদের। তারপর একজন এসে বসলো আমার পাশে। ফিসফিস করে বললো, আমাকে চিনতে পারছেন?
টর্চ এর আলোয় চিনতে পারলাম। ঝাপসী-জোংড়া এলাকায় তাদের সাথে দেখা হতো। পিঠে হাত রেখে বসলাম তার পাশে। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বললো, মনে হয় দুই ডাকাত দলের মধ্যে গোলাগুলি হইছে। আদাচাই ফরেস্ট অফিসের পাশের খালে জাহাঙ্গীর বাহিনী আছে কয়দিন ধরে। আরও কয়েক জন জেলে উঠলো ট্রলারে। আলোচনা আর আগালাম না।
এদিকে ভাটা শেষ প্রায়। সামনের জোয়ারে আমরা ফিরে যাবো। সর্দারকে বললাম, এদিকে যা হয় হোক। ট্রলার ছাড়ার প্রস্তুতি নেন। সর্দার বললেন, রাতের খাবারটা খেয়ে নেন। তারপর ছাড়ি? এখান থেকে আমাদের মংলা যেতে বেশি সময় লাগবে না। ওদের নতুন করে ভাত রান্না হয়েছে। কাঁকড়া ভুনা দিয়ে খেলাম রাতের খাবার।
জেলেদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ট্রলার ছাড়লো। মামুন আছে সুকানিতে। বললাম, ধীরে ধীরে আগাও। দুই পাশের জোনাকির আলো দেখতে দেখতে চাই। সর্দার এসে পাশে বসলেন। বললাম, এতো গোলাগুলি হলো কিন্তু শব্দ পেলাম না কেন? আদাচাই তো এখান থেকে খুব বেশি দূরে না। উনি বললেন, বেশি না হলেও দূরত্ব একদম কম না। এছাড়া জঙ্গলে গুলির শব্দ বেশি দূর যায় না।
গল্পে গল্পে এগুচ্ছি। প্রায় আধা ঘণ্টা সময় নিয়ে পার হলাম বড় কানছিঁড়া খাল। পশুর নদীতে উঠতেই সুকানিতে দাঁড়ালেন বেলায়েত সর্দার। বললেন, ধরে বসেন ভাই। মামুনকে সামনের দিকটা গুছিয়ে নিতে বললেন। সহযাত্রীদের সতর্ক থাকতে বললাম। এখন আমরা আড়াআড়ি পার হবো। পশ্চিম দিক থেকে সোজা যাবো পূর্ব পাশে।
রাত বাজে একটা। জোয়ার লেগেছে ঘণ্টা খানেক হলো। এসময় পূর্ব পাশ দিয়ে গেলে ভালো হতো না? পশ্চিম পাড়ে হাড়বাড়িয়া ফরেস্ট অফিস পড়বে। ওদিকে কোস্টগার্ডের জাহাজও থাকে। এছাড়া জয়মনিরঘোল যাওয়ার আগেই নন্দবালা ফরেস্ট অফিস পড়বে। ওখানে কোস্টগার্ডের একটা ভাসমান ক্যাম্পও আছে। তাছাড়া চাঁদপাই রেঞ্জ এর টহলও থাকে। সর্দার বললেন, রাত বাজে একটা। তার উপর মরা গোন। কেউ বের হবে না ভাই।
পশুর পাড়ি দিতে সময় লাগলো না। বাতাস নাই। মরা গোন বলে নদীও বেশ ঠান্ডা। পূর্ব দিকের জঙ্গল ঘেঁষে আমরা এগিয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুই পর পড়লো সেলা নদী। ওখানে বন বিভাগের একটি ট্রলার আছে। আমাদের থামতে বললো। কিন্তু না দেখার ভান করে আমরা এগিয়ে চললাম উত্তরে। কোনো রকমে জয়মনির ঠোঁটা পার হলেই লোকালয়। আর কোনো সমস্যা নাই।
চিলা বাজারে পৌঁছালাম ভোর চারটার দিকে। ঘাটে ট্রলার ভিড়লো। সাথে থাকা জেলেরা এখানেই নামলো। বনদস্যুদের ডেরা থেকে পালিয়ে এসেছে ওরা। এখান থেকেও বহু দূরে তাদের বাড়ি। সর্দার বললেন, ওরা যাবে কী করে ভাই? পকেটে তো এক টাকাও নাই। মটরসাইকেল ভাড়া দিয়ে ছাড়লাম ওদের। আমরাও নামলাম চিলা বাজারে।
ভোর হয়নি এখনও। অবশ্য গ্রামের বাজারটিতে তখন মানুষের অভাব নাই। সকালে হাট বসবে। আশপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ট্রলার, নৌকা আর বড় বড় বজরা এসেছে মালপত্র নিয়ে। বিরাট হই হুল্লোড় চলছে। চায়ের দোকানগুলো খোলা। আমরা ঘণ্টা খানেক সময় এখানে থাকবো। চা আড্ডা দিয়ে ট্রলারে ফিরবো। বাজার থেকে বিদায় নিলেন সর্দার। আমরা ছুটলাম মংলার দিকে। সেখানে অফিসের গাড়ি রাখা।
মংলা থেকে রওনা দিলাম সকাল সাতটায়। পথে কাঁটাখালী বাজারে নাস্তার বিরতি নিলাম। তারপর গাড়ি ছুটলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। বাসায় একটা ফোন দিয়ে দিলাম ঘুম। দুই রাতের ঘুম একসাথে ভর করেছে শরীরে। ওদিকে জঙ্গল থেকে ফোনের পর ফোন আসছে। টের পাইনি।
ফেরি ঘাটে এসে ঘুম ভাঙলো। কুয়াশায় রাতে ফেরি চলেনি। তাই তীব্র জ্যাম। মাওয়া ঘাটে লম্বা লাইন ধরে ফেরিতে উঠলাম। তারপর ফোন হাতে বসলাম।
দস্যুনেতা নোয়া মিয়া ফোন দিয়েছে কয়েক বার। ফিরতি ফোন করলাম। বেশ উচ্ছসিত সে। বললো, রাতের বেলা বিরাট একটা অভিযান করেছে। জাহাঙ্গীর বাহিনীর আস্তানায় হামলা করেছে তারা। বললাম, তার মানে রাতে আদাচাই ফরেস্ট অফিসের ওখানে গোলাগুলি আপনারাই করলেন? নোয়া মিয়া বললো, সে কথা জানলেন কী করে ভাই? বললাম, রাতে আমরা ভদ্রার নিচে ছিলাম, বড় কানছিঁড়া খালে। জেলেরা বললো গোলাগুলির কথা।
হাসতে হাসতে নোয়া মিয়া বললো, গত কয়েক দিন ধরে জাহাঙ্গীর বাহিনীকে খুঁজছে তারা। ওদের কারণে মধ্য সুন্দরবনে তাদের চাঁদাবাজি করতে সমস্যা হচ্ছে। এক এলাকায় দুটি বড় বাহিনী থাকলে চলে? বললাম, জাহাঙ্গীরের দলে মানুষ কয়জন? সে বললো, ১৫-২০ জন হবে। তবে ওরা ছিলো বেকায়দায়। জাহাঙ্গীরের ছোট বউ আর বাচ্চা ছিলো সাথে।
বললাম, আপনারা তো পরশু রাতে পাশাখালী ছিলেন। নোয়া মিয়া বললো, আপনারা আসলেন বলে সরে আসলাম। বললাম, থাকলেই পারতেন, সাথে দেখা হতো! নোয়া মিয়া বললেন, ট্রলার দেখে তো বুঝিনি। ভাবলাম কে না কে! পরে শুনছি আপনারা। ফরেস্টাররা ফোন করে জানালো। বললাম, ফরেস্টাররাই ফোন করে জানায়? সে বললো, ওদের মধ্যে কিছু লোক তো থাকেই। এই যেমন নোয়া মিয়ার খবরও তো ওরাই দিলো। আদাচাই অফিসের এক স্টাফ ফোন করে বললো, বউ বাচ্চাসহ জাহাঙ্গীর উঠেছে সেখানে। এর মধ্যে অফিসেও নামছিলো তারা। সেই খবর পেয়েই তো হামলা করলাম।
কী হলো বলেন তো? কেউ মারা গেছে গোলাগুলিতে? নোয়া মিয়া বললো, কাউকে মারার চিন্তা তো করি না ভাই। আমরা ডাকাত হলেও সেই ডাকাত না। খুন খারাবির কাজ করি না। বন্দুক রাখি নিজেদের বাঁচার জন্য। বললাম, তাহলে জাহাঙ্গীরের উপর হামলা করলেন কেন? দস্যুনেতা বললো, সে আমাকে হুমকি দিছে। বলে বেড়ায় যে আমাকে নাকী পানি মাপতে পাঠাবে। মানে আমাকে মেরে সে লাশ পানিতে ডুবিয়ে দিবে। এই জঙ্গলে সে ছাড়া আর কোনো পার্টি থাকবে না। এই জন্য নতুন নতুন বন্দুক আর হাজার হাজার গুলি কিনছে। আমার তো আর অতো কিছু নাই। সাথে একটা থ্রি ওয়ান জিরো বন্দুক আছে। ওই দিয়ে কাল ঘাপায়ে দিলাম।
থ্রি জিরো ওয়ান হলো গুলির মাপ। গুলিগুলো থ্রি নট থ্রির চেয়ে একটু বড়। প্রতিপক্ষের ট্রলার ডুবাতে হলে এমন একটা বন্দুক থাকা লাগে। মেলা টাকা খরচ করে একটা বন্দুক আনছি ইন্ডিয়া থেকে। সাথে বাকী বন্দুকগুলোও তো খারাপ না। আর কালকের হামলার পর জাহাঙ্গীর বাহিনীর লোকজন জঙ্গলে নেমে গেছে। তিনটা বন্দুক পাইছি। আর ট্রলারশুদ্ধা টেনে নিয়ে আসছি। তাতে লাখ তিনেক টাকার বাজার ছিলো। বললো, সাথে বৌ-বাচ্চা ছিলো বলে আর কিছু বলিনি। মানুষ টার্গেট করে গুলি করলে একজনও বাঁচতো না।
তাহলে তো শক্তি বাড়ছে আপনার। এবার সারেন্ডার করেন। নোয়া মিয়া বলে, আরেকটু গোছায়ে নেই ভাই। অনেক দেনা। ছোট মিয়া প্রায় চল্লিশ লাখ টাকা পায়। বললাম, এখনও ছোট মিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে? এবার তড়িঘড়ি করে ফোন রাখলো দস্যুনেতা। তার নাম বাকী বিল্লাহ। ছোট মিয়া বা ছোট সাহেব নামে পরিচিত ছিলো পুরনো দস্যুনেতা রাজু। তার খালাতো বা ফুপাতো ভাই এই বাকী বিল্লাহ। রাজু দস্যুতা ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে। তবে এখনও সুন্দরবনে তার প্রভাব আছে।
নোয়া বাহিনীর সদস্য কারা জানি না। তবে জেনেছি, বেশ কয়েকজন পুরনো ডাকাত আছে সেখানে। সকলের বাড়ি মংলা ও রামপাল। ২০১৫ সালে মাস্টারের কাছে পরাস্ত হওয়ার পর তারা আবার সংগঠিত। আত্মসমর্পণ করার কথা বললেও আসলে তাদের মতলব ভিন্ন। জাহাঙ্গীর বাহিনীকে ধ্বংস করতে পারলে মধ্য সুন্দরবনে তারা একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করবে। ওদের এতো বড় হতে দেওয়া যাবো না। আবার ভাবছি, এখানে আমার কিছু করার নাই। সবকিছু সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম।
রাতে ঢাকা ফিরলাম। পরদিন থেকে অফিস।দস্যুতা নিয়ে আমার কাজ। সংবাদের বাইরে তাদের সারেন্ডার করানোর চেষ্টা করছি। সেই কাজেও সমর্থন আছে। অফিসে বসে দস্যুদের সাথে যোগাযোগ করি। আইন শৃঙ্খলা বাহানীর সাথেও বসি। ফোনে কথা হয় বরিশাল RAB এর উপ অধিনায়ক মেজর আদনান কবীরের সাথে। আমার সবশেষ সফর নিয়ে তারা কিছু জানে না। শুধু আদনানকে বললাম, আমার কাজ আগাচ্ছে। তবে এই কাজটি বন্ধ করার চেষ্টা করছে একটি পক্ষ। তুমি তোমার হাই কমান্ডে কথা বলো। বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের কাজ বন্ধ করা যাবে না। আদনান একটু দমে গেছে। মনে হয় দস্যুমুক্ত সুন্দরবনের যাত্রায় তাকেও বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সাথে দেখা করলাম। সুন্দরবনে আমার সবশেষ সফর নিয়ে জানালাম। উনি কাজ এগিয়ে নিতে বললেন। জানতে চাইলাম, আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া বন্ধের কোনো সম্ভাবনা আছে? উনি বললেন, অনেকে অনেক কথা বলবে। কিন্তু বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী নিজে দেখভাল করছেন। উনি কাজ এগিয়ে নিতে বলেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গ্রিন সিগন্যাল পেলাম। উনি শুধু বললেন, জাহাঙ্গীর বাহিনীকে সারেন্ডার করাও। তার নামে অনেক অভিযোগ। বললাম, জাহাঙ্গীর সারেন্ডার করতে চায় না। তবে চেষ্টা করবো।
দুই দিন পেরিয়ে গেলো। জাহাঙ্গীরের কোনো খোঁজ নাই। ফোনে চেষ্টা করলাম, বন্ধ পাচ্ছি। আশেপাশের কাউকেও পাচ্ছি না। তৃতীয় দিন সকাল বেলা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ওপাশ থেকে জাহাঙ্গীর বললো, আপনারা আমার সাথে এই কাজটা করলেন? বললাম, আমি আবার কী করলাম? সে বললো, ওই যে নোয়া বাহিনীকে দিয়ে অ্যাটাক করালেন? আপনি তো জঙ্গলেই ছিলেন। ওরা পাশাখালীতে আপনার সাথে দেখা করলো দুপুরে। সেই রাতেই আক্রমণ করলো! কেন? আপনি জানতেন না? বললাম, আপনার তথ্য ঠিক না। নোয়া মিয়াকে আপনাদের খোঁজ দিয়েছে বন বিভাগের কেউ। ভালো করে খবর নেন। আর আপনাকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন। যদি মন পরিবর্তন হয় তো জানাবেন। সে বললো, জাহাঙ্গীর বেঁচে থাকতে সারেন্ডার করবে না।
রামপালের এই দস্যুনেতা বেশ রগচটে। দলের সদস্যদের সাথে তাই বনিবনা হয় না। তার দলের কয়েক জনের সাথে কথা হয়। তারাও লিডারের উপ ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে ছুতারখালীর ফারুক আর রামপালের সাত্তার যেকোনো সময় অঘটন ঘটাতে পারে। ছোট জাহাঙ্গীর, ছোট রাজুসহ কয়েক জন দল থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুঁজছে। ওদের সাথে আলাদা করে কথা হয়। আমি বলেছি, কোনো রকম রক্তপাত চাই না। অপেক্ষা করো। যদি শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর সারেন্ডার না করে তবে বের হয়ে আসো।
জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বাছের। তার সাথেও কথা হয়। সেদিন বাছেরের কাছে শুনলাম আদাচাইয়ের গোলাগুলির ঘটনা। বললো, এতো করে বলি যে মামীকে এতো ঘন ঘন জঙ্গলে আনার দরকার নাই। কিন্তু সে শুনে না। সাথে মহিলা আর বাচ্চা থাকলে কি ফাইট করা যায়? ওই দিন লিডার তার পরিবার নিয়ে ট্রলারেই ছিলো। আমরা জানি যে নোয়া মিয়ারা পাশাখালী আছে। ওখানে কয়দিন থাকার কথা। কিন্তু আপনারা আসায় তারা এদিকে সরে আসে। এর মধ্যে কোত্থেকে আমাদের খবর পাইছে। রাতেই এসে অ্যাটাক করলো।
তারপর কী হলো? কেউ নিহত বা আহত হইছে? বাছের বললো, পাল্টা গুলি তো করতে পারিনি। লিডার বললো, পালাও সবাই। সাথে সাথে ট্রলার থেকে নেমে জঙ্গল ধরলাম। লিডারের বউ বাচ্চা নিয়ে একটা দল গেলো বেলমারীর দিকে। আমরা গেলাম ভাটিতে, মামার খালের দিকে। দুই দিন কিছু খাওয়া হয়নি। পরে ফোনে ফোনে যোগাযোগ হয়। একটা বড়শির নৌকায় বউ বাচ্চাকে তুলে দিয়ে তারপর মামার খালে আসে ওরা। তিনটা অস্ত্র আর কিছু গুলি নিয়ে গেছে নোয়া মিয়া, ট্রলারটাও গেছে। বললাম, তোমাদের দলের অবস্থা কিন্তু ভালো না। জাহাঙ্গীরকে বলবে, সবাই তার উপর ক্ষ্যাপা। বিপদ হতে সময় লাগবে না। বাছের বললো, জাহাঙ্গীর মামা যা শুরু করছে তাতে নিজেও বাঁচতে পারবে না, আমরাও মরবো। এই জীবন আর ভালো লাগে না মামা।
দস্যু জীবন ভালো লাগার জীবন না। সুন্দরবন জীবন অনেক বেশি কঠিন। দস্যুরা মনে করে অস্ত্র থাকলেই তারা নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবতা পুরোই উল্টা। যেমন বিবদমান দুটি দস্যুদলই এখন অস্ত্রশস্ত্রে শক্তিশালী। কিন্তু ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটছে তাদের ভেতরেই! ভাবছি, ওরা যা করে করুক। নিজেরা নিজেরা মারামারি করে দুর্বল হোক। পরে শুনেছি, এই ঘটনার পেছনে কলকাঠি নাড়ছে সেই ছোট মিয়া অর্থাৎ সাবেক দস্যুনেতা রাজু।
(ডিসেম্বর ২০১৬, সুন্দরবন)