রূপান্তরের গল্প ৩৫০ | Rupantorer Golpo 350

পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা চলছে | রূপান্তরের গল্প ৩৫০

পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা চলছে | রূপান্তরের গল্প ৩৫০ | Rupantorer Golpo 350 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫০ : বেলমারীর জঙ্গল ধরে হাঁটছে কিছু মানুষ। তাড়া খাওয়া এই দলটিতে আছে দস্যুনেতা, তার স্ত্রী-সন্তান আর বিশ্বস্ত কয়েক জন বনদস্যু। বাছের নামে দস্যুনেতার ভাগ্নের কাঁধে শিশু ইয়াসিন। পরনের কাপড় ছিঁড়ে গেছে দস্যুপত্নী ময়নার। দৌড়ানোর সময় বাধ সেধেছে হেঁতাল-হরগজার কাঁটা। লজ্জা নিবারনের জন্য ময়না লুঙ্গি পড়েছে। সারা রাতের সেই যাত্রা শেষ হয়েছে মামার খালে গিয়ে। মামার খালটি বের হয়েছে শিবসা নদীতে।

ক্লান্ত শরীর, খাবার নাই, পানি নাই। ভয়ঙ্কর এক সময়। কিন্তু কোথাও দাঁড়ানোর সুযোগও নাই। অন্ধকারে প্রতিপক্ষ দস্যুরা হয়তো খুঁজে পাবে না। কিন্তু সুন্দরবনের বাঘ তো রাতেই শিকার করে। মধ্য সুন্দরবনের বেলমারী, নিশানখালী, কালির খাল, মামার খাল এলাকায় বাঘের চাপ সব সময় বেশি। বনদস্যুরা বলতো, প্রতি বছরই এদিকে বাঘ মারে তারা। কিন্তু বাঘের উৎপাত কমে না। পালানোর সময় ময়নার হাতেও একটি বন্দুক ছিলো। শুনেছি, বিভিন্ন রকমের অস্ত্র চালানোর অভ্যাস তার ছিলো।

রাতে রাতেই একটি ডিঙ্গি নৌকা জোগাড় করে বাছের। বিশ্বস্ত জেলে। দস্যুনেতার স্ত্রী ময়না আর শিশু ইয়াসিনকে তুলে দেয় সেই নৌকায়। সামান্য খাবার ও পানি নিয়ে রওনা হয় তারা। বেলমারী থেকে নিশানখালীর ভাড়ানী হয়ে রওনা দেয় তারা। ডিঙ্গি নৌকা চলে ছোট ছোট খাল আর ভাড়ানী দিয়ে। চাইলেবগী খাল পেরিয়ে আদাচাই এর ভাড়ানী ফুঁড়ে ভদ্রা নদী পাড়ি দেয় নৌকা। তারপর ঝাপসীর খালে ঢুকে একটি ছোট্ট খালে গা ঢাকা দেয়। সন্ধ্যার পর চারপাশের খোঁজ নিয়ে নৌকা আগায়। যতোটুকু জানতে পারলাম, খুলনার ছুতারখালী দিয়ে তারা ডাঙ্গায় উঠেছে সেই রাতেই।

এদিকে আক্রান্ত বাঘের মতো ফুঁসছে দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর। ছোট-খাটো গড়নের লোকটির হাতে থাকে ছোট বাঁটের শর্টগান। সেটি নিয়ে হম্বিতম্বি চলছে। কোনো ভাবে তাকে ঠেকানো যাচ্ছে না। মনে মনে নোয়া বাহিনীর উপর আক্রমণের ছক আঁকছে সে। শুধু স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তাটা কাটলেই হয়! রাত পোহানোর আগেই সেই খবর আসে। স্ত্রী-সন্তান ডাঙ্গায় পৌঁছানোর পর পর সে নেমে পড়ে অভিযানে।

প্রথম কাজ একটি ট্রলার জোগাড় করা। কিন্তু হুট করে কি ট্রলার পাওয়া যায়? প্রথমে দুটি জেলে নৌকা কেড়ে নেয়। তারপর শুরু হয় যোগাযোগ। জাহাঙ্গীর তার সব শক্তি নিয়োগ করে। যে করেই হোক নোয়া বাহিনীর অবস্থান জানতে হবে। পাল্টা হামলা করে প্রতিশোধ না নেওয়া পর্যন্ত ঘুম হবে না তার।

একদিন পর শুনি দুবলার চরের এক জেলের ট্রলার অপহরণ করেছে বনদস্যুরা। আরও খোঁজ নিয়ে জানলাম, ট্রলারটি জাহাঙ্গীর বাহিনী অপহরণ করেছে। ভাবছি যারা নিজেরাই চলাফেরা করছে নৌকা নিয়ে তারা কী করে ট্রলার আটকাবে? আরও ভালো করে খোঁজ নিলাম। জানতে পারলাম, ট্রলারটি ইচ্ছা করে জাহাঙ্গীরের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারপর অপহরণের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ দুবলার চরের ওই ট্রলার মালিকের সাথে দস্যদের যোগসাজস আছে। এরপর এনিয়ে আর খোঁজ খবর নেওয়ার প্রয়োজন নাই। ওরা যা পারে করুক।

সবশেষ সংঘর্ষের পর মধ্য ও পশ্চিম সুন্দরবনে সুনশান নিরবতা। বনদস্যুদের কোনো নড়াচড়া নাই। বেশির ভাগ জেলে এসবের কিছুই জানে না। তবে বন বিভাগের কিছু কর্মী নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন। যাদের সাথে দস্যুদের যোগাযোগ আছে তারা খুব বেশি তৎপর। উনাদের কয়েক জনের সাথে আমারও কথা হচ্ছে।

বনরক্ষীরা এসবের মধ্যে মাথা গলাচ্ছেন! কথাটি কেউ বিশ্বাস করবে না। তবে আমি জানতে পারছি অনেক কিছু। দস্যুদের সাথে মিশতে গিয়ে জঙ্গলের জটিল সব ঘটনা এখন চোখের সামনে। বনদস্যুদের কারও কারও সাথে বন বিভাগের কারও কারও যোগাযোগ নিবিড়। বাইরে থেকে বুঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে তাদের যোগাযোগ বেশ মজবুত। তেমন একজন আমাকে বললেন, জাহাঙ্গীর তাকে খুঁজছে। সেই দস্যুনেতার অভিযোগ, দুই দিন আগে ফরেস্ট অফিসের পাশের খালে তাদের অবস্থানের কথা নাকী সেই বনরক্ষী ফাঁস করেছেন। তিনিই নাকী নোয়া বাহিনীর বিশ্বস্ত সোর্স।

আতঙ্কিত বনরক্ষীকে সতর্ক থাকতে বললাম। তারপরও বার বার ফোন করছেন তিনি। বলছেন আমি যেন জাহাঙ্গীরকে তার বিষয়ে বলি। বলবো বলে ফোন রাখলাম। এরপর জাহাঙ্গীর বাহিনীর নাম্বারে ফোন দিলাম। ফোন ধরলো বাছের। বললাম, তোমরা কি বনরক্ষীদের উপর হামলার কোনো পরিকল্পনা করছো? সে বললো, মামা অর্থাৎ দস্যুনেতা জাহাঙ্গীর এমন কথা বলছে। বললাম, খবরদার! এই কাজ করতে যাবে না। বাছের বললো, না মামা। এতো বড় ভুল আমরা করবো না। তবে নোয়া মিয়াকে ছাড়া হবে না।

এসময় পাশে বসা জাহাঙ্গীরকে ফোন ধরিয়ে দিলো সে। আমার কথা শুনে দস্যুনেতা বললো, কাউকে ছাড়বো না আমি। নোয়া মিয়ার এতো বড় সাহস! এটা সেটা বলে ফোন রাখলাম। তারপর ফোন দিলাম নোয়া মিয়াকে। তার সবগুলো ফোন বন্ধ।

সুন্দরবনে বড়সড় সংঘর্ষ ঘটবে মনে হচ্ছে। পরিচিত জেলেদের সাথে কথা বলছি। বিশেষ করে আমার সোর্সদের সাথে আলোচনা বাড়িয়েছি। সারাটা দিন ফোনেই থাকি। বেলায়েত সর্দারকে বললাম, এর মধ্যে জঙ্গলে ঢুকবেন না। সুন্দরবন গরম হয়ে আছে। আপনাকে পেলে তৃতীয় পক্ষ কোনো ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে। এলাকায় থাকেন। কোনো রকম ঝুঁকিতে যাবেন না।

আপাতত অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নাই। নিয়মিত কাজে নেমে পড়লাম। ঢাকায় প্রতিদিনের কাজগুলো করছি। অফিসের কিছু কাজ নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। দেশের দক্ষিণ পূর্ব উপকূল অর্থাৎ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের জলদস্যুতা নিয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি। সামনে বাঁশখালী, চকরিয়া, মহেশখালীর দস্যুদের আত্মসমর্পণ করানোর পরিকল্পনা করছি। কাজটি সহজ হবে না। তবে চেষ্টা করতে সমস্যা কোথায়?

অফিস থেকে একটি ট্যুর নিয়ে কক্সবাজার গেলাম। মহেশখালীর পুরনো দস্যুদের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখলাম তাদের একটি অংশ ক্রসফায়ারে মারা গেছে। তবে বেশির ভাগই পালিয়ে আছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। সন্দ্বীপ ও হাতিয়ার মাঝের জাহাইজ্জার চরে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হয়েছে। তার আগে থেকে চলছে দস্যুবিরোধী অভিযান। ওই অঞ্চলে জলদস্যুদের লুকানোর আর জায়গা নাই। তাই ফেরারি দস্যুরা অস্ত্র লুকিয়ে রেখে অন্য জায়গায় থাকে। সময় সুযোগ মিলিয়ে মাঝে মাঝে সাগরে নামে তারা। দস্যুতা করে রাতে রাতে ফিরে আসে। এই জলদস্যুরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকে। কাউকে বিশ্বাস করে না। নিজের মতো করে কিছু যোগাযোগ করে ফিরে এলাম।

৫ জানুয়ারি ২০১৭। ভোরবেলা ফোনের পর ফোন আসছে। কিন্তু সবগুলোই অপরিচিত নাম্বার। পরিশ্রান্ত শরীর। ফোন সাইলেন্ট করে আবার ঘুম দিলাম। ভাবলাম পাশ ফিরে আরেকটু ঘুমাই। এমন সময় মনে পড়লো সুন্দরবনের কথা।

ফোন হাতে নিয়ে বসে পড়লাম। ফিরতি কল করলাম। ওপাশ থেকে একজন বললো, ও ভাই, আপনি কোথায়? বললাম, আমি ঢাকায়। কে বলছেন? ওদিক থেকে কথা বললো আমার এক সোর্স। জানালো, রাতেই নোয়া বাহিনীর উপর আক্রমণ হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর বাহিনী তাদের উপর হামলা করছে।

একটার পর একটা ফোন দিচ্ছি। কাউকে পাচ্ছি না। নোয়া বাহিনীর ফোন বন্ধ। জাহাঙ্গীর বাহিনীর কারও ফোনে পাচ্ছি না। দুপুর গড়াতে গড়াতে খর ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। শুনলাম, নোয়া মিয়ারা বেশ ফুর্তিতে ছিলো। ওরা ভেবেছে এতো তাড়াতাড়ি পাল্টা আক্রমণ হবে না।

শিবসার পূর্ব দিকে ছোট নিশানখালীতে ছিলো নোয়া বাহিনী। মজার ব্যাপার হলো, নোয়া বাহিনী কোথায় আছে সেই খবরও জাহাঙ্গীরকে দিয়েছেন একজন বনরক্ষী। আরও ভালো করে খোঁজ নিলাম। বিকাল বেলা জানতে পারলাম, নোয়া বাহিনীকে জাহাঙ্গীর বাহিনীর খবর যিনি দিয়েছিলেন, সেই ব্যক্তিই জাহাঙ্গীরকে নোয়া বাহিনীর অবস্থান জানিয়ে দেন। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে একের পর এক! এখন পর্যন্ত নোয়া মিয়ার কোনো খবর পাচ্ছি না। একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। বেঁচে আছে তো ওরা?

(ছবিতে নোয়া বাহিনী। জানুয়ারি ২০১৭, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top