ইশারা দিলো বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৩৫২ | Rupantorer Golpo 352 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim
রূপান্তরের গল্প ৩৫২ : ভয়ঙ্কর এক নদী শিবসা। যখন তখন পাগলামি করে। বিশেষ করে চৈত্র-বৈশাখ মাসে এই নদী দিয়ে চলাফেরা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অবশ্য এখন শীতকাল। শিবসার সেই ভয়ঙ্কর চেহারা হয়তো দেখবো না। আমরা যাচ্ছি দক্ষিণে। শিবসার প্রায় শেষ মাথায়। জায়গার নাম ছোট নিশানখালী।
বেলায়েত সর্দার ট্রলার চালাচ্ছেন। আমি আর মামুন গলুইয়ে বসা। কুয়াশা বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে শীতের তীব্রতা। জানুয়ারি মাসে এদিকে শীত থাকে সবচেয়ে বেশি। ঘন কুয়াশায় ক্রমেই চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। সামনে পেছনে কিছুই দেখছি না। শুধু টর্চ জ্বালিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছি। পেছনের ট্রলার দুটো সেই আলো দেখতে পাচ্ছে কী না বুঝতে পারছি না।
এখনও ফোনের নেটওয়ার্ক আছে। ফোন দিলাম RAB কর্মকর্তা এএসপি জসীম ভাইকে। বললেন, আমাদের ঠিক পেছনেই তাঁরা। টর্চের আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তবে ট্রলারের ছাদে লাল সিগন্যাল বাতিটা দেখতে পাচ্ছেন। বললাম, কোনো দিকে সরবেন না। ওই আলোটাকেই অনুসরণ করবেন। ফোন রেখে সর্দারকে ধীরে চালানোর ইশারা করলাম। টর্চের আলো দিয়ে রাতে আমাদের কথাবার্তা চলে, মানে ইশারায় চলে কথাবার্তা। দীর্ঘ দিনে এবিষয়ে বোঝাপড়াটা দারুণ হয়েছে।
কালাবগী খাল রেখে শিবসায় পড়তেই একটু দুলে উঠলো ট্রলার। দেখি সর্দার হেঁটে আসছেন সামনের দিকে। সুকানি ধরেছে মামুন। ক্যাপ্টেনের এই পালা বদলের কারণে ট্রলার একটু বেসামাল হয়। তারপর আবার সব ঠিকঠাক।
সর্দার এসে পাশে বসলেন। তারপর বললেন, ভেজা কাপড়ে বসে আছেন ভাই? উত্তরা বাতাস ছাড়ছে কিন্তু। এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে বড়ফ হয়ে যাবেন একদম। উত্তেজনায় ভুলে গেছিলাম ভেজা কাপড়ের কথা। ওই শিবসার মুখে ট্রলার ঠেললাম। তারপর আর কাপড় বদলানো হয়নি। সর্দারের তাড়া খেয়ে উঠলাম। কাপড় বদলাতে যাওয়ার আগে সর্দারকে কানে কানে বললাম, শেখের খাল পার হয়ে কোথাও আছে ওরা। সর্দার বললেন, নোয়া মিয়া কি বেঁচে আছে ভাই? বলেই সেই বিরাট হাসি!
কেবিনের ভেতরে আমার কাপড়ের বাক্স রাখা। চলন্ত ট্রলারে সেখানে যাওয়া, ভেতরে ঢুকে কাপড় বের করা আমার জন্য বেশ কষ্টের। সর্দার উঠে আমার ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে আনলেন। আমি ভেজা কাপড় ছাড়লাম। জ্যাকেট, মাফলার পড়ে আবার গলুইয়ে গিয়ে বসলাম। তারপর শুরু হলো দুই ভাইয়ের গল্প।
নোয়া মিয়া কী করে রাজি হলো ভাই? ওর তো সারেন্ডার করার কথা না! সর্দারের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, বিড়াল গাছে চড়ে কখন? সর্দার বললেন, ও কী কথা? নোয়া বাহিনী ঠ্যালায় পড়ে আত্মসমর্পণ করবে? তো কী ঠ্যালা দিলেন আপনি? বললাম, আমি কিছুই করিনি। খালি খোঁজ খবর রাখছিলাম। সর্দার বললেন, তাহলে আপনারা খোঁজ খবরেই ও ঠ্যালায় পড়লো? বললাম, না। জাহাঙ্গীর বাহিনীর ঠ্যালায় সারেন্ডার করতে যাচ্ছে নোয়া বাহিনী।
শিবসার পূর্ব দিকের জঙ্গল ঘেঁষে আগাচ্ছি আমরা। মাঝে মাঝে জেলেদের নৌকা দেখছি। কুপি বাতিগুলো জ্বলছে। কুয়াশা ভেদ করে টিমটিম করা সেই আলো বেশ দেখা যাচ্ছে। এদিকের জেলেরা বেশির ভাগই বনদস্যু ও বন বিভাগের সাথে সমঝোতা করে চলে। তাই অভয়ারণ্যেও তাদের বিচরণ বেশ খোলামেলা।
বাম দিকে চলে গেছে মোহাম্মদ আলীর দোয়া। এদিক দিয়ে ঝাপসী, চিপা, মরা পশুর, জোংড়া, করমজল, ভদ্রায় যাওয়া যায়। ঘুরে ঢাংমারী হয়ে লোকালয়ে ফেরা যায়। আবার সবগুলো খাল ধরে বের হতে পারবো পশুর নদীতে।
রাতে খাইছেন কিছু? সর্দারের প্রশ্নে ক্ষুধার কথা মনে পড়লো। বললেন, আমি আগেই রান্না করে রাখছি। ভাত আর ডাল রান্না করছি ট্রলারে। আর মা দিলো হাঁস রান্না করে। বললাম, একজন দুইজন করে সবাইকে খাওয়ায় দেন। কিন্তু বাকী ট্রলারগুলোর ওরা কী খাবে? সর্দার বললেন, এই জঙ্গলে এসে সবার কথা ভাবলে হবে না বাই। আগে নিজে খেয়ে জীবন বাঁচান। পরে ওদেরটা দেখবোনে।
বসে পড়লাম ট্রলারের সামনের দিকের পাটাতনে। সর্দার একটু ভাত বেড়ে আনলেন। সহকর্মী ইয়ামীন ভাইকে নিয়ে খাওয়া সারলাম। অন্ধকারের মধ্যে কোনো রকমে নাকে-মুখে ভাত দিলাম। তারপর দেখি শহীদুল কাকু এক কাপ চা নিয়ে হাজির। হাত ধুয়ে গলুইয়ে গিয়ে বসলাম। আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিলাম। দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার আগেই দেখি পেছনের দিকে হট্টগোল হচ্ছে। জানতে চাইলাম সমস্যা কোনো? মামুন গলা বাড়িয়ে বললো, পিছনের ট্রলারগুলো দেখছি না। ওরা মনে হয় আমাদের হারায়ে ফেলছে!
এখানে কোনো ফোনের নেটওয়ার্ক নাই। RAB এর কাছে স্যাটেলাইট ফোন আছে। কিন্তু সেই ফোন দিয়ে তো তারা আমাদেরকে পাবে না! বিপদ বুঝতে পেরে সর্দার গিয়ে সুকানিতে দাঁড়ালেন। ব্যাক গিয়ার দিয়ে জায়গায় ঘুরিয়ে ফেললেন ট্রলার। তারপর উল্টো দিকে চললাম। মিনিট দশ চলার পর ট্রলার থামালাম।
কোথাও কাউকে দেখছি না। গেলো কোথায় ওরা? সর্দার বললেন, ওই দিকে! মানে আরও পেছনে, শিবসার মাঝ বরাবর জায়গায়। আমরা ট্রলার থামিয়েছি ওই ট্রলারগুলোর শব্দ শোনার জন্য। মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে এবার সেদিকে ট্রলার চললো। আরও প্রায় পনেরো মিনিট পর দেখলাম ওদের। কুয়াশা আর অন্ধকারে হুটহাট কিছু করা যায় না। তবে এর মধ্যেও সর্দারের কেরামতি দেখি মাঝে মাঝে। যে করেই RAB এর ট্রলারের কাছাকাছি যেতেই হবে।
হঠাৎ করে গতি বাড়লো। মাঝ নদীতে একটা চক্কর দিয়ে ট্রলার ঘুরিয়ে আনলেন সর্দার। তারপর আস্তে আস্তে পাশাপাশি চলা শুরু করলো। কাছে আসতেই লাফ দিলাম। ওই ট্রলারে উঠে বললাম, আপনারা আমাদের ফলো করছেন না কেন? ওরা বললো, তিন নম্বর ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে। তারপর এটার সাথে বেঁধে নিতে একটু সময় লাগলো। তারপর দেখি আপনারা নাই। RAB এর মাঠ পর্যায়ের একজন গোয়েন্দা বললো, আমরা হারায়ে গেছি কিন্তু চিন্তা করছি না। আমরা জানি আপনি খুঁজে নিবেন! বললাম, সুন্দরবনে উদাসীন থাকার কোনো সুযোগ নাই ভাই। এ এব বিরাট বিপদের এলাকা। কোন দিক থেকে আসবে বুঝতেও পারবেন না।
ট্রলারে ফিরে আবার সামনে গিয়ে বসলাম। উত্তরা বাতাস বেড়েছে। তাই কুয়াশা একটু কম। বাতাস থাকলে কুয়াশা জমার সুযোগ পায় না, কেটেও যায়। তবে নদীর উপর জমাট বাঁধা কুয়াশা কাটতে সময় লাগে। দক্ষিণে যাচ্ছি বলে শীতের বাতাস খুব একটা গায়ে লাগছে না। আমরা আরেকটু জঙ্গলের দিকে ঘেঁষে গেলাম। সামনে আদাচাই ফরেস্ট অফিস। তারপর থেকে আমাদের সিগন্যালের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
জোয়ার লেগেছে অনেক ক্ষণ হলো। স্রোত বেড়েছে। আর আমরা চলছি স্রোতের উল্টো দিকে। সাথের ট্রলার দুটির একটির ইঞ্জিন নষ্ট। আরেকটি সেটিকে টেনে নিচ্ছে। স্রোত ঠেলে সামনের দিকে এগুতেই পারছে না তারা। বিরক্ত হয়ে সুকানিটি আবার মামুনের হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ও মামুন, কচ্ছপের গতিতে আমি ট্রলার চালাতি পারি না। তুই গিয়ে সুকানি ধর। বলেই সামনের দিকে চলে আসলেন বেলায়ত সর্দার।
আমাদের ডান পাশে অর্থাৎ শিবসা নদীর পশ্চিম দিকটাও বেশ গহীন। ওদিকে ডাকাতের চাপ থাকে সারা বছর। আবার শিকারীদের তৎপরতাও থাকে বেশি। গেওয়াখালী থেকে আংটিহারা পর্যন্ত অঞ্চলেও ছোট ছোট দস্যুদল আছে। ওদিকে আরও পশ্চিমে কয়রা, শ্যামনগরের সুন্দরবন। সেদিকেও চোর-ডাকাতের অভাব নাই। আমাদের পশ্চিমে পাটাকাটা নামে একটি জায়গা আছে। ওখানে প্রচুর হরিণ! শিকারীদের পছন্দের জায়গা। মিন্টু শিকারীর মুখে শুনেছিলাম এই জায়গার কথা। সে বলতো, ওখানে জঙ্গলে নামায়ে দিলে কয়েক মিনিটের মধ্যে শিকার করতে পারবে সে। শুধু তাই না, বড় বড় হরিণ আছে। এদিকে বাঘের চাপ বেশি। নদী খালে কুমিরও আছে পর্যাপ্ত। সর্দার বললেন, আপনারা যে তখন হুট করে পানিতে নামলেন, কাজটা ঠিক করেননি। এদিকে কুমিরের অভাব নাই।
বুকের ভেতরটা শিরশির করে উঠলো। সত্যি তো! ভুলে গেছিলাম যে এই নদীতে হুটহাট নেমে পড়ার মতো বোকামী করা যায় না। ২০১৩ সালে ইলিয়াস ডাকাতের আস্তানায় যাওয়ার সময় আমরা বেশ কয়েকটি বড় কুমির দেখেছি। এদিকে কুমিরের আক্রমণে আহত অনেক মানুষ এখনও বেঁচে আছেন।
সর্দার বললেন, আছি আমরা ট্রলারে। ভয় পাওয়ার কিছু নাই। বললাম, ভয় পাচ্ছি না ভাই। তবে ভয় না পাওয়ার কোনো কারণ নাই। এটা মানুষের জীবনের ব্যাপার! গল্প করতে করতে আরেক দফা চা আসলো। মামুন বেশ যত্ন করে চা বানিয়েছে। বেশ লাগছে! এসময বেশ বড়সড় ঢেউ এসে বাড়ি দিলো। উথাল পাথাল পানি। তাকিয়ে দেখি সামনে আদাচাই অফিস। আদাচাই খাল যেখানে শিবসার সাথে মিশেছে সেখানে সব সময় বেশ স্রোত থাকে। সেই রোলিং কাটিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম আরও দক্ষিণে! আমাদের অনুসরণ করছে RAB এর ট্রলার।
আদাচাই ফরেস্ট অফিসের সব লাইট বন্ধ। জায়গাটি পেরিয়ে কয়েকটি ছোট ছোট খাল পড়লো। আমি এবার গলুইয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। ওদিকে সূর্য উঠার সময় হয়ে যাচ্ছে। সামনে কী যে হয়! ভাবছি, নোয়া মিয়া তার দলবলসহ থাকবে তো?
সর্দারকে পাঠালাম সুকানিতে। আমার অবস্থান গলুইয়ে। টর্চ হাতে এক রকম ডিউটিতে নামলাম। বনদস্যুদের ইশারা না পাওয়া পর্যন্ত এভাবেই দাঁগিয়ে থাকবো। এমন সময়ে এসে মন বলছে, থাকবে নিশ্চয়ই। ওরা তো নিজেরাই আমাকে ডেকেছে। তবে বুঝতে পারছি না যে তারা আজকে উঠবে নাকী আবার সময় নিবে?
আরও প্রায় এক ঘণ্টা চললাম। বাম দিকের জঙ্গলে প্রচুর জেলে নৌকা দেখছি। শেখের খাল অতিক্রম করার পর চারপাশ একদম সুনশান। মনে হচ্ছে এদিকের কোনো জায়গা থেকে টর্চের ইশারা পাবো!
অবশেষে নিশানখালীর ওদিকের ছোট্ট একটি খাল থেকে ইশারা আসলো। ছোট করে টর্চের আলো জ্বললো নিভলো কয়েক বার। সর্দারকে গতি কমানোর ইশারা দিলাম! তারপর নিজের হাতের টর্চটি দিয়ে তিনবার অনঅফ করলাম। ওদিক থেকেও পাল্টা ইশারা দিলো!
(৬ জানুয়ারি ২০১৭)