রূপান্তরের গল্প ৩৫৪ | Rupantorer Golpo 354

অস্ত্রের সাথে বনদস্যুদের হিসাব মিলছে না | রূপান্তরের গল্প ৩৫৪

অস্ত্রের সাথে বনদস্যুদের হিসাব মিলছে না | রূপান্তরের গল্প ৩৫৪ | Rupantorer Golpo 354 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫৪ : কথার বাহাদুর অনেক দেখেছি। কিন্তু বনদস্যুদের মধ্যে কাজের বাহাদুর খুব একটা দেখলাম না। বাইরে থেকে যা শুনি বাস্তবে সুন্দরবনের দস্যুরা ঠিক তেমনও না। অনেক বন্দুকযুদ্ধের গল্প শুনেছি। এই দস্যুরাও মাত্র তিনদিন আগে আক্রমণ করেছিলো আরেক দস্যু জাহাঙ্গীরের ডেরায়। সাথে স্ত্রী-সন্তান ছিলো বলে পাল্টা গুলি করেনি জাহাঙ্গীর। আবার সেই দস্যুরা যখন নোয়া বাহিনীর উপর হামলা করলো, তখন এরাও পাল্টা গুলি না করে পালিয়েছে। তাই দুই পক্ষের কেউই হতাহত হয়নি।

দস্যুনেতা নোয়া মিয়ার নাম ডাক ভালোই শোনা যায়। তাকে না দেখলে, না জানলে মনে হবে না জানি কী দুর্ধর্ষ সে! আসলে জীবনের তোয়াক্কা না করা বনদস্যুর সংখ্যা নেহায়েত কম। বরং দস্যুদের চেয়ে সাধারণ জেলেদের অনেক বেশি সাহসী মনে হয়। ওরা খালি হাতে লড়াই করে। লড়াই করেই বেঁচে থাকে।

আগে থেকে চিনলেও নোয়া মিয়ার আজকের আচরণে সত্যিই অবাক হয়েছি। একচি দস্যু দলের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সক্ষমতা তার মধ্যে দেখছি না। অবশ্য আগেও তার প্রমাণ পেয়েছিলাম। ২০১৫ সালে মাস্টারসহ মাত্র ছয়জন দস্যু মিলে বিদ্রোহ করেছিলো। অথচ সেই দলে দস্যু ছিলো প্রায় পঞ্চাশ জন। তাদের নেতা ছিলো এই নোয়া মিয়া ওরফে বাকী বিল্লাহ। সেবার পালিয়ে বেঁচেছিলো সে। গুলিতে ফরহাদ নামে একজনের মৃত্যু হয়েছিলো। রাঙ্গা নামে এক দস্যুর হাতে গুলি লাগে। সেই রাঙ্গা অবশ্য এখনও তার সাথেই আছে। আজ আত্মসমর্পণ করবে সেও।

এর আগে নোয়া মিয়াকে একজন সাধারণ বনদস্যু হিসাবে দেখেছি রাজু বাহিনীর আস্তানায়। তারপর অনেক বার ফোনে কথা হয়েছে। লোকমুখে শুনে বুঝেছি লোকটি ভীতু অথচ লোভী প্রকৃতির । দলের সদস্যদের সাথে তার লেনদেন পরিচ্ছন্ন না। আবার সাহসী যোদ্ধাও না। পুরনো ও পলাতক বনদস্যু রাজুর নির্দেশে দল পরিচালনা করতে গিয়ে বার বার সুন্দরবনে নেমেছে সে। বার বার পরাস্ত হয়েছে। ভেবেছিলাম লোভের কারণে শেষ পর্যন্ত সারেন্ডার করবে না। কিন্তু সবশেষ জাহাঙ্গীরের আক্রমণে মনোবল ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া দলের অন্যদের চাপে পড়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো নোয়া বাহিনী।

ট্রলারে উঠে রওনা দেওয়ার কথা বললো নোয়া। দেখলাম ঠকঠক করে কাঁপছে। হাতের অস্ত্রটি নিচে নামিয়ে রাখলো। কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করলাম। ভয় কমানোর চেষ্টা করলাম। কারণ আতঙ্কিত সশস্ত্র মানুষ যেকোনো সময় অঘটন ঘটাতে পারে। একবার ট্রিগারে চাপ পড়লে কী হবে কেউ জানে না।

নোয়া বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১২জন। সকলের বাড়ি বাগেরহাটের মংলা ও রামপাল। অস্ত্র কতোগুলো আছে এখনও জানি না। গণনা করতে হবে। দুটি অস্ত্র হাতছাড়া হয়েছে আগের রাতের সংঘর্ষের সময়। ওদের কাছে গুলি আছে হাজার খানেক। নোয়া বাহিনীতে জাহাঙ্গীর নামে ভয়ঙ্কর এক বনদস্যু আছে। মাইজে ভাই নামে দস্যু জগতে তাকে সবাই চিনে। নোয়া মিয়া কিংবা রাজু বাহিনীর প্রধান রাজুর আত্মীয় সে। খুলনার অবৈধ অস্ত্রের বাজারে তার ব্যাপক যোগাযোগ।

এই জাহাঙ্গীর সুন্দরবনের চেয়ে ডাঙ্গায় থাকে বেশির ভাগ সময়। সে আত্মসমর্পণের বিপক্ষে। কারণ নড়াইলে ভিন্ন পরিচয়ে তার জমিজমা আছে, বাড়ি আছে। স্ত্রী সন্তানরা থাকে সেখানেই। তাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে পায় না। এ দফায় এই একটি মানুষকে আমি নজরে রেখেছি। সহযাত্রী ও সহকর্মী ইয়ামীন ভাইকে বললাম, মাইজে ভাইয়ের দিকে নজর রাখবেন। শুধু জাহাঙ্গীর না, সবাইকে ফলো করবেন। এই জেলেদেরও কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে আমার।

নোয়া বাহিনীর এই অস্থায়ী ডেরায় জেলে যাদের দেখছি তাদের সাথে আগে কখনও দেখা হয়নি। সম্ভবত তাদের মধ্যে কয়েক জন দস্যুও মিশে গেছে। মানে যারা আত্মসমর্পণ করতে চায় না তাদের কেউ কেউ হয়তো জেলে সেজে আছে। সন্দেহটি আরও গভীর হলো যখন দস্যুদের সাথে তাদের নিচু স্বরে কথা বলতে দেখলাম।

বনদস্যুদের সবাইকে তৈরি হতে বললাম। নিউজের কাজগুলো সেরে নিবো। মানে শ্যুটিং করবো। ওদিকে পলিন আবার ঘুম। ডাকতে পাঠালাম। সহকর্মী ইয়ামিন ভাই গিয়ে ডেকে আনলেন। অন্যদিকে নোয়া মিয়াসহ অন্য দস্যুদের নিয়ে বনের ভেতর একটি জায়গায় গেলাম। সেখানে আগে থেকে মাচা করা ছিলো। সেখানে অস্ত্রগুলো সব জমা করলো তারা।

সংবাদ তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো সারলাম। সহকর্মীরা খালের দিকে ফিরলো। সেখানে আরও কিছু ছবি তোলার কাজ করবে তারা। দস্যুনেতা নোয়া, তরিকুল মামা, কিবরিয়া, রাঙ্গা, মাইজে জাহাঙ্গীরসহ আমরা বসেছি। এমন সময় খট করে একটা শব্দ হলো।

চমকে উঠলো সবাই। তাদের চমকে উঠতে দেখে আমিও থমকে গেলাম। কী হলো? সবাইকে চুপ করতে বললো পুরনো বনদস্যু তরিকুল মামা। কান খাড়া করে বুঝার চেষ্টা করছেন কিছু। ইশারায় জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো? ফিসফিস করে উত্তর দিলো, মনে হয় শুকর বা বাঘ আসছে আশেপাশে। বললাম, যেই থাকুক এই জায়গা থেকে চলেন। নৌকায় উঠে বসি।

সারিবন্ধ হয়ে সবাই রওনা দিলাম। আমি আছি মাঝামাঝি। জঙ্গলে আসলে আমাকে সব সময় মাঝামাঝি জায়গায় রাখা হয়। হাঁটার সময়ও মাঝেই থাকি। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চলি সব সময়। তো আমরা হাঁটছি খালের দিকে। মানে যেদিক থেকে একটু আগে হেঁটে আসলাম সেদিকে। ফিরতি পথে দেখি একদম নতুন ঝকঝকে বাঘের পায়ের ছাপ। আসার সময় দেখিনি। তার মানে আমরা যে গাছ ভাঙ্গার শব্দ পেলাম সেটি শুকরের না, বাঘের। মানে বাঘ আমাদের চারপাশে চক্কর দিয়ে ফেলেছে? মানে মামা আমাদের পাশেই আছে!

শিরদাঁড়া বেয়ে কিছু একটা বয়ে গেলো। সবাইকে বললাম, দ্রুত জায়গা ছাড়েন। সবাই জঙ্গল বাদা ছেড়ে নৌকা আর ট্রলারে উঠেন। এখানে একটা অঘটনও ঘটতে দেওয়া যাবে না। আমাদের হাতে সময় নাই। বলেই সবাইকে নিয়ে খালের পাশে ফিরে আসলাম।

বেলায়েত সর্দার রান্নাঘর থেকে উঁকি দিচ্ছেন। গলা বাড়িয়ে বললেন, ও ভাই, ভয় পাচ্ছেন? বললাম, বাঘ আমি ভয় পাই। সর্দার বললেন, চারপাশে এতোগুলো ডাকাত! সবার হাতে বন্দুক! তাহলে ভয় পাবেন কেন? বললাম, এই ডাকাত পার্টিতে বন্দুক-গুলি ভালোই আছে। কিন্তু কোনো বন্দুক যুদ্ধে জিততে পারেনি। খালি শুনি গল্পের শেষে বন্দুক আর জীবন নিয়ে পালানোর গল্প। মানে এরা কেউই ফাইটার না। আর বাঘ সামনে পড়লে বড় বড় বীর পুরুষও বিড়াল হয়ে যায়!

সুন্দরবনে অনেক আসি আমি। আসতে হয়। নানা রকমের কাজে অদ্ভুত অদ্ভুত সব পরিবেশের মুখোমুখি হয়েছি। বনে থাকা, চলাফেরা করা শিখছি এখনও। এই সুন্দরবনে আমি জেলেদের মতো করে চলার চেষ্টা করি। তারা বলে, বাদা বনে আসলে বাঘের সামনে না পড়াই ভালো। মামা দেখলে এড়িয়ে চলে তারা। আমিও শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বাঘ এড়িয়ে চলি। এর সাথে কোনো রকম ঝুঁকি নিতে রাজি না আমি, কিছুতেই না। কাজ করতে হলে বেঁচে থাকতে হবে। আবার আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। বেঘোরে প্রাণ দেওয়া কোনো কাজের কথা না।

খালের পানি টগবগ করছে। মাঝে কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। জোয়ার অর্ধেক হলেও পানি একটু বেশি বেশি লাগছে। একজন প্রবীন জেলে বললেন, সাগরের পরিবেশ ভালো লাগছে না। মনে হয় নিম্মচাপ আছে। ভাটায় পানি পুরো নামেনি আজ। তার মানে এদিক থেকেও বিপদ হতে পারে। আবহাওয়া খারাপ হওয়ার আগে লোকালয়ে ফিরতে হবে আমাদের।

নৌকাগুলো এগিয়ে আনা হলো। উঠে পড়লাম নৌকায়। সেখান থেকে ট্রলারে। দস্যুদের সবাইকে আমাদের ট্রলারে তুললাম। অন্য যারা ছিলো তারাও জঙ্গল ছাড়লো। মানে নৌকায় উঠলো। সবাই মিলে চা খেতে বসলাম। তারপর অস্ত্রগুলো একে একে তারা জমা করলো। মোট ২৫টি বন্দুক তাদের। গুলি হাজারের বেশি। নোয়া মিয়াকে বললাম, অস্ত্র ১৭-১৮টা আর দস্যু আপনারা ১২ জন? অন্যরা গেলো কোথায়? নোয়া মিয়া বললো, আপনি তো সবই বুঝেন। বললাম, বুঝি বলেই তো এখনও মান সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি। বললাম, আপনার দলের কোনো দস্যু সারেন্ডার করতে না চাইলে আপত্তি নাই। কিন্তু অস্ত্র আর গুলি একটাও জঙ্গলে রেখে যাওয়া যাবে না।

নোয়া মিয়া বিড়বিড় করে কিছু বলছে। বুঝতে পারছি, হিসাবে গোলমাল আছে। অস্ত্র আর বনদস্যুদের হিসাবে গরমিল আছে। ওদের চোখমুখ বলছে, কিছু একটা লুকাচ্ছে ওরা। নোয়া মিয়াকে আগেও বিশ্বাস হতো না। এখনও করছি না। এই মুহুর্তে ওদের ফন্দিটা মনে হয় আন্দাজ করতে পারছি। আমাকে পাল্টা খেলা খেলতে হবে। একটা গুলিও রেখে যাবো না। একটি অস্ত্রও ওদের লুকাতে দিবো না। পুরো খেলাটাই চলছে বিশ্বাসের উপর। বনদস্যুরা বিশ্বাস ভাঙতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আমার উপর আস্থা রেখেছে। সেখানে কোনো ফাটল ধরতে দেওয়া যাবে না। দস্যুমুক্ত সুন্দরবন গড়তে হলে সেই আস্থা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে হবে।

এখন হাতে সময় নাই। অবিশ্বস্ত বেশ কয়েক জন বনদস্যু আছে এই দলে। মুশকিল হলো, এগুলো নিয়ে কারও সাথে আলাপ করতে পারছি না। যা কিছু করার নিজেকেই করতে হবে। এক কাপ চা হাতে নিয়ে ভাবতে বসেছি। সবগুলো অস্ত্র বের করবো কী করে এখনও বুঝতে পারছি না।

(৭ জানুয়ারি ভোরবেলা, ছোট নিশানখালী, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top