রূপান্তরের গল্প ৩৫৫ | Rupantorer Golpo 355

লুকানো অস্ত্রগুলো বের করেন! এখনই! | রূপান্তরের গল্প ৩৫৫

লুকানো অস্ত্রগুলো বের করেন! এখনই! | রূপান্তরের গল্প ৩৫৫ | Rupantorer Golpo 355 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫৫ : সর সর করে পানি ঢুকছে খালে। বড় নদীর সাথে লাগানো খাল। তাই স্রোত বেশি। দ্রুত বাড়ছে পানি। মনে হচ্ছে জোয়ারের বেশ চাপ চলছে বড় নদীতে-সাগরে। জেলেরা বলছে, আবহাওয়া ভালো না। কিন্তু আকাশে তার কোনো আলামত নাই। বাতাস নাই। কেমন যেন ঝিম মেরে আছে চারপাশ। আমরা না বুঝলেও এদিকের আবহাওয়ার মতি-গতি তারা ভালো বুঝে। জঙ্গল-সাগরে চলাফেরা করতে গেলে আমি তাদের কথা মানি।

সাথেই শিবসা নদী। ঝড়-বাদল আসলে ওই নদীর চেহারা পাল্টে যায়। ভাবছি, আমরা ছোট খালে আছি, নিরাপদ আছি। কিন্তু RAB এর ট্রলার দুটো নিয়ে টেনশন হচ্ছে। ওখানে অভিজ্ঞ কেউ নাই। তার উপর একটা ট্রলারের ইঞ্জিন নষ্ট। ওদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

বনদস্যু নোয়া বাহিনীর সদস্যরা একে একে বন্দুকগুলো জমা দিচ্ছে। বললাম, ভিতরে গুলিসহ বন্দুক রাখছেন কেন? দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। এমনিতেই নড়বড়ে বন্দুক সব। শুনে নোয়া মিয়া বললো, নড়বড়ে একটাও না ভাই। তবে বন্দুকের ভেতর গুলি রাখা ঠিক না। মুক্ত নামের এক দস্যু বসে পড়লো। বন্দুকগুলোর গুলির চেম্বার চেক করছে সে। ১২ জন দস্যু ১২টি বন্দুক নামিয়ে রাখলো। তারপর বাঁধা অবস্থায় আরও ৫টি বন্দুক রাখা হলো। সব মিলিয়ে ১৭টি। সবগুলো দোনালা, একনলা বন্দুক আর একটি থ্রি ওয়ান জিরো বন্দুক। কোমড় থেকে পোসেসগুলো খুলে রাখছে তারা। তারপর গুলি বের করে গণতে শুরু করলো একজন।

বলছি, বন্দুক তো কম কম লাগে! একজন বললো, জাহাঙ্গীর দুইটা বন্দুক নিয়ে গেছে আগের রাতে। ট্রলারে অনেকগুলো গুলিও ছিলো। ওরা ট্রলারশুদ্ধো সব নিয়ে গেছে। বললাম, তারপরও বন্দুকের হিসাব মিলছে না ভাই। আমার হিসাবে কম করে হলেও ৩০টা বন্দুক থাকার কথা।

নোয়া মিয়াসহ দস্যুরা সবাই চুপ। একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। বললাম, জঙ্গলে নামার সময় আপনাদের কাছে ছয়টা বন্দুক ছিলো। সেগুলো আগের। রাজুর আমলের। তারপর মজনুর কাছ থেকে ২০টা বন্দুক কিনলেন। হলো ২৬টা। তারপর গত সপ্তাহে জাহাঙ্গীর বাহিনীর উপর হামলা করে তিনটা বন্দুক নিলেন। তাহলে কয়টা হলো? উত্তর নাই। নিজেই বললাম, ২৯টা। তারপর ওরা পাল্টা হামলা করে দুইটা বন্দুক নিলো। থাকবে ২৭টা। আপনারা জমা দিলেন ১৭টা। বাকী ১০টা বন্দুক কোথায়?

বনদস্যুরা গোল হয়ে দাঁড়ানো। কোনো কথা বলছে না। আমি তাদের চেহারা পর্যবেক্ষণ করছি। প্রতিক্রিয়া দেখে পরের কথাগুলো বলবো। দেখলাম সবাই একটু অপ্রস্তুত। এখনই শেষ ধাক্কাটা দিতে হবে। দীর্ঘদিন মিশতে মিশতে ওদের মনস্তত্ব একটু একটু বুঝি। বললাম, অস্ত্রগুলো তুলে নেন আপনারা। এভাবে আপনাদের নিবো না আমি। অস্ত্র সবগুলো না নিয়ে যাবো না। বলেই সর্দারকে ডাক দিলাম। বললাম, রান্না কি শেষ হলো? খাবো না আমরা? সর্দার বললেন, খাবেন ভাই। আর দশ মিনিট।

অস্ত্র আর গুলিগুলো রেখে অন্যদিকে হাঁটা দিলাম। দস্যুনেতা নোয়া মিয়া আসলো পেছনে পেছনে। বললো, নিরিবিলি কিছু কথা বলতে চায়। তাকে নিয়ে একটু আলাদা হলাম। নিচু স্বরে সে বললো, কয়েক জন তো সারেন্ডার করবে না। ওরা চাইছিলো অস্ত্রগুলো। বললাম, সারেন্ডারের মধ্যে আর কোনো বেচাকেনা চলবে না ভাই। বাকী অস্ত্রগুলো বের করেন।

ওরা স্তব্ধ হয়ে গেলো। তারপর কোনো কথা না বলে দুইজন ঢুকে পড়লো বনের ভেতর। ডাক দিয়ে বললাম, পাগলের মতো হাঁটেন কেন? বাঘের মুখে পড়বেন? দাঁড়ালো ওরা। তারপর একজন দুটি বন্দুক আর কয়েকটা গুলি নিয়ে নামলো। এরপর শুরু হলো নতুন টেনশন!

সর্দার ডেকে ডেকে সবাইকে বসাচ্ছেন। আমাকেও ডাকছেন। কিন্তু এই দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে কি খাওয়া যায়? কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। দুশ্চিন্তায় ভেতরটা কাঁপছে। বুক ধক ধক করছে। ভাবছি নতুন বিপদ কি কাঁধে নিলাম? সর্দারকে বললাম, সবাইকে খাওয়ায়ে দেন। আমার মাথায় অনেক ঝামেলা। সর্দার বললেন, আপনি ওদের মহা ওষুধ দিয়ে দিছেন ভাই। এখন লুকানো অস্ত্রগুলো হাঁইটে হাঁইটে চলে আসবে। আপনি খাইয়ে নেন। পরে কিন্তু সময় পাবেন না। বললাম, রান্না করতে করতে এসবও খেয়াল করছেন?

ভাতের প্লেট হাতে জায়গায় বসে পড়লাম। হাঁটুতে ব্যাথা। ট্রলারের পাটাতনের উপর বসা একটু কষ্টের। তাই তেলের ড্রাম এগিয়ে দিলো মামুন। পাশে নোয়া মিয়াকে নিয়ে খেতে বসলাম। বললাম, আপনারা কাপড়সহ অন্য জিনিষপত্র গুছিয়ে নেন। দস্যুনেতা বললো, পরনের কাপড় আর এই অস্ত্রপাতি ছাড়া সাথে আর কিছু নাই। আত্মসমর্পণের পর থানা হাজতে থাকবেন রাতে। কাল যাবেন জেলখানায়। বাড়ির লোকজনদের বলবেন থানায় কাপড়চোপড় দিয়ে যাবে।

চা খাচ্ছি। গল্প করছি। পাশাপাশি পলিন কিছু কাজ করছে। কাজ বলতে ভিডিওগ্রাফি। পলিনকে নিয়ে কাজ করার সুবিধা হলো, তাকে আলাদা করে নির্দেশনা দেওয়া লাগে না। ভালো কাজ করে। বিশেষ করে এমন ঝামেলাপূর্ণ পরিবেশে তার কাজগুলো আরও ভালো হয়। তাকে নিয়ে কাজ করতে বের হলে নিউজের ছবি নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হয় না।

সময় কাটানোর জন্য পলিনের সাথে একটু সময় দিচ্ছি। আধা ঘণ্টা কেটে গেলো। কিন্তু ওই তিনজনের আসার কোনো খবর নাই। নোয়া মিয়াকে বললাম, কতোদূর রাখা অস্ত্রগুলো? বললো, বেশি দূরে না ভাই। ওরা এখন খুঁজে পেলেই হয়। বলছি, গতকাল লুকায়ে রাখা অস্ত্র আজকে খুঁজে পাবে না? দস্যুনেতা বললো, পাবে।

দেখতে দেখতে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। ওদিকে নিশ্চয়ই RAB সদস্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নাই। যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থাও নাই। তারপরও একজনকে গাছে উঠালাম। না, নেটওয়ার্ক নাই। আবহাওয়া খারাপ না হলে হয়তো পেতাম। যাই হোক, অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করারও নাই। সর্দার বললেন, আমরা কি এগুবো একটু? বললাম, না ভাই। পরে আপনাকে খুঁজতে আবার আমার নামা লাগবে। কাছেই মামা আছে। ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। আপাতত কান খাড়া করে অপেক্ষা করেন।

রাঙ্গা নামের এক দস্যু আছে এই দলে। তার সাথে সেই রাজু বাহিনীতে দেখা হয়েছে প্রথম। তারপর ইলিয়াসের দলে দেখা। ইলিয়াস চলে যাওয়ার পর নোয়া মিয়ার আগের বাহিনীতে ছিলো। তারপর দলের মধ্যে বিদ্রোহ হলো। গোলাগুলির মাঝে পড়ে সে। হাতে গুলি লাগে। এমনিতে সহজ সরল। কিন্তু দস্যু জগতে লম্বা সময় কেটেছে তার। ইশারায় কিছু বলতে চাইছে সে।

রাঙ্গা’র আরেক নাম মানজুর। মংলায় বাড়ি। এক হাত নষ্ট হয়েছে গুলিতে। চিকিৎসা করাতে পারেনি বলে হাতটা অকেজো। সেই গল্প করতে করতে তাকে নিয়ে একটু সরে গেলাম। ফিসফিস করে সে বললো, মেসিন কয়টা পরে বিক্রি করার পরিকল্পনা করছিলো নোয়া মিয়া। জানতে চাইলাম, কয়টা লুকানো আছে? বললো, আরও আটটা বন্দুক আর শ’ দুই গুলি আছে চাপানো।

হিসাবটা মাথায় রাখলাম। ওদিকে তিনজন দস্যু ফিরেছে। কাদা মাখা শরীরে তারা উঠে আসলো ট্রলারে। দুটি প্যাকেট নিয়ে ফিরেছে তারা। বেলায়েত সরদার আর মামুন মিলে সেগুলো তুলে নিলো। নোয়া মিয়া গেলো খুলতে। বললাম, ওখানে ৮টা অস্ত্র আছে, কিছু গুলি আছে। ওভাবেই থাক। এগুলো এভাবেই RAB হেফাজতে যাবে।

চিৎকার করে বললাম, সবাই তৈরি হন। রওনা দিবো আমরা।

ছবি: নোয়া বাহিনীর অস্ত্র
(৭ জানুয়ারি ২০১৬, ছোট নিশানখালী, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top