রূপান্তরের গল্প ৩৫৭ | Rupantorer Golpo 357

জঙ্গল ছাড়লো নোয়া বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৩৫৭

জঙ্গল ছাড়লো নোয়া বাহিনী | রূপান্তরের গল্প ৩৫৭ | Rupantorer Golpo 357 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫৭ : বনদস্যুরা সবাই নিরস্ত্র। তাদের বসিয়েছি ছইয়ের ভেতর। নোয়া মিয়াকে বসিয়েছি ডেক এর উপর। আমাদের মিশনটি গোপন। তাই হুট করে আমাদের অবস্থান বা উদ্দেশ্য কাউকেই জানতে দেওয়া যাবে না। সবাইকে বললাম, দূর থেকেও যাতে আপনাদের কেউ না দেখে। তবে কিছুতেই তাদের বসিয়ে রাখা যাচ্ছে না।

নোয়া মিয়া নড়াচড়া করছেন না। কিন্তু দলের অন্যরা বেরিয়ে পড়েছে। পুরনো বনদস্যু তরিকুল মামা, মুক্তো, কিবরিয়াসহ কয়েক জন গলুইয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি ওদের মনস্তত্ব বেশ বুঝতে পারছি। এক রকম বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাচ্ছে তারা। এর মধ্যে সেই সময় শুরু হয়েছে। অস্ত্র ছেড়ে খালি হাতে যে স্বাধীনতা সেটি উপভোগ করছে তারা।

বনদস্যু তরিকুল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বয়স ৬০ এর কম না। বাড়ি মংলার বৈদ্যমারীতে। আমার সাথে পুরনো পরিচয়। সেখানকার স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির আত্মীয়। সেই সূত্রে মামা বলে ডাকি। আমাকে ধরে তিনি বললেন, বেঁচে ফিরবো সেই চিন্তা বাদ দিছিলাম মামা। বললাম, আপনারা লোভী প্রকৃতির মানুষ। সবশেষ আপনাদের উপর যে আক্রমণ হলো তাতে বেঁচে থাকার কথা না। আল্লাহ বাঁচাইছে। কপাল ভালো, নাটা জাহাঙ্গীরের দলে ভালো ফাইটার নাই।

তরিকুল মামা বললেন, ওদের বাঁচায়ে রেখে ভুল করছিলাম মামা। আমরা যখন অ্যাটাক করলাম তখন ওর বউ বাচ্চারা ছিলো। সেজন্য আর আগাইনি। বললাম, বৌ বাচ্চা আছে জেনেই আক্রমণ করছিলেন? বললেন, আগে জানতাম না। কিন্তু অ্যাটাক করার পর দেখি মহিলা। তাই ওদের পালানোর সুযোগ দিছি। বললাম, কী লাভ হলো? পাল্টা আক্রমণে তো শুয়ে পড়লেন। অবশ্য আপনারা আক্রান্ত না হলে তো সারেন্ডার করতেন না। তারপরও উঠার সময় কতো নাটক করলেন!

থামালাম গল্প। সত্যি বলতে এখন গল্প করার সময় না। আমাদের RAB এর সদস্যদের সাথে দেখা করতে হবে। এর মাঝখানে আর কিছু ভাবতে পারছি না। সুকানিতে দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর রাখছেন বেলায়েত সর্দার। মামুন আর শহীদুল কাকু এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। আমিও নজর রাখছি। কিন্তু শিবসা নদীর কোথাও কাউকে দেখছি না।

জোয়ারের স্রোতে বেশ দ্রুত আগাচ্ছি। বামপাশে পাটাকাটা। বেশ সুন্দর জায়গা। দ্বীপের মতো কয়েকটি কেওড়ার বন। হরিশ শিকারীদের কাছে এই জায়গাটি বেশ যুঁৎসই। এখনও চরগুলো জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়নি। সেখানে হেঁটে বেড়াচ্ছে হরিণের পাল।

ডানপাশে নিশানখালী। আরেকটু এগিয়ে ডান পাশে ওই খাল। মুখের দিকটা বেশ বড়সড়। সুন্দরবনের দস্যু বাহিনীগুলোর কাছে এই খালটি বেশ আকর্ষণীয়। কারণ এই জায়গায় ট্রলার আর লোকজন নিয়ে লুকিয়ে থাকা সহজ। ঝামেলা হলে যেকোনো দিকে পালানো যায়। শিবসা থেকে পশুর নদীতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পৌঁছানো যাবে এই খাল ধরে। এখনও খুব বেশি ধারণা নাই। তবে বনদস্যুরা বললো, বড় নিশানখালী ধরে চাইলেবগী হয়ে পশুরে পড়া যায়। এদিকে আদাচাইয়ের পর বড় খাল বলতে এটাই।

মামুন কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। আঙ্গুল তুলে ইশারা করলো। বললো, নিশানখালীর ভেতরে ট্র্ররার আছে। এবার গলুইয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। এতো ক্ষণের দুশ্চিন্তা কাটলো এক মুহুর্তে। বড় নিশানখালীর ভেতরে দুটি ট্রলার দাঁড়ানো। আমাদের সাথে আসা RAB এর ট্রলার ওগুলো। সর্দারকে ডান দিকে যাওয়ার ইশারা করলাম।

ট্রলারের মুখ ঘুরলো। সাথে সাথে রোলিং-এ পড়লাম। ট্রলার দুলতে শুরু করলো। এই মুহুর্তে শিবসা নদী বেশ উত্তাল। সর্দার চিৎকার করে উঠলেন। বললেন, সবাই বসেন। মামুন আর শহীদুল কাকু ট্রলারের মালপত্র গুছিয়ে ফেললো, যাতে ঢেউয়ের ধাক্কায় কিছু পড়ে না যায়।

বেশ কসরৎ করে নদীর ডান পাশে পৌঁছালাম। তারপর ধীরে ধীরে এগুচ্ছি। ট্রলারের সামনে দাঁড়িয়ে হাত তুললাম। ওদিক থেকে হাত তুলে ইশারার জবাব দিলেন RAB সদস্যরা। ওই দলের নেতৃত্বে আছেন এএসপি জসীম। আর গোয়েন্দা দলের নেতৃত্বে আছেন মুস্তাফিজ মামা। আপাতত তাঁকে দেখতে পাচ্ছি।

ট্রলার ঢুকলো খালের ভেতর। কাছাকাছি আসতেই দেখি উনারা নড়াচড়া করছেন। ভেতর থেকে বের হলেন জসীম ভাই। আমাকে দেখে হাত তুললেন। বুঝতে পারছি উনি জানতে চাচ্ছেন, সফল হলাম কী না! বুড়ো আঙ্গুল তুলে তাঁকে আশ্বস্ত করলাম। তারপর হাতের ইশারায় বনদস্যুদের দেখালাম।

ট্রলার দুটো পাশাপাশি বাঁধা। পাশে গিয়ে ভিড়লো আমাদের ট্রলার। বেলায়েত সর্দারকে বললাম, ইঞ্জিন নিউট্রালে রাখেন। আমরা এখানে দেরি করবো না। সর্দার বললেন, কতোক্ষণের কাজ এখানে? বললাম, খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট। লোকজন আর অস্ত্রগুলো তুলে দিতে যেটুকু সময় লাগে! সর্দার বললেন, এর মধ্যে আমার একটু কাজ করে নিতে হবে। প্রপেলারে মনে হয় জাল জড়াইছে। সেটা ক্লিয়ার করতে হবে।

বলতে বলতে ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। তারপর গামছা পড়ে দিলেন লাফ। না করার সময় পেলাম না। তার আগেই পানিতে ডুব দিয়ে হারিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড পর ভেসে উঠলেন। শহীদুল কাকুকে বললেন, একটা দা দাও কাকু। প্রপেলারে দড়ি জড়াইছে। কাটতে হবে এখনই। সর্দারকে বললাম, এই নিশানখালী কুমিরের কারখানা। এর মধ্যে নামলেন কেন? এখনই উঠে আসেন। হেসে দিলেন তিনি। তারপর দা নিয়ে আবার ডুব দিলেন। দুই তিন বার ডুবে ডুবে কাজ সারলেন। তিন-চার মিনিটের মধ্যে উঠে পড়লেন ট্রলারে।

এদিকে RAB এর ট্রলারের সাথে বাঁধা হলো আমাদের ট্রলার। এএসপি জসীম ভাইসহ বাহিনীর অন্যরা দাঁড়ানো। নোয়া মিয়া এখনও ডেক এর ভেতরে বসা। খানিকটা ভয় পাচ্ছে। তাকে বের করলাম। বাকী ১১জনকে একসাথে করলাম। ইশারায় পলিনকে বললাম, কাঁথার ভেতরের মাল-পত্র বের করে দেন।

আমাদের ট্রলারে এক সারিতে দাঁড়িয়েছে দস্যুরা। এএসপি জসীম ভাইকে বিস্তারিত জানালাম। বললাম, দ্রুত তাদের বুঝে নেন ভাই। দ্রুত রওনা দিতে হবে। জোয়ার থাকতে থাকতে মংলায় যাবো আমরা। উনি RAB সদস্যদের নির্দেশ দিলেন। মুস্তাফিজ মামাকে বললাম, ডাকাত আর অস্ত্রগুলো বুঝিয়ে দিয়েই রওনা দিবো আমরা। ট্রলারের মাঝি মাল্লাদের তৈরি হতে বলেন।

সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানো নোয়া বাহিনীর সদস্যরা। ওই ট্রলার থেকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। মজা করে তাদের কাছে জানতে চাইলাম, এদের মধ্যে নোয়া মিয়া কে? উনারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। আসলে এদের কোনো ছবি নাই। শুধু নামেই চিনি আমরা। অনেকে ভিন্ন নামে পরিচিত। এদের সনাক্ত করতে তাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হয়। তরুণ আরেক পুলিশ কর্মকর্তা এএসপি শোয়েব আছেন ট্রলারে। উনি শুধু দেখছেন। পাশ থেকে RAB এর এক সৈনিক বললেন, তাড়াতাড়ি করেন ভাই। বেশ বিরক্ত লাগছে তাঁকে। মনে মনে হাসলাম। ভাবছি, গত রাত থেকে আমি যা যা করলাম সেগুলো তো আমার করার কথা না। আস্ত একটি বনদস্যু দল সাথে করে আনলাম, অস্ত্রসহ হাতে তুলে দিলাম। উনারা শুধু অপেক্ষা করেছেন কয়েক ঘণ্টা। তাতেই এতো বিরক্ত? যাই হোক, এখন এসব ভেবে কাজ নাই।

নোয়া মিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। এগিয়ে দিলাম তাকে। ওদিক থেকে হাত বাড়িয়ে দস্যুনেতাকে তোলা হলো RAB এর ট্রলারে। তারপর একে একে বাকীদের তুলে দিলাম। ওদের নিয়ে বসানো হলো। তারপর অস্ত্রগুলো বের করে একটি একটি করে তাদের হাতে তুলে দিলাম। গুলিগুলো ছড়ানো ছিটানো। মুস্তাফিজ মামার নেতৃত্বে অস্ত্র-গুলিগুলো গোছগাছ করা হচ্ছে। ওদিকে নষ্ট হওয়া ট্রলারের ইঞ্জিন ঠিক করা হয়েছে। মাঝিরা সবকিছু চেক করছে।

আমার দায়িত্ব শেষ হলো। দস্যুদের বুঝিয়ে দিয়ে বেশ ফুরফুরে আমি। যদিও রাত জাগা। তারপরও এক একটি কাজ যখন শেষ করি তখন ভালো লাগে। ভীষণ ভালো লাগে। বনদস্যুদের এক একটা বাহিনীকে যখন ট্রলারে তু্লে রওনা দেই তখন মনে হয় সৃষ্টিকর্তা আমাকে দিয়ে আরেকটি কাজ করালেন। মনের মধ্যে দারুণ প্রশান্তি আসে।

RAB এর ট্রলার দুটো চালু করা হলো। RAB সদস্যদের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে চা আসলো। জসীম ভাইকে নিয়ে নিয়ে বসলাম সেখানেই। জরুরি কথাবার্তাগুলো সারছি। তবে এর মধ্যে নোঙ্গর উঠেছে। রওনা হয়েছে আমাদের ট্রলার বহর।

সামনে RAB এর প্রথম ট্রলার। তারপর একসাথে বাঁধা দুটি ট্রলার। একসাথে চলছে। জসীম ভাইকে বললাম, পশুর নদীতে উঠা পর্যন্ত আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। জাহাঙ্গীর বাহিনী এদিকেই আছে। সামনে পড়লে কিন্তু গুলি করে বসতে পারে।

ইউনিফরম পড়া RAB সদস্যরা পজিশনে গেলেন। বনদস্যি মুক্তো শেখ আর কিবরিয়াকে সাথে নিয়ে ফিরে আসলাম আমাদের ট্রলারে। আমরা সবার সামনে থাকবো। পেছনে অনুসরণ করবে বাকী ট্রলার দুটি। পথ দেখাবে দুই বনদস্যু।

আধা জোয়ার হয়ে গেছে। খালের ভেতরটা এদিকে বেশ বড়। তবে যতো সামনে যাবো ততোই সরু হবে খাল। মিনিট পনেরো চলার পর ডান পাশে পাশাখালীর ভাড়ানী। এদিক দিয়ে পাশাখালী ফরেস্ট অফিসে যাওয়া যায়। তবে এই ট্রলার নিয়ে বের হওয়া মুশকিল। আধা ঘণ্টা চলার পর খাল সরু হতে থাকলো। এই জায়গার নাম বেলবারী। বাম পাশের ভাড়ানী দিয়ে আবার শিবসায় বের হওয়া যায়।

আদাচাই ফরেস্ট অফিস কিংবা ভদ্রা নদীতেও যাওয়া যায় এদিক দিয়ে। সচরাচর বনদস্যুরা চলাফেরা করে এসব খাল ধরে। আমরা সোজা উত্তরে যাচ্ছি। আরও প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর পড়লাম চাইলেবগী খালে। সেখানে বেশ কয়েকটি জেলে নৌকা ছিলো। আমাদের দেখে তড়িঘড়ি করে উজানে চলে গেলো তারা। এবার পশ্চিমের পথ ধরলাম। মিনিট দশ চলার পর পেলাম পশুর নদী।

খালের মুখে গতি কমালাম। পথ দেখানো দুই বনদস্যুকে RAB এর ট্রলারে ফিরিয়ে দিলাম। RAB এর টিম লিডার এএমপি জসীমকে বললাম, বড় নদী ধরে আমরা সোজা উত্তরে যাবো। জোয়ার আছে আরও দুই ঘণ্টা। এর মধ্যে আমরা মংলার কাছাকাছি পৌঁছে যাবো। ভদ্রা পার হয়ে মোবাইল ফেনের নেটওয়ার্ক পাবো। ট্রলার মাঝিদের বললাম, আপনারা পশুরের পূর্ব দিকের জঙ্গল ধরে আগাবেন। করমজল পার হয়ে পশুর পাড়ি দিবেন।

ট্রলারে ফিরলাম। সর্দার বললেন, ও ভাই, আপনি একটু ঘুম দেন। বললাম, আমি একটু গোসল করবো। তারপর একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করেন। এখন আর ঘুম হবে না। এই ডাকাতদের আত্মসমর্পণ করিয়ে তারপর দম নিবো। সুকানি শহীদুল কাকুর হাতে দিয়ে অ্যাকশনে নামলেন বেলায়েত সর্দার। গরম গরম চাল ভাজা হবে। লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা মরিচ আর সরিষার তেল দিয়ে এই নাস্তাটা দারুণ হয়। সাথে পুরো এক মগ গরম চা থাকবে।

গলুইয়ে গিয়ে গোসল করে নিলাম। একটু ফ্রেস হয়ে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যেতে হয়। কারণ সেখান থেকে আবার সরাসরি সংবাদে দাঁড়াতে হবে আমাকেই। এছাাড়া একটু টিপটপ পোশাক ছাড়া ওই পরিবেশে নিজেকে বেমানান লাগে। ডেক এ ফিরে চাল ভাজা নিয়ে বসলাম। পশুর নদী ধরে চলছে পর পর তিনটি ট্রলার। আজই বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে সুন্দরবনের আরেকটি দস্যুদল- নোয়া বাহিনী।

(ছবি: বনদস্যুদের হেফাজতে নিচ্ছে RAB
৭ জানুয়ারি, ২০১৭, সুন্দরবন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top