রূপান্তরের গল্প ৩৫৯ | Rupantorer Golpo 359

সুন্দরবন গরম! দল ছেড়ে পালাচ্ছে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৩৫৯

সুন্দরবন গরম! দল ছেড়ে পালাচ্ছে বনদস্যুরা | রূপান্তরের গল্প ৩৫৯ | Rupantorer Golpo 359 | দস্যুমুক্ত সুন্দরবন | সুন্দরবনের গল্প | জীবনে ফেরার গল্প | Jibone Ferar Golpo | Sundarbaner Goppo | Story of Sundarbans | মোহসীন উল হাকিম | Mohsin Ul Hakim


রূপান্তরের গল্প ৩৫৯ : এরপর শুনলে গুলি দিবানে! ওই সাংবাদিকের সাথে কেউ কথা বলবা না! খবরদার! বাহিনীর সদস্যদের প্রতি এটি ছিলো দস্যুনেতা জাহাঙ্গীরের হুসিয়ারি। সেই মাস্টার বাহিনীর পর একটা একটা করে বড় দস্যুদল আত্মসমর্পণ করছে। ওদিকে সাহস বাড়ছে জাহাঙ্গীরের। সুন্দরবনের দস্যু জগতে নাটা জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত এই দস্যুনেতা। বাড়ি রামপাল। বেশ কয়েকটি দস্যুদলে কাজ করতে করতে এখন সে লিডার। সত্যি বলতে বড় দস্যুরা সারেন্ডার করাতে তার সাহস ও শক্তি দুটোই বেড়েছে।

জাহাঙ্গীরের দাপটে এখন জঙ্গল কাঁপছে। বাহিনী খুব বড় না। কিন্তু হম্বিতম্বিতে বিশাল অবস্থা! এই দাপটের খবরে নড়েচড়ে বসেছে বনদস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা। শহরে বসে সুন্দরবনের মাছের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে যারা, তারা যোগাযোগ করছে। অবৈধ অস্ত্রের কারবারীরাও যোগাযোগ করছে। এদিকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনদের সাথেও তার যোগাযোগ বেড়েছে। সোর্সদের মাধ্যমে না, জাহাঙ্গীর এখন সরাসরি কথা বলে দায়িত্বশীল অনেকের সাথে।

মোবাইল ফোন ট্র্যাক করা যায়। এ খবর আগে খুব ভালো ভাবে জানতো না সুন্দরবনের দস্যুরা। জানার পর থেকে তারা বেশ সতর্ক। কিন্তু এটা জানতো না যে সাধারণ প্রক্রিয়ায় ফোন ট্র্যাক করে সুন্দরবনের গহীনে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানো কঠিন। জাহাঙ্গীর কোনো ভাবে এই তথ্যটি পেয়েছে। বনে এসে তাকে ধরা সম্ভব না, নিশ্চিত হওয়ার পর সে কোনো কিছুকে পরোয়া করছে না।

এদিকে দলের মধ্যে উসখুস করছে সদস্যরা। একজন ফোন করে বললো, তারা আত্মসমর্পণ করতে চায়। কিন্তু দস্যুনেতার পরিস্কার কথা, তারা সারেন্ডার করবে না।অবশ্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও সোর্সদের মাধ্যমে সে বলে বেড়াচ্ছে, সারেন্ডার করবে। যোগাযোগ রাখছে তার ছোট স্ত্রী ময়না’র সাথে।

নাটা জাহাঙ্গীরের বাড়ি রামপাল, সেখানে তার প্রথম স্ত্রী বসবাস করে। রাসপালের খামখেয়ালীর মোড়ের কাছে সেই বাড়ি। কিন্তু ছোট স্ত্রী আর সন্তানের জন্য জমি কিনে বাড়ি করেছে মাণিকগঞ্জে। যদিও ময়নার বাড়ি সাতক্ষীরার কালিঞ্চিতে। ছোট পক্ষের শ্বশুর বাড়ির লোকজন মাণিকগঞ্জের বাড়িতে বসবাস করে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে সেখানে যায়, থাকে জাহাঙ্গীর।

নোয়া বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বরিশাল হয়ে ঢাকা ফিরেছি। নতুন দস্যুদলের আত্মসর্পণ নিয়ে সহকর্মীরা উচ্ছসিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা চলছে এসব নিয়ে। বাহবা জানাচ্ছেন অনেকেই। তবে আমি ভাবছি অন্য কথা। আত্মসমর্পণ নিয়ে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।

নিয়মিত অফিস শুরু করলাম। দৈনন্দিন কাজগুলো করছি। এর মধ্যে একদিন ফোন দিলেন RAB এর গোয়েন্দা প্রধান লে কর্নেল আজাদ। সেদিনই দেখা হলো। আজাদ ভাই বললেন, সুন্দরবনের দস্যুদের আত্মসমর্পণে দারুণ সাড়া পড়েছে। এটি দস্যু দমনে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

ধন্যবাদ জানালেন। তারপর বললেন, আপনি বরিশাল RAB কে নিয়ে কাজ করছেন। এবার খুলনা RAB এর সাথে কিছু কাজ করা যায় না? বললাম, নিশ্চয়ই করা যায়। তবে আমার মনে হয় এখন আপনারা বাকী কাজটুকু এগিয়ে নিন। উনি বললেন, জাহাঙ্গীর বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করানো দরকার। তাকে নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট ভালো না। বললাম, জাহাঙ্গীরের সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। উনি বললেন, খুলনা RAB এর সাথে তার যোগাযোগ চলছে।

বললাম, আমি জানি ভাই। সে খুলনাতে সারেন্ডার করবে বলে কথা দিয়েছে। তার আগে কয়েকটি ছোট দস্যুদলকে ধরে দিবে। লে কর্নেল আজাদ বললেন, জাহাঙ্গীরের সারেন্ডারে আপনি থাকবেন। আবারও বললাম, আমার মাধ্যমে সে আত্মসমর্পণ করবে না। ভীষণ ক্ষিপ্ত। বরং আপনারা সরাসরি তাকে আত্মসমর্পণ করান।

সেই রাতেই একটি অঘটন ঘটলো। বনদস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনী ছেড়ে পালিয়েছে কয়েক জন সদস্য। অস্ত্র-গুলি নিয়ে রাতের বেলা পালিয়েছে তারা। ফারুক নামে সুতারখালীর একজন দুটি অস্ত্র নিয়ে পালিয়েছে। পরদিন সকালে সেই খবর চাউর হয়েছে। শুনলাম, পালিয়ে যাওয়া সদস্যদের খুঁজতে বের হয়েছে জাহাঙ্গীর। দলের ভেতর বেশ খারাপ অবস্থা। বিকাল বেলা বাছেরের সাথে কথা হলো। দস্যুনেতার বিশ্বস্ত ও ভাগ্নে নামে পরিচিত সদস্য বাছের আমাকে খবরগুলো জানায়।

পরদিন দুপুরে সাত্তার নামে একজন দল ছেড়ে পালিয়েছে। সাথে আরেক জন ছিলো। খালের গোঁড়ায় ডিউটিতে গিয়ে আর ফিরেনি তারা। সন্ধ্যার দিকে বিষয়টি জানাজানি হয়।

জাহাঙ্গীর পুরো পাগল হয়ে গেছে। দুই দফায় অস্ত্রসহ লোক পালিয়েছে। সন্ধ্যার পর সবাইকে অস্ত্র ও মোবাইল ফোন জমা দিতে বলে। সাথে অতিরিক্ত অস্ত্রগুলো বের করে। হিসাব করতে গিয়ে দেখে নয়টি অস্ত্র গায়েব। গুলি গেছে শ’ পাঁচেক। সন্দেহভাজন দুই জনকে বেঁধে ফেলে সে। এসময় দলের ভেতরে বেশ বাক বিতন্ডা হয়। আত্মসমর্পণ করা-না করা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে শুনলাম। এসময় জাহাঙ্গীর স্পষ্ট ঘোষণা দেয়, যারা সারেন্ডার করতে চায় তাদের চলে যেতে বলে।

মনের মধ্যে থাকলেও আত্মসমর্পণের আগ্রহের কথা কেউ বলছে না। এই দলে পুরনো দস্যুরা আছে। মারুফ, ছোট রাজু, কিস্তেন ফরিদসহ কয়েক জন বেশ পুরনো। তারা ছাড়া সবাই সারেন্ডার করতে চায়। কিন্তু কেউ বলেনি। কারণ তারা জাহাঙ্গীরকে ভালো ভাবে চিনে। বললেই তাদের আটকে ফেলবে। হয়তো বেঁধে তুলে দিবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে।

বকাঝকা করে যার যার অস্ত্র ফেরত দেয় জাহাঙ্গীর। তবে ফোনগুলো রেখে দেয়। জাহাঙ্গীর বলে, বেঈমানী করলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড। হিংস্র হিসাবে তার পরিচিতি আগে থেকেই।

ওদিকের খোঁজ খবর আর রাখবো না বলে ঠিক করেছি। কিন্তু আমি ছাড়লেও সুন্দরবন আর ছাড়ছে না। সুন্দরবনের দস্যু জগতে যা কিছু ঘটে সব খবরই তারা জানায়। বিশেষ করে এখন মধ্য সুন্দরবন উত্তপ্ত। সেই খবর আসছে ফোনে ফোনে।

সাত সকালে আমার এক সোর্স এর ফোন! খুলনার এক মাছ ব্যবসায়ী। বললো, গত রাতে ছোট রাজু নামের এক দস্যু জাহাঙ্গীর বাহিনী ছেড়ে পালিয়েছে। তার সাথে পালিয়েছে আরও পাঁচজন। ছয়টি অস্ত্র আর কয়েক শ’ গুলি নিয়ে সটকে গেছে তারা।

ওদিকে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে বড় কোনো ঝামেলা বাধবে। সুন্দরবনের দস্যু জগৎ নিয়ে মাঝে মাঝে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় (Sixth Sense) কাজ করে। হঠাৎ করে মনে হলো, জাহাঙ্গীর বোধ হয় ধরাসায়ী হবে। হয় দলের মধ্যে কোন্দল হবে, গোলাগুলি হবে। অথবা অন্যকিছু। এসব ভাবছি যখন, তখন ফোন আসলো জাহাঙ্গীর বাহিনী থেকে।

ওপাশ থেকে দস্যু বাছের বললো, খুব বিপদে আছি মামা। বললাম, খবর পাইছি। তোমার লিডার কোথায়? বললো, জাহাঙ্গীর এখনও ট্রলারে। এই সুযোগে ফোন দিলাম। মামা কিন্তু আপনার উপর খুব ক্ষ্যাপা। বলে কী, পৃথিবীর কোনো শক্তি তাকে সারেন্ডির করাতে পারবে না। লোকগুলো পালায়ে গেলো, তার জন্য সে আপনাকে দায়ী করছে। বললাম, পালানো কারও সাথে আমার কথাও হয়নি। কথা বলতে বলতে ফোন কেটে দিলো সে। মনে হয় তার লিডার এসেছে।

সকালের নাস্তা সেরে অফিসের দিকে রওনা হলাম। পথে একটার পর একটা ফোন। সুন্দরবনের খবর নিয়ে সোর্সরা ফোন দিচ্ছে। মাছ ব্যবসায়ীরা জানতে চাচ্ছে। সবাইকে বললাম, আমি কিছু জানি না। আপনারা RAB এর কাছে ফোন দেন। উনারা বলতে পারবে। সত্যি বলতে আমি আর কাজ করতে চাই না। সবাইকে সেভাবেই বলছি। আমি এসব থেকে দূরে সরতে চাই।

এবার পুরোদমে সাংবাদিকতা করতে চাই। গত কয়েক বছরে আমি জাতীয় রাজনীতির খবর নিয়ে কাজ করছি না। অথচ আমি একজন রাজনৈতিক রিপোর্টার। অন্য বিষয়ে কাজ করি নেশা থেকে। প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে কাজ করতে, সাংবাদিকতা করতে আমার ভালো লাগে। উপকূলের মানুষদের অনেক সমস্যা। তাদের নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে।

দস্যুদের নিয়ে আমার কাজটি অনেক দূর এগিয়েছে। এই মুহুর্তে আত্মসমর্পণ বেশ জটিল পর্যায়ে চলে গেছে। জাহাঙ্গীরের লোকজন ভাগছে। মনে হয় নতুন দল গড়বে তারা। তার মানে আবারও বাড়বে দস্যু দলের সংখ্যা। কাজটি করতে গিয়ে শুরুর দিকে অনেক কথা শুনেছি। নানা রকমের অপপ্রচার ছিলো। ভাবতাম না জেনে সমালোচনা করছেন কেউ কেউ। কিন্তু এই পর্যায়ে এসেও আমার বিষয়ে সমালোচনা হবে?

সাধারণ মানুষ অনেক কিছু ভাবতে পারে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন কী করে আমার বিষয়ে বিভ্রান্তিতে থাকেন? কী করে তারাও অপপ্রচার করেন? খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর আর বরিশালের কিছু সাংবাদিক নিদারুণ নেতিবাচন প্রচারণায় নেমেছেন।

ঢাকার সাংবাদিকদের মধ্যেও কানাঘুঁষা চলছে। মোহসীন উল হাকিম কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছে, এমন অপপ্রচার বেশ জোরেশোরে চলছে। খুলনা RAB ও সদর দপ্তরের কয়েক জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মুখেও ঘুরছে নেতিবাচক কথাবার্তা। এই বাহিনীতে আমার বিশ্বস্ত অনেকেই আছেন। তাঁরা আমাকে জানাচ্ছেন সেসব কথা। সব মিলিয়ে বেশ মন খারাপ। তার উপর জাহাঙ্গীরের হম্বিতম্বি শুরু হয়েছে। দস্যুদের পৃষ্ঠপোষকরা এসব নিয়ে বেশ খুশি। শুনলাম, খুলনার সাংবাদিকদের দিয়ে বনদস্যুদের সারেন্ডার নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ করানোর চেষ্টা করছেন তাঁরা। যেকোনো মূল্যে বনদস্যুদের সারেন্ডার বন্ধ করতেই হবে যেন!

এসময় হঠাৎ করে ফোন দিলো পশ্চিম সুন্দরবনের ত্রাশ আলিফ। মানে আলিফ বাহিনীর প্রধান। বললাম, কী বিষয়? কী মনে করে ফোন দিলে? বললো, খুলনার সোর্সরা ফোন দিচ্ছে। বলছে, ওই সাংবাদিকের মাধ্যমে আর কোনো সারেন্ডার হবে না। নির্দিষ্ট এক বা দুইজন কর্মকর্তার নাম ও নাম্বার দিচ্ছে তারা। বলছে, এখন থেকে ওই কর্মকর্তার বাইরে আর কারও সাথে কথা বলা যাবে না। বললে তাদের বিপদ হবে! আলিফকে বললাম, তোমরা অনেক বেড়ে গেছো। সেই কবে সারেন্ডার করার কথা! করলে না। আমি কিন্তু আর এসবের মধ্যে নাই! আলিফ বললো, সারেন্ডার করতেই তো জঙ্গলে আসছি বাপজান। আপনি না থাকলে আমরা সারেন্ডার করবো না! আলিফ বেশ পুরনো বনদস্যু। আমাকে ডাকে বাপজান বলে!

আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। RAB এর গোয়েন্দা প্রধানকে মেসেজ দিয়ে শুধু জানালাম, আমাকে নিয়ে আপনার লোকজন অপপ্রচার করছেন।

(জানুয়ারি, ২০১৭, সুসুন্দরবন
ছবিটি একজন বনদস্যুর। জাহাঙ্গীরের ছবি আরেবটু পরে দেখতে পাবেন)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top